রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প
বিচিত্র ও বিষ্ময়কর প্রতিভার অধিকারী, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল বিশ্ব কবি, বাংলা ছোট গল্পের জনক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।তার ছোট গল্পে প্রকৃতি ও মানব জীবনের যে বৈচিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তা অভুতপূর্ব।মানব মনের ভাবনা ও নিসর্গ চেতনা আপন ভুবনে তুলির আঁচড়ে অঙ্কন করেছেন। তার গল্প ধারার একটা বড় অংশই মানুষ ও প্রকৃতির অন্তরঙ্গ মেলবন্ধন।
তেমনি তার ছোট গল্পে উঠে এসেছে পল্লি বাংলার সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ, বেদনার প্রতিচ্ছবি। তার তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ও জীবন ঘনিষ্ঠ ভাবনায় নানান ভাবে, নানান রুপে প্রকাশ পেয়েছে মানব জীবনে বৈচিত্যময় অনুভুতি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আপন শিল্পগত সততা ও গভীর মমত্ববোধের উপর দাড়িয়েঁ আছে বাঙলা সাহিত্যে ছোট গল্পের স্বীকার্যতা। মানুষের প্রতি গভীর প্রেম, প্রকৃতির প্রতি নিবিড় আকর্ষণ দু'য়ে এক হয়ে তার ছোট গল্পকে করে তুলেছে মহিমান্বিত। তার প্রত্যেকটি ছোটগল্প যেন ঘনিষ্ঠভাবে স্বদেশ ও স্বকাল লগ্ন।
সাথে সাথে সর্বকালের সর্বমানুষের মানব ভাবনার প্রকাশ স্থল। জীবন বোধের সততা ও অনুভুতির গভীরতা অতিক্রম করেছে দেশ কালের গন্ডি। প্রতিটি গল্পের অন্তরালে পাওয়া যায় লেখকের জীবন ও শিল্পের উপলব্ধি। একটি সার্থক ছোট গল্পের জন্য প্রয়োজন সহজ সরল মানব হৃদয়ের আন্তরিক গভীরতা ও সুখ-দুখ, হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ পূর্ণ দৈনিন্দন জীবনের চির নান্দনিক ইতিহাস।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ছোট গল্পে কলম ধরেছেন অতীত বিবেচনা, সামাজিক ভন্ডামি, মঙ্গলের নামে মিথ্যাচার, আদর্শের নামে ব্যবসাদারি এসব সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে। তার সার্থক সৃষ্টি গুলোর মধ্যে অন্যতম "হৈমন্তি"; "ছুটি";"পোষ্টমাস্টার"; "অপরিচিতা"; "মাল্যদান"; "কাবুলিওয়ালা"; "নিশীথে"; "সুভা" প্রভৃতি। অপরিচিতা গল্পটি সবুজ পত্রে প্রকাশের সময় সবুজপত্রের সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীকে তিনি লিখলেন- "আমাদের বর্তমান সাহিত্য মানুষকে গাল দেয় কারণ তাতে পৌরুষ নেই বরঞ্চ সেটা কাপুরুষেরই কাজ। কিন্তু যেখানে যথাই বীর্যের দরকার সেখানে দেখতে পাই বড় বড় সাহিত্যিক পান্ডারা কেবল পোষা কুকুরের মত ল্যাজ নাড়ছে আর সে বৃদ্ধ পাপের পঙ্কিল পা আদর করে চেটে দিচ্ছে" (চিঠিপত্র-৫, পত্র-৫)।
পল্রি থেকে শুরু করে ঘরোয়া জীবনের সুখ-দুঃখ ও আশা নিরাশার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে। গল্পকার হিসাবে আমরা দেখতে পাই তার চিন্তা চেতনা যেমন তীক্ষ্ম, পর্যবেক্ষন শক্তি তেমন প্রখর, উচ্চারনের ভাষা প্রতিবাদী। এসব দিক তার সমস্ত গল্পে নানাভাবে ও নানা রুপে প্রকাশ পেয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আনোয়ার পাশা বলেছেন- "রবীন্দ্রনাথ তার গল্পে কোন প্রকার ঐতিহাসিক বা ঔপনিবেশিক বিড়ম্বনায় সাধারণত যান নি, তার গল্পের বিষয় হচ্ছে ক্ষুদ্র সুখ-দুখ পূর্ণ মানবের দৈনিন্দন জীবন"। তাই বলে সহজ সরল মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখকে নিয়ে তিনি কোন অলৌকিক সৌন্দর্যলোকের সন্ধান করেন নি। তার গল্পে তিনি মাটি ও মানুষের কাছাকাছি থেকে গ্রাম বাংলার প্রকৃতি ও সাধারণ মানুষকে প্রত্যাক্স করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ তার বেশ কিছু গল্পে পিতৃহৃদয়ের অভিব্যক্তি, সহজাত প্রবৃত্তি, স্নেহ ভালবাসা, সুখ-স্মৃতি অতি নিখুতভাবে তুরে ধরেচেন। "কাবুলিওয়ালা" গল্পে অত্যান্ত সুন্দরভাবে পিতৃহৃদয়ের শোকাহত ও চিরন্তন রূপটিকে উন্মোচন করেছেন। এ গল্পে শাশ্বত পিতৃহৃদয়ের জয় জয়কার ধ্বনিত হয়েছে। "দেনা পাওনা" গল্পে লেখক একজন পিতার অসহায়ত্ব, নির্যাতিত, অপমানিত ও লাঞ্ছিত জীবনের ছবি এঁকেছেন। "অপরিচিতা" গল্পে আমরা একজন ব্যতিক্রমী কন্যার পিতাকে পাই। "হৈমন্তি" গল্পে আমরা খুজে পাই একজন অসহায় পিতার মর্মবেদনা।
১৮৯১ সালে তিনি যখন স্থায়ীভাবে জমিদারি পরিচালনার ভার গ্রহন করেন, তখন থেকে তার সাথে বাংলার দেহ মনের সম্পর্ক নিবিড় হয়ে ওঠে। আর এ সমস্ত রবীন্দ্রনাথের বেশির ভাগ ছোটগল্প রচিত। তাই তো তার ছোট গল্পে আমাদের কর্মময় ব্যস্ত পৃথিবীর এক নিভৃত প্রান্তবাসী শান্ত বাঙালির জীবন রুপটি যথার্থ রূপে প্রকাশিত হয়েছে। তাই বলা চলে ছোট গল্পে অজস্র বর্ণনায় বাংলার গ্রাম জবিন যেমন সার্থকভাবে ফুটেছে তেমন আর কোথাও সার্থক ভাবে প্রকাশ পেয়েছে মনে হয় না। বাংলাদেশের প্রকৃতি যেমন বিচিত্র তেমনি মানুষগুলো বৈচিত্র সৌন্দর্য নিযে তার ছোট গল্প গুলো আবিভুত হয়েছে। সাথে সাথে বাঙালি জীবনের খুটিনাটি ধরা পড়েছে তার ছোট গল্প সম্ভারে।
সমাজের সবৃস্তরের মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, বিরহ-বেদনা স্থান পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে। বিশেষ করে তিনি বিচিত্রিত করেছেন তার কলমের সুক্ষ্ম আঁচড় দিয়ে বাংলার সর্বস্তরের নালী জীবনের লাঞ্ছনা, গঞ্জনা নিপীড়ন। "দেনা পাওনা" গল্পের নিরুপমা চরিত্রটির মধ্য দিযে একদিকে সমাজের প্রতি ধিক্কার এবং নারী হৃদয়ের অন্তবেদনা প্রকাশিত হয়েছে। "সুভা" গল্পে যে জীবনকে আমরা প্রত্যাক্ষ করেছি তা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনা, সুভা মেয়েটি মূক, তার ভাষা বোঝে পশুপাখি, গাছপালা, অর্থাৎ তারই মত যারা মূক।
এ মেয়েটি তার চিরচেনা পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিয়ে দেওয়ার ফলে তার জীবনে নেমে আসে করুন পরিণতি। কিছুদিনের মধ্যেই চোখে পড়ল সুভা ভাষাহীন। আলোচ্য গল্পে লেখক একজন ভাষাহীন নারীর আত্নিক যন্ত্রনাকে প্রকাশ করেছেন। "অপরিচিতা" গল্পে কল্যানী এবং "মানভঞ্জন" গল্পের গিরিবালার জীবনের করুণ কাহিনী সকল শ্রেনির পাঠক চিত্তকে সমভাবে সিক্ত করে তোলে।
স্বামীর অন্যায় আচরণে নারী কিভাবে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে তার উজ্জল দৃষ্টান্ত "মানভঞ্জন" গল্পের নায়িকা গিরিবালা। "মাল্যদান" গল্পটিতে সরল হৃদয়ের বালিকা কুড়ানির সংকোচহীন হৃদয়ে নতুন প্রেমোন্মেষের রমনীয় ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। একজন নারী কিভাবে সমাজের অনিয়মে পড়ে নিঃশেষ হয়ে শেষে মৃত্যুর মুখে নিজেকে সপে দিয়েছে তারই এক করুন কাহিনী চিত্রিত হয়েছে "মহামায়া"গল্পে।
মানুষের সুখ-দুঃখের সাথে প্রকৃতির দারুণ সদভাব লক্ষ্র করা যায়। সুখে-দুঃখে প্রকৃতি যেন মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় "প্রকৃতি যেন তাহার ভাষার অভাব পূরণ করিয়া দেয়। যেন তাহার হইয়া কথা কয়। নদীর কল কল ধ্বনি মাঝির গান, পাখির ডাক, তরুর মর্মর ধ্বনি সমস্ত মিশিয়া চারিদিকের চলাফেরা আনন্দোলন কম্পনের সহিত এক হইয়া সমুদ্রের তরঙ্গ রাশির ন্যায় বালিকার চিরনিস্তব্ধ হৃদয় উপকূলের নিকটে আসিয়া ভাঙ্গিয়া আছড়িয়া পড়ে"। প্রকৃতির এই বিবিধ শব্দ এক বিচিত্র গতি তাও বোবার ভাষা, ঝিল্লির পূর্ণতৃণ ভূমি থেকে শব্দাতীত নক্ষত্রলোক পর্যন্ত কেবল ইঙ্গিত ভাষ্য, সংগীত, ক্রন্দন এবং দীর্ঘশ্বাস। বৃহৎ প্রকৃতি একটা বিরাট রহস্যে ঘেরা তার বাক্যহীনতায়।
"নিশীথে" গল্পে দক্ষিণাচারণ বাবু তার প্রথম স্ত্রী মনোরমাকে যতেষ্ট ভালোবাসতেন। একদিন জোছনারাতে বকুল তলায় নিস্তব্ধতায় তারা নীরবে বসেছিল। লেখকের ভাষায়- "দু'টি একটি একটি করিয়া প্রস্ফুট বকুল ফুল ঝরিতে লাগিল এবং শাখান্তরাল হইতে ছায়াঙ্কিত জোছনা তাহার শীর্ণ মুখে আসিয়া পড়িল"।
চারিদিকে শান্ত নিস্তব্ধ সে ছায়ান্ধকারে এক পার্শ্বে নীরবে বসে দক্ষিণাচারণ বাবু তার স্ত্রীকে আবেগে বিহবল কন্ঠে বলেছিল- "তোমার ভালবাসা আমি কোন কালেও ভুলিব না"। "মাল্যদান" গল্পের মধ্যেও প্রকৃতির সজীব উপস্থিতি অনুভব যোগ্য"। "খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন" গল্পটিতে ট্রাজেডির মুলে ছিল প্রকৃতির প্রতি শিশুমনের প্রবল আকর্ষণ। প্রকৃতির বর্ণনা আছে "সম্পত্তি সমর্পন"; "কাবুলিওয়ালা"; "পোষ্টমাস্টার" গল্পেও।
সমালোচকের মতে, রবীন্দ্রনাথ তার ছোট গল্পে কল্পনার বেগ সামলাতে না পেরে বাস্তব ছেড়ে কল্পনাতে বিলীন হয়ে গেছেন। কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ন ভুল। গল্পগুলো গড়ে উঠেছে আমাদের প্রত্যাহিক জীবনকে আশ্রয় করে। গোটা বাঙালিকে পাওয়া যায় তার ছোট গল্পে। শুধুমাত্র কল্পনা নয় মানব জীবনের নানা রকম ছোটখাট সংঘাত ও ভাললাগা ভালবাসার প্রতিফলন খুজে পাওয়া যায় তার গল্পে। এখানে বর্ণনা একেবারে জীবন্ত, শুধু বাস্তব ব্যঞ্জনায়ই নয়। পাতায় পাতায় শোনা যায় তার হৃদয় স্পন্দন।
ঋতু বৈচিত্র্য, প্রাণ প্রতিম নদী স্রোত, বিশাল প্রান্তর, বাঁশবন, চন্ডিমন্ডপ, রথতলা, দুরন্ত কল্লোলে উৎসারিত পল্লি প্রাণ, বালক-বালিকা, বুদ্ধিমতি গৃহিনী, উনবিংশ শতাব্দীর আধুনিকতার সুখ-দুখ, ব্যাথা-বেদনা, ব্যার্থতা ধরা পড়েছে তার ছোট গল্পে। গ্রাম বাংলার জীবনকে তুলে ধরেছেন তার কলমের নিখুত আঁচড়ে। রবীন্দ্রনাথের এ শ্রেনির গল্পগুলো একান্ত ভাবে গীতিধমী।
যে রবীন্দ্র সাহিত্যে মানুষের জীবন ও প্রকৃতির ব্যবহার বিচিত্র ও বহুল, সেখানে বিশেষ করে তার ছোট গল্পে প্রকৃতি ও মানুষের জীবনের বিচিত্র ছবি অংকিত হয়েছে আপন মহিমায়। এখানে শিল্পরূপ প্রকাশ পেয়েছে মানব জীবনের প্রত্যাহিক জীবন আচরণে। বস্তুত তার ছোট গল্পে বাঙালির জীবন পরিবেশ প্রকৃতি ও পারিবারিক জীবনের যে বৈচিত্র প্রকাশ পেয়েছে তা সত্যি বিষ্ময়কর।
বাংলা ছোটগল্পের সর্ব প্রথম সার্থক স্রষ্ঠা, বাংলা ছোট গল্পের জনক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার ছোট গল্প সমুহে বিষয় বৈচিত্র্য, সমাজ বাস্তবতায়, জবিন ঘনিষ্ঠতায়, চরিত্র চিত্রনে, মনুষত্ত্ব বিশ্লেষণে যতটা সার্থকতার পরিচয় দিয়েছন অন্য কোন লেখক তৎপূর্বে ততটা সার্থক হতে পারেন নি। লেখক তার ছোট গল্প সম্পর্কে সোনার তরী কাব্যের বর্ষা যাপন কবিতায় বলেছেন- "ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যাথা/ ছোটো ছোটো দুঃখ কথা/ নিতান্তই সহজ সরল/ সহস্র বিষ্মৃতিরাশি/ প্রত্যাহ যেতেছে ভাসি/ তারই দু-চারটি অশ্রুজল"।
সত্যই জীবনের বহুবিধ রূপ বর্ণনার সার্থক শিল্পি, মানব মনো-বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে তার ছোটগল্পে সঠিক ধারার রূপায়ন ঘটিয়েছেন। সাধারণ বাস্তবতা ও ব্যক্তি মানুষের অন্তবেদনার এক মনোরম বহিঃপ্রকাশ তার ছোট গল্পে। একজন সার্থক শিল্পির মত জীবনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষের অনুভুতির সুক্ষ বিষয় গুলোকে অত্যান্ত নিখুত ভাবে শিল্পিত করেছেন। বিশেষ করে নারীর চাওয়া পাওয়া ভাললাগা, মন্দলাগা, তথা মনো-বিশ্লেষনে তিনি একজন দক্ষ শিল্পি। তার ছোট গল্পের নারী চরিত্র গুলো আমাদের সদা জাগ্রত চির চেনা জগতের বাসিন্দা, আমাদের একান্ত কাছের আপনজন। বাঙালি নারী সমাজের নিপীড়নের নানা চিত্র শিল্পিত রূপে প্রকাশ করেছেন।
বাংলা সাহিত্রের বহু বিশেষনে বিশেষিত বাংলা ছোটগল্পের রূপকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুল বিষয় বাস্বব জীবন ও সমাজ সংসারের আলেখ্য। পল্লি গ্রাম বাংলায় বেড়ে ওঠা অতি সাধারণ ভাবে যে সব মানুষের চিত্র আঁকা হয়েছে তাদের সবাই আমাদের প্রতিবেশী হিসাবে পাঠক অবলীলায় মেনে নেয়। বিশেষ করে নারী জীবন, বাস্তবতার স্পর্শে মহিমান্বিত রূপে আত্ন প্রকাশ করেছে। গ্রাম্য বিধবা, গৃহবধু, কুমারী, বাল্যবধু, তরুণী প্রভৃতির সমাবেশ গল্পগুলো অবিসংবেদীরূপে প্রত্যাক্ষধমী হয়ে উঠেছে। 'দেনাপাওনা'র নিরূপমা; 'মানভঞ্জনে'র গিরিবালা; 'মহামায়া' গল্পের মহামায়া; 'মাল্যদান' গল্পের কুড়ানি; 'সুভা' গল্পের সুভা আমাদের সবাইর অতি পরিচিত নারী চরিত্র। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে প্রত্যেকটি নারী চরিত্রই স্ব-মহিমায় ভাস্বর।
"মহামায়া" গল্পে নায়িকা মহামায়া নারী চরিত্রের পল্লি বাংলার একেবারে নিকটতম উজ্জ্বল চরিত্র। মহামায়ার প্রেম তার নারী জীবনের স্বভাব ফসল, তবে সে প্রেম ও ব্যক্তিত্ব গৌরব তথা অহমিকা বোধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কৌলিন্য সহমরণ বিধস্ত যুগে মহামায়া একজনকে প্রেমের ডোরে বেধেছিল বলেই তার নারীত্ব স্বাতন্ত্র্য লাভ করে নি। হৃদয় স্বাতন্ত্র্যের জন্যই সে প্রেমিকাকে প্রত্যাখান করেছ। কারণ প্রেমে নয়, পেমিকার কৃপাধন্য হয়ে নয় এই নিরাশ্রয় কুরুপাকে দয়া করে রাজীব আশ্রায় দিয়েছে। রাজীবের ভালবাসায় করুণা মিশেছে এরূপ গৌরবনাশী ভাবনা মহামায়াকে ভীষণ আহত করেছিল। তার নিরব চির বিদায় ব্যাক্তি শান্তির চুড়ান্ত বিষ্ফোরণ ঘটেছে। বাংলা ছোট গল্পে এমন ব্যক্তিত্বময়ী নারী চরিত্র দুর্লভ।
"কাবুলিওয়ালা" গল্পে মিনি চরিত্রের ক্রম-বিবর্তনকে রবীন্দ্রনাথ চিরন্তন করে তুলেছেন। আট বছর পর জেল থেকে ফিরে এসে রহমত দেখে মিনি বেশ বড় হয়ে গেছে। বয়ঃসন্ধিক্ষনের লজ্জার কারণে মিনি দীর্ঘদিন পর কাবুলিওয়ালার সাথে আর আগের মত মিশতে পারেনি। এ যেন ময়মনসিংহ গীতিকার সেই "লজ্জারক্ত হইল কইনার পরথম যৌবন"।
"দেনাপাওনা" গল্পের মধ্যে আমরা লক্ষ্য করি পনপ্রথা ও পরিবারের অমানুষিক অত্যাচারে ক্ষয়ে যাওয়া একটি নারী চরিত্রকে। স্নেহশীল পিতা রামসুন্দর নিরুপমার বিয়ে দেন বনেদি ঘরের রায় বাহাদুরের একমাত্র পুত্রের সাথে। কিন্তু নিষ্ঠুর পনের টাকা শোধ করতে না পারায় শাশুড়ির অত্যাচারে নিরুপমা প্রাণহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু ব্যাক্তি স্বাতন্ত্র্য বিসজন দিতে রাজি হয়নি কোন ভাবেই। যখন তার পিতা সব সহায় সম্বল বিক্রি করে পণের টাকা শোধ করতে যায় তখন নিরুপমা বাধা দেয়। তার ভাষায়- "আমি কী শুধু টাকার থলি; যতক্ষন টাকা আছে ততক্ষন আমার দাম"। এ উক্তির মধ্য দিয়ে আমরা নিরুপমা চরিত্রের কঠোর ব্যক্তিত্ব ও প্রতিবাদী রূপটি দেখতে পাই।
সমাজের একেবারে নিচ থেকে লেখক তার চরিত্রগুলোকে চিত্রন করেছেন। "সুভা" গল্পের সুভা চরিত্র তার উজ্জলতম নির্দশন। সুভা প্রকৃতির মতই নির্বাক, মুক। প্রকৃতির সাথে তার অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠতা। তার নির্বাক মনের কথা সবাক মানুষেরা না বুঝলেও প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণী জগতের সাথে ছিল তার গভীর মিতালি। সভ্য সমাজে তাই সুভা'র স্থান হয়নি। বরপক্ষ যখন জানতে পারে সুভা কথা বলতে পারে না, তখন তার উপর নেমে এসেছে নীরব অত্যাচারের অবজ্ঞা। মুক হওয়াতে তার জীবন সমাজের কাছে অপরাধী। সুভা রবীন্দ্রনাথের এক অনন্য সৃষ্টি।
"নিশীথে" গল্পের নারী চরিত্রটিকে রবীন্দ্রনাথ অত্যান্ত শিল্প মন্ডিত করে গড়ে তুলেছেন। দক্ষিণাচরণ বাবুর প্রথম স্ত্রীর সাথে তার যে দাম্পত্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তা দক্ষিণাচরণ বাবুর কাছে অমর। একদিন এক আবেগঘন মুহুর্তে দক্ষিণাচরণ বাবু তার স্ত্রীকে কথা দিয়েছিল সে তাকে কোনদিন ভুলে যাবে না। কিন্তু কাল ক্রমে স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে তার জীবদ্দশাতেই দক্ষিণাচরণ বাবু অন্য এক নারীর প্রেমে পড়ে। এ ঘটনায় প্রথম স্ত্রী এটিকে তার জন্য অপমান মনে করে বিষপান করে আত্নহত্যা করে। পুরুষের এ দ্বিমুখী চরিত্রের পাশে দক্ষিণাচরণ বাবুর প্রথম স্ত্রীর চরিত্রকে অত্যান্ত দক্ষতার সাথে নির্মান করেছেন আলচ্য গল্পে।
প্রতিবাদী নারী চরিত্রের অন্যতম নারী "মানভঞ্জন" গল্পের নায়িকা গিরিবালা। অন্যান্য নারীর মত গিরিবালা স্বামীর অবজ্ঞা নিরবে মেনে নিতে পারে নি। ঘরের কলবধু স্বামী দেবতার কোন আচরণেই কোন প্রতিবাদ করার অধিকার রাখে না। এমন কুসংস্কার পূর্ণ সমাজের বিরুদ্ধে সেকালর তীব্র প্রতিবাদী চরিত্র গিরিবালা। গিরিবালার স্বামী গোপীনাথ রঙ্গমঞ্চের অভিনেত্রীদের আকর্ষনে ঘরের স্ত্রীকে উপেক্ষা করে বাহিরে রাত কাটায়। গিরিবালা যখন একটি রাতের জন্যও স্বামীকে কাছে পায় না, বরং তাকে লাথি মেরে তার স্বামী যখন চলে যায়, তখন গিরিবালাও অভিনেত্রী রুপে তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে রঙ্গমঞ্চে গিয়ে যোগ দেয়। গিরিবালার স্বামীর বিরুদ্ধে গিয়ে শুধু নতুন জীবনে বাঁচার ক্ষেত্রই খুজে পায়নি, স্বীকৃতি ও সম্মান এবং স্বামীর পূর্ব জীবনের প্রতিশোধ নিতে পেরেছিল।
"অপরিচিতা" গল্পের নায়িকা কল্যানী আপন ভুবনে প্রজ্জলিত এক চরিত্র। পন প্রথার অমানবিক আচরণের প্রতিবাদ স্বরুপ পিতা শম্ভুনাথ নিজেই কল্যানীর বিয়ে ভেঙে দেয়। তারপর হঠাৎ একদিন ট্রেনের কামরায় সেদিনকার বরবেশী অনুপম এর সাথে কল্যানীর সাক্ষাৎ ঘটে। কল্যানীর অকপটে আনান্দজ্জল স্বভাবে পরিচয় পেয়ে অনুপম তাকে বিয়ে করার জন্য হাত জোড় করে, মাথা হেট করে মরেছে। কিন্তু সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। অনুপম কল্যানীর চরিত্র মাধুর্যে বাঁধা পড়ে কল্যানীর কাছাকাছি থেকে বাকি জীবন কাটিয়েছে।
"মাল্যদান" গল্পের অবহেলিত কুড়ানির চরিত্রের মধ্যে ব্যাক্তিত্বের চরম প্রকাশ ঘটেছে। যতীন তার বোন পটলের বাড়িতে গেলে পটল হাসির ছলে পরিহাসের মধ্যে তার সযত্ন লালিত কুড়ানিকে ডাক্তার যতীনের সাথে বিয়ের কথা বলে। একদিন পটল কুড়ানিকে দিয়ে যতীনের গলায় মালা পরিয়ে দেয়। যতীন লজ্জিত হয়ে বিরক্তিতে পটলের বাড়ী পরিত্যাগ করে। যতীন চলে যাওয়ার পর কুড়ানি একটু একটু করে ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যেতে থাকে। পটলের পরিহাস যতীনের অবহেলা কুড়ানির একাগ্রে প্রেম কুড়ানিকে শেষ পর্যন্ত জীবনের পরিনতিতে দাঁড় করায়। নিজের মনের ও শরীরের মধ্যে বড় রকমের একটা অসুস্থতাকে সম্বল করে কুড়ানি ঘর ছেড়ে পথে বের হয়। ভাগ্যক্রমে কুড়ানির সাথে আবার যতীনের দেখা হল।
কুড়ানি আজ রোগী, যতীন ডাক্তারের। যতীন কুড়ানিকে দেখে প্রথমত চমকে উঠেছিল। সংবাদ পেয়ে পটল এবং তার স্বামী তাদের কুড়িয়ে পাওয়া সন্তানতুল্য কুড়ানিকে নিতে এলেন। কুড়ানির আর ঘরে ফেরা হল না। হল না যতীনের ডাক্তারের স্ত্রী হয়ে সংসার রচনা করা। যতীনের প্রতি ভালবাসা তাকে মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে এনে দিল। যতীনের সাথে সাক্ষাতের সময় সে এক সময় কুড়ানির গলায় শুকনো সে বকুল ফুলের মালাটি দেখতে পেল। সে মুহুর্তে আর বুঝতে বাকি রইল না যে কুড়ানি যতীনের সে মালাটিকে জীবনের একমাত্র সম্বল করে পথে বেরিয়েছে।
কুড়ানির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নারীত্বের আদর্শ রক্ষিত হয়েছে। পটলের সামান্য ভুল এবং যতীনের অবহেলা কুড়ানিকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে গেছে।
"একরাত্রি" গল্পের নারী চরিত্র সুরবালার সমস্ত জীবনের নিশ্চুপ প্রেমের ব্যর্থতার হাহাকার। পুরুষ শাসিত সমাজ সুরবালার প্রেমকে অবহেলা করার চিত্র অংকন করেছেন। সুরবালার বিয়ে হয়েছে, তবে তার প্রেমিকের সাথে নয়, অন্যের সাথে। অন্যের বিবাহিতা স্ত্রী হওয়া সত্বেও আজও সে তার প্রেমিকেরই হৃদয় হয়ে আছে। ভুলে যেতে পারেনি তার প্রেমকে। তাই তো তার প্রেমিক মন বার বার ছুটে যেতে চেয়েছে ঘর সংসার ছেড়ে প্রিয়জনের কাছে। কিন্তু সমাজ তার বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে। সে সমাজের যাতাকলে পড়ে কুরে কুরে মরেছে।
"কঙ্কাল" গল্পে অকাল বিধবা কনকচাঁপা যৌবনবতী হয়েছে বৈধব্যের পরে।তার বিযে হয় তার বয়ঃসন্ধিকালের পূর্বে। সে যখন ঘর সংসার এমনকী বিয়ে কী তা বুঝত না তখন তাকে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়েছ। এ দিকে সে যৌবনবতী হওয়ার আগেই তার স্বামী মারা যায় এবং সে বিধবা হয়। তার মনে যখন পরিপূর্ন যৌবন তখন সে বৈধব্যের বোঝা বহন করে নিয়ে বেড়াচ্ছে। যদিওবা দার চোখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার ভাইয়ের বন্ধু শশী শেখর। ভাইয়ের বন্ধু শশী শেখরের প্রতি প্রণয়াসক্ত হলেও বিধবা হওয়ার কারণেই সমাজ সংসারের প্রচালিত নিয়মের যাতাকলে চাপা পড়ে ব্যার্থ হয়ে তাদের বিয়ে হয়নি। এখানে লেখক তৎকালীন হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার যে কি ভয়ানক রূপের কারণে একটা জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে তার বর্ণনা করেছেন।
"শাস্তি" গল্পের চন্দরা চরিত্রের মাধ্যমে সমাজের নির্যাতনের বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। সংসারের গৃহবন্দি নারীর অভাবের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন। অভাবের তাড়নায় স্বামী দুঃখীরামের হাতে তাকে জীবন দিতে হয়েছে। পুরুষ শাসিত সমাজে নারী হয়েছে হাতের পুতুল।
বাংলা ছোটগল্পের জনক রবীন্দ্রনাথ তার ছোটগল্পে যে সব নারী চরিত্রের অতারণা করেছেন সেগুলো কোন কল্পিত চরিত্র নয়। এরা সবাই যেন এ সমাজেরই লোক যেন আমাদের অতি পরিচিতি আপনজন। নারীর ভাললাগা, মন্দলাগা ও তাদের সুখ দুঃখের সঙ্গী হয়ে অত্যান্ত দরদি মন নিয়ে তিনি তার ছোট গল্পের নারী চরিত্রগুলো বির্নিমান করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গল্পে নারী চরিত্রগুলো পুরুষ চরিত্রের তুলনায় স্বতন্ত্র ও উজ্জল। রবীন্দ্রনাথ মনস্তত্ব বিশ্লেষনে একজন সফল শিল্পির পরিচয় দিয়েছেন।
তেমনি তার ছোট গল্পে উঠে এসেছে পল্লি বাংলার সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ, বেদনার প্রতিচ্ছবি। তার তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ও জীবন ঘনিষ্ঠ ভাবনায় নানান ভাবে, নানান রুপে প্রকাশ পেয়েছে মানব জীবনে বৈচিত্যময় অনুভুতি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আপন শিল্পগত সততা ও গভীর মমত্ববোধের উপর দাড়িয়েঁ আছে বাঙলা সাহিত্যে ছোট গল্পের স্বীকার্যতা। মানুষের প্রতি গভীর প্রেম, প্রকৃতির প্রতি নিবিড় আকর্ষণ দু'য়ে এক হয়ে তার ছোট গল্পকে করে তুলেছে মহিমান্বিত। তার প্রত্যেকটি ছোটগল্প যেন ঘনিষ্ঠভাবে স্বদেশ ও স্বকাল লগ্ন।
সাথে সাথে সর্বকালের সর্বমানুষের মানব ভাবনার প্রকাশ স্থল। জীবন বোধের সততা ও অনুভুতির গভীরতা অতিক্রম করেছে দেশ কালের গন্ডি। প্রতিটি গল্পের অন্তরালে পাওয়া যায় লেখকের জীবন ও শিল্পের উপলব্ধি। একটি সার্থক ছোট গল্পের জন্য প্রয়োজন সহজ সরল মানব হৃদয়ের আন্তরিক গভীরতা ও সুখ-দুখ, হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ পূর্ণ দৈনিন্দন জীবনের চির নান্দনিক ইতিহাস।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ছোট গল্পে কলম ধরেছেন অতীত বিবেচনা, সামাজিক ভন্ডামি, মঙ্গলের নামে মিথ্যাচার, আদর্শের নামে ব্যবসাদারি এসব সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে। তার সার্থক সৃষ্টি গুলোর মধ্যে অন্যতম "হৈমন্তি"; "ছুটি";"পোষ্টমাস্টার"; "অপরিচিতা"; "মাল্যদান"; "কাবুলিওয়ালা"; "নিশীথে"; "সুভা" প্রভৃতি। অপরিচিতা গল্পটি সবুজ পত্রে প্রকাশের সময় সবুজপত্রের সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীকে তিনি লিখলেন- "আমাদের বর্তমান সাহিত্য মানুষকে গাল দেয় কারণ তাতে পৌরুষ নেই বরঞ্চ সেটা কাপুরুষেরই কাজ। কিন্তু যেখানে যথাই বীর্যের দরকার সেখানে দেখতে পাই বড় বড় সাহিত্যিক পান্ডারা কেবল পোষা কুকুরের মত ল্যাজ নাড়ছে আর সে বৃদ্ধ পাপের পঙ্কিল পা আদর করে চেটে দিচ্ছে" (চিঠিপত্র-৫, পত্র-৫)।
পল্রি থেকে শুরু করে ঘরোয়া জীবনের সুখ-দুঃখ ও আশা নিরাশার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে। গল্পকার হিসাবে আমরা দেখতে পাই তার চিন্তা চেতনা যেমন তীক্ষ্ম, পর্যবেক্ষন শক্তি তেমন প্রখর, উচ্চারনের ভাষা প্রতিবাদী। এসব দিক তার সমস্ত গল্পে নানাভাবে ও নানা রুপে প্রকাশ পেয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আনোয়ার পাশা বলেছেন- "রবীন্দ্রনাথ তার গল্পে কোন প্রকার ঐতিহাসিক বা ঔপনিবেশিক বিড়ম্বনায় সাধারণত যান নি, তার গল্পের বিষয় হচ্ছে ক্ষুদ্র সুখ-দুখ পূর্ণ মানবের দৈনিন্দন জীবন"। তাই বলে সহজ সরল মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখকে নিয়ে তিনি কোন অলৌকিক সৌন্দর্যলোকের সন্ধান করেন নি। তার গল্পে তিনি মাটি ও মানুষের কাছাকাছি থেকে গ্রাম বাংলার প্রকৃতি ও সাধারণ মানুষকে প্রত্যাক্স করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ তার বেশ কিছু গল্পে পিতৃহৃদয়ের অভিব্যক্তি, সহজাত প্রবৃত্তি, স্নেহ ভালবাসা, সুখ-স্মৃতি অতি নিখুতভাবে তুরে ধরেচেন। "কাবুলিওয়ালা" গল্পে অত্যান্ত সুন্দরভাবে পিতৃহৃদয়ের শোকাহত ও চিরন্তন রূপটিকে উন্মোচন করেছেন। এ গল্পে শাশ্বত পিতৃহৃদয়ের জয় জয়কার ধ্বনিত হয়েছে। "দেনা পাওনা" গল্পে লেখক একজন পিতার অসহায়ত্ব, নির্যাতিত, অপমানিত ও লাঞ্ছিত জীবনের ছবি এঁকেছেন। "অপরিচিতা" গল্পে আমরা একজন ব্যতিক্রমী কন্যার পিতাকে পাই। "হৈমন্তি" গল্পে আমরা খুজে পাই একজন অসহায় পিতার মর্মবেদনা।
১৮৯১ সালে তিনি যখন স্থায়ীভাবে জমিদারি পরিচালনার ভার গ্রহন করেন, তখন থেকে তার সাথে বাংলার দেহ মনের সম্পর্ক নিবিড় হয়ে ওঠে। আর এ সমস্ত রবীন্দ্রনাথের বেশির ভাগ ছোটগল্প রচিত। তাই তো তার ছোট গল্পে আমাদের কর্মময় ব্যস্ত পৃথিবীর এক নিভৃত প্রান্তবাসী শান্ত বাঙালির জীবন রুপটি যথার্থ রূপে প্রকাশিত হয়েছে। তাই বলা চলে ছোট গল্পে অজস্র বর্ণনায় বাংলার গ্রাম জবিন যেমন সার্থকভাবে ফুটেছে তেমন আর কোথাও সার্থক ভাবে প্রকাশ পেয়েছে মনে হয় না। বাংলাদেশের প্রকৃতি যেমন বিচিত্র তেমনি মানুষগুলো বৈচিত্র সৌন্দর্য নিযে তার ছোট গল্প গুলো আবিভুত হয়েছে। সাথে সাথে বাঙালি জীবনের খুটিনাটি ধরা পড়েছে তার ছোট গল্প সম্ভারে।
সমাজের সবৃস্তরের মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, বিরহ-বেদনা স্থান পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে। বিশেষ করে তিনি বিচিত্রিত করেছেন তার কলমের সুক্ষ্ম আঁচড় দিয়ে বাংলার সর্বস্তরের নালী জীবনের লাঞ্ছনা, গঞ্জনা নিপীড়ন। "দেনা পাওনা" গল্পের নিরুপমা চরিত্রটির মধ্য দিযে একদিকে সমাজের প্রতি ধিক্কার এবং নারী হৃদয়ের অন্তবেদনা প্রকাশিত হয়েছে। "সুভা" গল্পে যে জীবনকে আমরা প্রত্যাক্ষ করেছি তা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনা, সুভা মেয়েটি মূক, তার ভাষা বোঝে পশুপাখি, গাছপালা, অর্থাৎ তারই মত যারা মূক।
এ মেয়েটি তার চিরচেনা পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিয়ে দেওয়ার ফলে তার জীবনে নেমে আসে করুন পরিণতি। কিছুদিনের মধ্যেই চোখে পড়ল সুভা ভাষাহীন। আলোচ্য গল্পে লেখক একজন ভাষাহীন নারীর আত্নিক যন্ত্রনাকে প্রকাশ করেছেন। "অপরিচিতা" গল্পে কল্যানী এবং "মানভঞ্জন" গল্পের গিরিবালার জীবনের করুণ কাহিনী সকল শ্রেনির পাঠক চিত্তকে সমভাবে সিক্ত করে তোলে।
স্বামীর অন্যায় আচরণে নারী কিভাবে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে তার উজ্জল দৃষ্টান্ত "মানভঞ্জন" গল্পের নায়িকা গিরিবালা। "মাল্যদান" গল্পটিতে সরল হৃদয়ের বালিকা কুড়ানির সংকোচহীন হৃদয়ে নতুন প্রেমোন্মেষের রমনীয় ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। একজন নারী কিভাবে সমাজের অনিয়মে পড়ে নিঃশেষ হয়ে শেষে মৃত্যুর মুখে নিজেকে সপে দিয়েছে তারই এক করুন কাহিনী চিত্রিত হয়েছে "মহামায়া"গল্পে।
মানুষের সুখ-দুঃখের সাথে প্রকৃতির দারুণ সদভাব লক্ষ্র করা যায়। সুখে-দুঃখে প্রকৃতি যেন মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় "প্রকৃতি যেন তাহার ভাষার অভাব পূরণ করিয়া দেয়। যেন তাহার হইয়া কথা কয়। নদীর কল কল ধ্বনি মাঝির গান, পাখির ডাক, তরুর মর্মর ধ্বনি সমস্ত মিশিয়া চারিদিকের চলাফেরা আনন্দোলন কম্পনের সহিত এক হইয়া সমুদ্রের তরঙ্গ রাশির ন্যায় বালিকার চিরনিস্তব্ধ হৃদয় উপকূলের নিকটে আসিয়া ভাঙ্গিয়া আছড়িয়া পড়ে"। প্রকৃতির এই বিবিধ শব্দ এক বিচিত্র গতি তাও বোবার ভাষা, ঝিল্লির পূর্ণতৃণ ভূমি থেকে শব্দাতীত নক্ষত্রলোক পর্যন্ত কেবল ইঙ্গিত ভাষ্য, সংগীত, ক্রন্দন এবং দীর্ঘশ্বাস। বৃহৎ প্রকৃতি একটা বিরাট রহস্যে ঘেরা তার বাক্যহীনতায়।
"নিশীথে" গল্পে দক্ষিণাচারণ বাবু তার প্রথম স্ত্রী মনোরমাকে যতেষ্ট ভালোবাসতেন। একদিন জোছনারাতে বকুল তলায় নিস্তব্ধতায় তারা নীরবে বসেছিল। লেখকের ভাষায়- "দু'টি একটি একটি করিয়া প্রস্ফুট বকুল ফুল ঝরিতে লাগিল এবং শাখান্তরাল হইতে ছায়াঙ্কিত জোছনা তাহার শীর্ণ মুখে আসিয়া পড়িল"।
চারিদিকে শান্ত নিস্তব্ধ সে ছায়ান্ধকারে এক পার্শ্বে নীরবে বসে দক্ষিণাচারণ বাবু তার স্ত্রীকে আবেগে বিহবল কন্ঠে বলেছিল- "তোমার ভালবাসা আমি কোন কালেও ভুলিব না"। "মাল্যদান" গল্পের মধ্যেও প্রকৃতির সজীব উপস্থিতি অনুভব যোগ্য"। "খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন" গল্পটিতে ট্রাজেডির মুলে ছিল প্রকৃতির প্রতি শিশুমনের প্রবল আকর্ষণ। প্রকৃতির বর্ণনা আছে "সম্পত্তি সমর্পন"; "কাবুলিওয়ালা"; "পোষ্টমাস্টার" গল্পেও।
সমালোচকের মতে, রবীন্দ্রনাথ তার ছোট গল্পে কল্পনার বেগ সামলাতে না পেরে বাস্তব ছেড়ে কল্পনাতে বিলীন হয়ে গেছেন। কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ন ভুল। গল্পগুলো গড়ে উঠেছে আমাদের প্রত্যাহিক জীবনকে আশ্রয় করে। গোটা বাঙালিকে পাওয়া যায় তার ছোট গল্পে। শুধুমাত্র কল্পনা নয় মানব জীবনের নানা রকম ছোটখাট সংঘাত ও ভাললাগা ভালবাসার প্রতিফলন খুজে পাওয়া যায় তার গল্পে। এখানে বর্ণনা একেবারে জীবন্ত, শুধু বাস্তব ব্যঞ্জনায়ই নয়। পাতায় পাতায় শোনা যায় তার হৃদয় স্পন্দন।
ঋতু বৈচিত্র্য, প্রাণ প্রতিম নদী স্রোত, বিশাল প্রান্তর, বাঁশবন, চন্ডিমন্ডপ, রথতলা, দুরন্ত কল্লোলে উৎসারিত পল্লি প্রাণ, বালক-বালিকা, বুদ্ধিমতি গৃহিনী, উনবিংশ শতাব্দীর আধুনিকতার সুখ-দুখ, ব্যাথা-বেদনা, ব্যার্থতা ধরা পড়েছে তার ছোট গল্পে। গ্রাম বাংলার জীবনকে তুলে ধরেছেন তার কলমের নিখুত আঁচড়ে। রবীন্দ্রনাথের এ শ্রেনির গল্পগুলো একান্ত ভাবে গীতিধমী।
যে রবীন্দ্র সাহিত্যে মানুষের জীবন ও প্রকৃতির ব্যবহার বিচিত্র ও বহুল, সেখানে বিশেষ করে তার ছোট গল্পে প্রকৃতি ও মানুষের জীবনের বিচিত্র ছবি অংকিত হয়েছে আপন মহিমায়। এখানে শিল্পরূপ প্রকাশ পেয়েছে মানব জীবনের প্রত্যাহিক জীবন আচরণে। বস্তুত তার ছোট গল্পে বাঙালির জীবন পরিবেশ প্রকৃতি ও পারিবারিক জীবনের যে বৈচিত্র প্রকাশ পেয়েছে তা সত্যি বিষ্ময়কর।
বাংলা ছোটগল্পের সর্ব প্রথম সার্থক স্রষ্ঠা, বাংলা ছোট গল্পের জনক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার ছোট গল্প সমুহে বিষয় বৈচিত্র্য, সমাজ বাস্তবতায়, জবিন ঘনিষ্ঠতায়, চরিত্র চিত্রনে, মনুষত্ত্ব বিশ্লেষণে যতটা সার্থকতার পরিচয় দিয়েছন অন্য কোন লেখক তৎপূর্বে ততটা সার্থক হতে পারেন নি। লেখক তার ছোট গল্প সম্পর্কে সোনার তরী কাব্যের বর্ষা যাপন কবিতায় বলেছেন- "ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যাথা/ ছোটো ছোটো দুঃখ কথা/ নিতান্তই সহজ সরল/ সহস্র বিষ্মৃতিরাশি/ প্রত্যাহ যেতেছে ভাসি/ তারই দু-চারটি অশ্রুজল"।
সত্যই জীবনের বহুবিধ রূপ বর্ণনার সার্থক শিল্পি, মানব মনো-বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে তার ছোটগল্পে সঠিক ধারার রূপায়ন ঘটিয়েছেন। সাধারণ বাস্তবতা ও ব্যক্তি মানুষের অন্তবেদনার এক মনোরম বহিঃপ্রকাশ তার ছোট গল্পে। একজন সার্থক শিল্পির মত জীবনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষের অনুভুতির সুক্ষ বিষয় গুলোকে অত্যান্ত নিখুত ভাবে শিল্পিত করেছেন। বিশেষ করে নারীর চাওয়া পাওয়া ভাললাগা, মন্দলাগা, তথা মনো-বিশ্লেষনে তিনি একজন দক্ষ শিল্পি। তার ছোট গল্পের নারী চরিত্র গুলো আমাদের সদা জাগ্রত চির চেনা জগতের বাসিন্দা, আমাদের একান্ত কাছের আপনজন। বাঙালি নারী সমাজের নিপীড়নের নানা চিত্র শিল্পিত রূপে প্রকাশ করেছেন।
বাংলা সাহিত্রের বহু বিশেষনে বিশেষিত বাংলা ছোটগল্পের রূপকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুল বিষয় বাস্বব জীবন ও সমাজ সংসারের আলেখ্য। পল্লি গ্রাম বাংলায় বেড়ে ওঠা অতি সাধারণ ভাবে যে সব মানুষের চিত্র আঁকা হয়েছে তাদের সবাই আমাদের প্রতিবেশী হিসাবে পাঠক অবলীলায় মেনে নেয়। বিশেষ করে নারী জীবন, বাস্তবতার স্পর্শে মহিমান্বিত রূপে আত্ন প্রকাশ করেছে। গ্রাম্য বিধবা, গৃহবধু, কুমারী, বাল্যবধু, তরুণী প্রভৃতির সমাবেশ গল্পগুলো অবিসংবেদীরূপে প্রত্যাক্ষধমী হয়ে উঠেছে। 'দেনাপাওনা'র নিরূপমা; 'মানভঞ্জনে'র গিরিবালা; 'মহামায়া' গল্পের মহামায়া; 'মাল্যদান' গল্পের কুড়ানি; 'সুভা' গল্পের সুভা আমাদের সবাইর অতি পরিচিত নারী চরিত্র। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে প্রত্যেকটি নারী চরিত্রই স্ব-মহিমায় ভাস্বর।
"মহামায়া" গল্পে নায়িকা মহামায়া নারী চরিত্রের পল্লি বাংলার একেবারে নিকটতম উজ্জ্বল চরিত্র। মহামায়ার প্রেম তার নারী জীবনের স্বভাব ফসল, তবে সে প্রেম ও ব্যক্তিত্ব গৌরব তথা অহমিকা বোধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কৌলিন্য সহমরণ বিধস্ত যুগে মহামায়া একজনকে প্রেমের ডোরে বেধেছিল বলেই তার নারীত্ব স্বাতন্ত্র্য লাভ করে নি। হৃদয় স্বাতন্ত্র্যের জন্যই সে প্রেমিকাকে প্রত্যাখান করেছ। কারণ প্রেমে নয়, পেমিকার কৃপাধন্য হয়ে নয় এই নিরাশ্রয় কুরুপাকে দয়া করে রাজীব আশ্রায় দিয়েছে। রাজীবের ভালবাসায় করুণা মিশেছে এরূপ গৌরবনাশী ভাবনা মহামায়াকে ভীষণ আহত করেছিল। তার নিরব চির বিদায় ব্যাক্তি শান্তির চুড়ান্ত বিষ্ফোরণ ঘটেছে। বাংলা ছোট গল্পে এমন ব্যক্তিত্বময়ী নারী চরিত্র দুর্লভ।
"কাবুলিওয়ালা" গল্পে মিনি চরিত্রের ক্রম-বিবর্তনকে রবীন্দ্রনাথ চিরন্তন করে তুলেছেন। আট বছর পর জেল থেকে ফিরে এসে রহমত দেখে মিনি বেশ বড় হয়ে গেছে। বয়ঃসন্ধিক্ষনের লজ্জার কারণে মিনি দীর্ঘদিন পর কাবুলিওয়ালার সাথে আর আগের মত মিশতে পারেনি। এ যেন ময়মনসিংহ গীতিকার সেই "লজ্জারক্ত হইল কইনার পরথম যৌবন"।
"দেনাপাওনা" গল্পের মধ্যে আমরা লক্ষ্য করি পনপ্রথা ও পরিবারের অমানুষিক অত্যাচারে ক্ষয়ে যাওয়া একটি নারী চরিত্রকে। স্নেহশীল পিতা রামসুন্দর নিরুপমার বিয়ে দেন বনেদি ঘরের রায় বাহাদুরের একমাত্র পুত্রের সাথে। কিন্তু নিষ্ঠুর পনের টাকা শোধ করতে না পারায় শাশুড়ির অত্যাচারে নিরুপমা প্রাণহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু ব্যাক্তি স্বাতন্ত্র্য বিসজন দিতে রাজি হয়নি কোন ভাবেই। যখন তার পিতা সব সহায় সম্বল বিক্রি করে পণের টাকা শোধ করতে যায় তখন নিরুপমা বাধা দেয়। তার ভাষায়- "আমি কী শুধু টাকার থলি; যতক্ষন টাকা আছে ততক্ষন আমার দাম"। এ উক্তির মধ্য দিয়ে আমরা নিরুপমা চরিত্রের কঠোর ব্যক্তিত্ব ও প্রতিবাদী রূপটি দেখতে পাই।
সমাজের একেবারে নিচ থেকে লেখক তার চরিত্রগুলোকে চিত্রন করেছেন। "সুভা" গল্পের সুভা চরিত্র তার উজ্জলতম নির্দশন। সুভা প্রকৃতির মতই নির্বাক, মুক। প্রকৃতির সাথে তার অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠতা। তার নির্বাক মনের কথা সবাক মানুষেরা না বুঝলেও প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণী জগতের সাথে ছিল তার গভীর মিতালি। সভ্য সমাজে তাই সুভা'র স্থান হয়নি। বরপক্ষ যখন জানতে পারে সুভা কথা বলতে পারে না, তখন তার উপর নেমে এসেছে নীরব অত্যাচারের অবজ্ঞা। মুক হওয়াতে তার জীবন সমাজের কাছে অপরাধী। সুভা রবীন্দ্রনাথের এক অনন্য সৃষ্টি।
"নিশীথে" গল্পের নারী চরিত্রটিকে রবীন্দ্রনাথ অত্যান্ত শিল্প মন্ডিত করে গড়ে তুলেছেন। দক্ষিণাচরণ বাবুর প্রথম স্ত্রীর সাথে তার যে দাম্পত্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তা দক্ষিণাচরণ বাবুর কাছে অমর। একদিন এক আবেগঘন মুহুর্তে দক্ষিণাচরণ বাবু তার স্ত্রীকে কথা দিয়েছিল সে তাকে কোনদিন ভুলে যাবে না। কিন্তু কাল ক্রমে স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে তার জীবদ্দশাতেই দক্ষিণাচরণ বাবু অন্য এক নারীর প্রেমে পড়ে। এ ঘটনায় প্রথম স্ত্রী এটিকে তার জন্য অপমান মনে করে বিষপান করে আত্নহত্যা করে। পুরুষের এ দ্বিমুখী চরিত্রের পাশে দক্ষিণাচরণ বাবুর প্রথম স্ত্রীর চরিত্রকে অত্যান্ত দক্ষতার সাথে নির্মান করেছেন আলচ্য গল্পে।
প্রতিবাদী নারী চরিত্রের অন্যতম নারী "মানভঞ্জন" গল্পের নায়িকা গিরিবালা। অন্যান্য নারীর মত গিরিবালা স্বামীর অবজ্ঞা নিরবে মেনে নিতে পারে নি। ঘরের কলবধু স্বামী দেবতার কোন আচরণেই কোন প্রতিবাদ করার অধিকার রাখে না। এমন কুসংস্কার পূর্ণ সমাজের বিরুদ্ধে সেকালর তীব্র প্রতিবাদী চরিত্র গিরিবালা। গিরিবালার স্বামী গোপীনাথ রঙ্গমঞ্চের অভিনেত্রীদের আকর্ষনে ঘরের স্ত্রীকে উপেক্ষা করে বাহিরে রাত কাটায়। গিরিবালা যখন একটি রাতের জন্যও স্বামীকে কাছে পায় না, বরং তাকে লাথি মেরে তার স্বামী যখন চলে যায়, তখন গিরিবালাও অভিনেত্রী রুপে তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে রঙ্গমঞ্চে গিয়ে যোগ দেয়। গিরিবালার স্বামীর বিরুদ্ধে গিয়ে শুধু নতুন জীবনে বাঁচার ক্ষেত্রই খুজে পায়নি, স্বীকৃতি ও সম্মান এবং স্বামীর পূর্ব জীবনের প্রতিশোধ নিতে পেরেছিল।
"অপরিচিতা" গল্পের নায়িকা কল্যানী আপন ভুবনে প্রজ্জলিত এক চরিত্র। পন প্রথার অমানবিক আচরণের প্রতিবাদ স্বরুপ পিতা শম্ভুনাথ নিজেই কল্যানীর বিয়ে ভেঙে দেয়। তারপর হঠাৎ একদিন ট্রেনের কামরায় সেদিনকার বরবেশী অনুপম এর সাথে কল্যানীর সাক্ষাৎ ঘটে। কল্যানীর অকপটে আনান্দজ্জল স্বভাবে পরিচয় পেয়ে অনুপম তাকে বিয়ে করার জন্য হাত জোড় করে, মাথা হেট করে মরেছে। কিন্তু সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। অনুপম কল্যানীর চরিত্র মাধুর্যে বাঁধা পড়ে কল্যানীর কাছাকাছি থেকে বাকি জীবন কাটিয়েছে।
"মাল্যদান" গল্পের অবহেলিত কুড়ানির চরিত্রের মধ্যে ব্যাক্তিত্বের চরম প্রকাশ ঘটেছে। যতীন তার বোন পটলের বাড়িতে গেলে পটল হাসির ছলে পরিহাসের মধ্যে তার সযত্ন লালিত কুড়ানিকে ডাক্তার যতীনের সাথে বিয়ের কথা বলে। একদিন পটল কুড়ানিকে দিয়ে যতীনের গলায় মালা পরিয়ে দেয়। যতীন লজ্জিত হয়ে বিরক্তিতে পটলের বাড়ী পরিত্যাগ করে। যতীন চলে যাওয়ার পর কুড়ানি একটু একটু করে ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যেতে থাকে। পটলের পরিহাস যতীনের অবহেলা কুড়ানির একাগ্রে প্রেম কুড়ানিকে শেষ পর্যন্ত জীবনের পরিনতিতে দাঁড় করায়। নিজের মনের ও শরীরের মধ্যে বড় রকমের একটা অসুস্থতাকে সম্বল করে কুড়ানি ঘর ছেড়ে পথে বের হয়। ভাগ্যক্রমে কুড়ানির সাথে আবার যতীনের দেখা হল।
কুড়ানি আজ রোগী, যতীন ডাক্তারের। যতীন কুড়ানিকে দেখে প্রথমত চমকে উঠেছিল। সংবাদ পেয়ে পটল এবং তার স্বামী তাদের কুড়িয়ে পাওয়া সন্তানতুল্য কুড়ানিকে নিতে এলেন। কুড়ানির আর ঘরে ফেরা হল না। হল না যতীনের ডাক্তারের স্ত্রী হয়ে সংসার রচনা করা। যতীনের প্রতি ভালবাসা তাকে মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে এনে দিল। যতীনের সাথে সাক্ষাতের সময় সে এক সময় কুড়ানির গলায় শুকনো সে বকুল ফুলের মালাটি দেখতে পেল। সে মুহুর্তে আর বুঝতে বাকি রইল না যে কুড়ানি যতীনের সে মালাটিকে জীবনের একমাত্র সম্বল করে পথে বেরিয়েছে।
কুড়ানির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নারীত্বের আদর্শ রক্ষিত হয়েছে। পটলের সামান্য ভুল এবং যতীনের অবহেলা কুড়ানিকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে গেছে।
"একরাত্রি" গল্পের নারী চরিত্র সুরবালার সমস্ত জীবনের নিশ্চুপ প্রেমের ব্যর্থতার হাহাকার। পুরুষ শাসিত সমাজ সুরবালার প্রেমকে অবহেলা করার চিত্র অংকন করেছেন। সুরবালার বিয়ে হয়েছে, তবে তার প্রেমিকের সাথে নয়, অন্যের সাথে। অন্যের বিবাহিতা স্ত্রী হওয়া সত্বেও আজও সে তার প্রেমিকেরই হৃদয় হয়ে আছে। ভুলে যেতে পারেনি তার প্রেমকে। তাই তো তার প্রেমিক মন বার বার ছুটে যেতে চেয়েছে ঘর সংসার ছেড়ে প্রিয়জনের কাছে। কিন্তু সমাজ তার বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে। সে সমাজের যাতাকলে পড়ে কুরে কুরে মরেছে।
"কঙ্কাল" গল্পে অকাল বিধবা কনকচাঁপা যৌবনবতী হয়েছে বৈধব্যের পরে।তার বিযে হয় তার বয়ঃসন্ধিকালের পূর্বে। সে যখন ঘর সংসার এমনকী বিয়ে কী তা বুঝত না তখন তাকে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়েছ। এ দিকে সে যৌবনবতী হওয়ার আগেই তার স্বামী মারা যায় এবং সে বিধবা হয়। তার মনে যখন পরিপূর্ন যৌবন তখন সে বৈধব্যের বোঝা বহন করে নিয়ে বেড়াচ্ছে। যদিওবা দার চোখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার ভাইয়ের বন্ধু শশী শেখর। ভাইয়ের বন্ধু শশী শেখরের প্রতি প্রণয়াসক্ত হলেও বিধবা হওয়ার কারণেই সমাজ সংসারের প্রচালিত নিয়মের যাতাকলে চাপা পড়ে ব্যার্থ হয়ে তাদের বিয়ে হয়নি। এখানে লেখক তৎকালীন হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার যে কি ভয়ানক রূপের কারণে একটা জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে তার বর্ণনা করেছেন।
"শাস্তি" গল্পের চন্দরা চরিত্রের মাধ্যমে সমাজের নির্যাতনের বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। সংসারের গৃহবন্দি নারীর অভাবের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন। অভাবের তাড়নায় স্বামী দুঃখীরামের হাতে তাকে জীবন দিতে হয়েছে। পুরুষ শাসিত সমাজে নারী হয়েছে হাতের পুতুল।
বাংলা ছোটগল্পের জনক রবীন্দ্রনাথ তার ছোটগল্পে যে সব নারী চরিত্রের অতারণা করেছেন সেগুলো কোন কল্পিত চরিত্র নয়। এরা সবাই যেন এ সমাজেরই লোক যেন আমাদের অতি পরিচিতি আপনজন। নারীর ভাললাগা, মন্দলাগা ও তাদের সুখ দুঃখের সঙ্গী হয়ে অত্যান্ত দরদি মন নিয়ে তিনি তার ছোট গল্পের নারী চরিত্রগুলো বির্নিমান করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গল্পে নারী চরিত্রগুলো পুরুষ চরিত্রের তুলনায় স্বতন্ত্র ও উজ্জল। রবীন্দ্রনাথ মনস্তত্ব বিশ্লেষনে একজন সফল শিল্পির পরিচয় দিয়েছেন।
What a coincidence! In my city there is also a statue dedicated to Rabindranath Tagore and India House. http://valladoliddailyphoto.blogspot.com/2011/01/blog-post.html