কালী পুজোর ইতিহাস, রূপের বর্ণনা
মা কালী হলেন শক্তির দেবী। তার অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু তথা বাঙালিদের কাছে এই দেবী বিশেষভাবে পূজিত হন। তন্ত্র মতে পূজিত প্রধান ১০ জন দেবীরর মধ্যে তিনি অন্যতম পূজিত দেবী। যারা সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করতে চান যারা তন্ত্র এবং মন্ত্র ক্ষমতায় যারা বিশ্বাস করেন, যারা মানুষরূপী হয়েও ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী হতে চান তারা মা কালী পূজা অত্যন্ত ভক্তি সহকারে করে থাকেন। সাধারণত কালী মায়ের উ রূপগ্র আমাদের মনে ভয়ের উদ্রেক করে।
কিন্তু কালী মায়ের এরকম উগ্র রূপ সৃষ্টির পেছনে আছে পৌরাণিক কারণ। ভারতে কালীপুজোর উৎপত্তি বিকাশ এবং প্রচলন প্রথা সম্পর্কে নানা তথ্য চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। সেই সকল তথ্য কোনটা সত্য আর কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা তা কিন্তু বলা খুব মুশকিল। বর্তমানে সারা ভারত জুড়ে কালী মায়ের ভক্তি সহকারে যে পূজার প্রচলন আমরা দেখতে পা,য় অতীত ঘাঁটলে তার উৎপত্তি সম্পর্কে নানান তথ্য আমরা পেয়ে থাকি। আজকের প্রতিবেদনে আমরা সেসব তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব আপনাদের সামনে।
কালী মায়ের রূপের বর্ণনা:-
আমরা সাধারণত কালী মাতার যে রূপের দর্শন পায় তা হলো তিনি চতুর্ভূজা অর্থাৎ তার চারটি হাত যুক্ত মূর্তি আমরা দেখতে পাই ।এই হাতে মধ্যে আছে একটিতে খড়গ, অন্যটিতে অসুর মুণ্ড অন্য হাতগুলিতে তিনি বর এবং অভয় প্রদান করেন। গলায় নরমুণ্ডের মালা, প্রতিকৃতি ঘন কালো বর্ণের এবং জীভ মুখ থেকে বাইরের দিকে বেরিয়ে আছে । এছাড়াও তিনি এলোকেশী। মা কালীকে দেখা যায় শিবের বুকের উপর পা দিয়ে জিভ বার করে দাঁড়িয়ে আছেন।
কালী পূজার বাংলায় উৎপত্তি:-
কালী শব্দটি কাল শব্দের স্ত্রীর রূপ, যার অর্থ হলো কৃষ্ণ বর্ণ বা গুরু বর্ণ। বিভিন্ন পুরাণ থেকে থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মা কালী মহামায়া মা দুর্গার অন্য একটি রূপ। মা আবার প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী কালী একটি দানবীর রূপ। মহাভারতে একটি দেবীর উল্লেখ আছে যিনি হত যোদ্ধা এবং পশুদের আত্মা বহন করে যার নাম কাল রাত্রি বা কালি। নবদ্বীপের এক তান্ত্রিক যার নাম কৃষ্ণানন্দ তিনি বাংলায় প্রথম কালীমূর্তি বা প্রতিমা পূজার প্রচলন করেন।
তার আগে মা কালীর উপাসকরা তাম্র পটে বা খোদাই করে কালীর মূর্তি এঁকে মা কালী সাধনা করতেন। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন কৃষ্ণনন্দ বাবু কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজা করতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালী পূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন এবং এইভাবে মা কালীর প্রতিমা পূজার প্রচলন শুরু। উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার বিভিন্ন ধনী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপুজোর ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়।
মা কালীর বিভিন্ন রূপের বর্ণনা:-
তন্ত্র এবং পুরাণে দেবী কালীর একাধিক রূপের বর্ণনা পাওয়া যায় যেমন দক্ষিণা কালী, শ্মশান কালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী ,গ্রহ কালী, চামুণ্ডা, ছিন্নমস্তা ইত্যাদি। মহাকাল সংহিতা অনুসারে মা কালীর আবার নব রূপের পরিচয় পাওয়া যায়।যেমন কাল কালী কঙ্কাল কালী, চিকা কালী এমন সব রূপের রূপের পরিচয় পাওয়া যায়। এছাড়াও বিভিন্ন মন্দিরে ব্রহ্মময়ী আনন্দময়ী ভবতারিণী আনন্দময়ী ইত্যাদি নামেও মা কালীর পূজা বা উপাসনা করতে দেখা যায়।
কালী পূজার সময়কাল:-
দুর্গাপূজার পরবর্তী অমাবস্যাতে দীপান্বিতা কালী পূজা করা হয়। এছাড়াও মাঘ মাসে রটন্তী কালীপূজা এবং জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণী কালীপূজা কালীপূজা ফলহারিণী কালীপূজা কালীপূজা মাসে ফলহারিণী কালীপূজা কালীপূজা ফলহারিণী কালীপূজা কালীপূজা মাসে ফলহারিণী কালীপূজা কালীপূজা ফলহারিণী কালীপূজা কালীপূজা ধুমধাম সরকারে অনুষ্ঠিত করা হয়। অনেক জায়গায় প্রতি অমাবস্যায় এছাড়াও বিভিন্ন সিদ্ধ অমাবস্যায় এছাড়াও বিভিন্ন সিদ্ধ পিঠে প্রতিদিন এবং প্রতি শনি ও মঙ্গলবার মা কালী পূজার প্রচলন দেখা যায়।
মা কালীর উৎপত্তির পৌরাণিক ব্যাখ্যা:-
সনাতন ধর্মীয় শাস্ত্র অনুযায়ী মা কালীর আবির্ভাব সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায় তা হল পুরাকালে শুম্ভ এবং নিশুম্ভ নামক দুই দৈত্য সারা পৃথিবী জুড়ে তাদের ভয়ঙ্কর ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল ।দেবতারাও এই দুই দৈত্যের কাছে যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে। ফলে দেব লোক তাদের হাতছাড়া হয়ে যায় তখন দেবরাজ ইন্দ্র দেভ লোক ফিরে পাওয়ার জন্য আদ্যশক্তি মা মহামায়ার তপস্যা করতে থাকেন তখন দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাদের কাছে আবির্ভূত হন এবং দেবীর তাদের কাছে আবির্ভূত হন এবং দেবীর হয়ে তাদের কাছে আবির্ভূত হন এবং দেবীর তাদের কাছে আবির্ভূত হন এবং দেবীর শরীর কোষ থেকে অন্য এক দেবী সৃষ্টি হয় যা কৌশিকী নামে ভক্তদের কাছে পরিচিত দেবী কৌশিকী মা মহামায়া দেহ থেকে নিঃসৃত হলে মামা মামা কাল বর্ণ ধারণ করে যা দেবী কালীর আদিরূপ বলে ধরা হয়।
কালী পূজার বিভিন্ন পদ্ধতি:-
তান্ত্রিক পদ্ধতিতে মধ্যরাত্রে অর্থাৎ অমাবস্যার রাত্রে মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে কালী পূজা করা হয়। এক্ষেত্রে মা করা হয়। এক্ষেত্রে মা কালীকে পশু রক্ত বা পশু বলি করে উৎসর্গ করা হয়। এছাড়াও লুচি প্রসাদ এবং নানা ফল ভোগ হিসাবে দেওয়া হয়ে থাকে। গৃহস্থ বাড়িতে সাধারণত সাধারণত অতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ মতে মা কালীর পুজা দেখা যায় । এক্ষেত্রে অনেক সময় জমিদার বাড়িতে ছাগ বা মহিষ ছাগ বা মহিষ বা মহিষ বলি দেওয়া হতো এবং বর্তমানেও অনেক জায়গায় পশু বলির মাধ্যমে পূজার প্রচলন দেখা যায় । পুরাকালে বা প্রাচীন সময়ে বিভিন্ন ডাকাতের দল নরবলির মাধ্যমে কালী পূজা করত করত বলে শোনা যায়।
কালীপুজোর পদ্ধতি ও উপকরণ:-
সাধারণত যে কোন পূজায় ভক্তি সহকারে সহকারে করলে আরাধ্য দেবতা বা দেবী আশীর্বাদ দিয়ে থাকেন। যেহেতু মা কালী আদ্যা শক্তির দেবী অর্থাৎ শক্তি এবং সাহস অর্জন করার জন্য এই দেবীর পূজা করা হয় তাই কালী পূজার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিশেষ নিয়ম অবশ্যই মেনে চলতে হয়। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় কালির দোয়াত কালী পূজার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পুজোর শুরু হওয়ার পূর্বে অনামিকা অঙ্গুলি দ্বারা কালির দোয়াত বা লিখনী দোয়াত দিয়ে স্বস্তিক চিহ্ন অঙ্কন করা হয়। স্বস্তিক অঙ্কন সম্পন্ন সম্পন্ন হলে দেবীর পূজা শুরু হয় ।বহুল আয়োজন বা ঘনঘটা করে অনুষ্ঠান করলে দেবী যে প্রসন্ন লাভ করেন তা কিন্তু নয় ।কালীপুজোর অন্যতম প্রধান উপাদান হলো জবাব জবাব জবাব ফুল তাই কালীপুজোর ক্ষেত্রে মা জবা ফুল খুবই পছন্দ করেন অন্যতম প্রধান উপকরণ হিসেবে অবশ্যই রাখতে হয় জবা ফুল।
এছাড়াও আস্থা ভক্তি এবং শ্রদ্ধা সহকারে পূজা করা হলে মায়ের আশীর্বাদ অবশ্যই লাভ করা যায় কালীপুজোয় অন্যতম প্রধান ভোগ হিসাবে সোম রস রস ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সাধারণত মধ্য রাতে এই পূজা শুরু হয় এবং ভোররাতে এ পূজা সম্পন্ন হয়ে থাকে। সাধারণত আরতি ,আহ্বান এবং পুষ্পাঞ্জলির দ্বারা এই পূজা সম্পন্ন করা হয় এছাড়াও অনেক সময় ধ্যান করতেও দেখা যায় এই পূজার ক্ষেত্রে। অনেক সময় ধ্যানের মাধ্যমে দেবী কালীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে আবাহন ও পুষ্পাঞ্জলির মাধ্যমে দেবী কালীর পূজা পদ্ধতি সম্পন্ন হয়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে। জবা ফুল, চন্দন ,পুষ্প, ধূপ, দীপ ইত্যাদি কালী পূজার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
কালীর বিভিন্ন রূপভেদ আছে। যেমন দক্ষিণাকালী, শ্মশানকালী,ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, গুহ্যকালী,মহাকালী, চামুণ্ডা ইত্যাদি।মুলত এগুলো গাহস্থ্য ও সাধন অধিষ্ঠাত্রী নাম মিশ্রিত। তবে ধারাক্রমে বিভিন্ন তন্ত্র শাস্ত্র ও পুরানমতে ক্রমানুক্রমে কালীরগাহস্থ্য (সমাজে প্রচলিত রুপ) রুপধারা গুলো হলো
১) দক্ষিনাকালীঃ (সর্বকালে সর্বদেশের সমাজে পুজিতা) মুলত দেবীর প্রধান রুপ।তার পুজাবিধির মধ্যে কয়েকটি লাইন পরিবর্তন করে অন্যদেবীর পুজা হয়, ভৈরব, বটুক এবং শবরুপি শিব একই থাকে, শুধু নামের পরিবর্তন হয়।ইনিই কালীর প্রধান রুপ।
২) ভদ্রাকালীঃ (পাতালের দেবী, তবে বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে ইনি পুজিতা হন, তবে ভদ্রাকালী যেহেতু পাতাল কালি, তিনি নিজ থেকে পাতাল থেকে উঠে না এলে মানুষের পক্ষে তার পুজা করা সম্ভব নয়, যেমন, চট্টগ্রামের নলুয়া কালীবাড়ি, ইনি ভদ্রাকালী স্থান ভেদে এই কালী মহাকালী নামেও পরিচিত। তবে ভদ্রাকালী ও মহাকালী এক, কারন উভয়ের পুজা ধ্যানমন্ত্র এক
৩) রক্ষাকালীঃ রক্ষাকালী দক্ষিনাকালীর একটি নাগরিক রুপ।প্রাচীন কালে নগর বা লোকালয়ের রক্ষার জন্য এই দেবীর পুজা করা হতো। এই দেবীর পুজা মন্ত্র ভিন্ন এবং ইনার বাহন স্থানভেদে সিংহ
৪) রটন্তিকালীঃ পুত্র সন্তান কামনায় বিশেষ ভাবে এই দেবীর পুজা করা হয়, এছাড়া ধন বৃদ্ধির জন্যও ইনি বছরের একটি বিশেষ অমাবস্যায় পুজিত হন।শাস্ত্রানুযায়ী মাঘ মাসের কৃষ্ণাচতুর্দশী তিথির নামই হলো রটন্তি, এইদিন সন্ধায় তার পুজা করতে হয়।
৫) ফলহারিনী কালীঃ গৃহ ধর্মকে সুন্দর করতে এই দেবীর আবির্ভাব, নামে ফলহারিনী হলেও অভিষ্ট সিদ্ধ দায়িনি,জানা যায় রামপ্রসাদ নিজ স্ত্রীকে এই দিন দেবীরুপে পুজা করে নারী জাতীর সম্মানের জন্য এর ফল উৎসর্গ করেন।এটিও বাৎসরিক একটি পুজা।
৬) নিশাকালীঃ নিশাকালী নিয়ে মতভেদ আছেবলা হয়ে থাকে ইনি জেলেদের রক্ষাকারী, দুর্যোগময় রাতে জেলেরা সমুদ্রে গেলে তার পুজা করে যেতেন, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য তার চরন ছোয়া ফুল যে নৌকায় থাকতো সেই নৌকা কদাচিৎ ডুবতোই না। এছাড়া আধিভৌতিক ভীতি কাটানোর জন্যওএই দেবী প্রসিদ্ধ। আবার অন্যমতভেদও আছেকোন এক সময় এক গ্রামের কয়েকটি জেলে পুরুষ নৌকা নিয়ে বের হয়ে যাবার পর প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়।সেই সময় সকল জেলে পত্নী তাদের স্বামীর জন্য দেবী মন্দিরে উপস্থিত হয়ে প্রার্থনা করতে থাকে, সেই সময় একজন বৃদ্ধা
এসে তাদের নিশাকালীর মাহাত্ম্য কথা বলে তাদের বলেন, যে কুলে স্বয়ং দেবী জন্ম নিয়েছিলেন, সেই কুলের রুক্ষাকর্ত্রী দেবী নিজেই, তাই তার রুপ নিশাকালীর ব্রত করো, তিনিই দুর্যোগময় রাতে তোমাদের পতিদের রক্ষা করবেন, সেই থেকে জেলেকুলে ধুমধামের সাথে দেবীর স্থান হলেও কালক্রমে নিশাকালীর পুজা প্রথা বিলীন হয়ে যায়, কিন্তু স্থানভেদে কিছু জায়গায় এখনো তার পুজা বিদ্যমান।
৭) কাম্যকালীঃআমাদের বিশেষ কামনায় বা বিশেষ প্রার্থনায় যে কালীপুজা আয়োজন করা হয়, তাকেই কাম্যকালী পুজা বলা হয়, পুজা বিধি দক্ষিনাকালীর মতই।সাধারনত অষ্টমী, চতুর্দ্দশী অমাবস্যা পুর্ণিমা ও সংক্রান্তিকে পর্বদিন বলে।পর্বসমুহের মধ্যে অমাবস্যাকে বলা হয় মহাপর্ব। বিশেষ কামনায় এই সকল তিথিতে যে পুজা করা হয় তাকেই কাম্যকালী পুজা বলা হয়।
৮) শ্মশান কালীঃ শ্মশানের অধিষ্ঠাত্রী দেবীই হলেন শ্মশানকালী।তার পুজাবিধি একটু অন্যপ্রকার। সাধারনত বলা হয়ে থাকে যে গৃহীদের জন্য এই দেবীর পুজা নিষিদ্ধ।সেই সকল গৃহীই তার পুজা করতে পারে, যে শশ্বানে তাদের পরিবারের দেহ রাখা হয়েছে এবং শুধুমাত্র সেই শ্মশানকালীর পুজা তারা করতে পারেন। কিন্তু সব শ্মশানেই শ্মশানকালী থাকে না।ছোট ছোট শ্বশান মিলে একটি মহাশ্বশান হয়, আর কয়েকটি মহাশ্বশান নিয়েই শ্বশানপীঠ হয়, এই পীঠেই দেবী অবস্থান করেন।
Kali is a Hindu Goddess who would be hard to ignore!