বুদ্ধ পূর্ণিমা, গৌতম বুদ্ধ ও তার জীবন দর্শন
বুদ্ধ পূর্ণিমা বা বৈশাখী পূর্ণিমা হল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি অতি পবিত্রতম দিন। এই দিনে অর্থাৎ বৈশাখী পূর্ণিমার পবিত্র তিথিতেই মহামতি গৌতম বুদ্ধ লুম্বিনী কাননে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, বুদ্ধগয়ায় বোধিজ্ঞান বা বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন এবং কুশীনগরে মহাপরিনির্বাণ বা মহাপ্রয়াণ লাভ করেছিলেন। বুদ্ধের জন্ম, বোধিজ্ঞান লাভ ও মহাপরিনির্বাণ একই দিনে হওয়ায় ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত বুদ্ধ পূর্ণিমা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য শ্রেষ্ঠতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। বিশ্বের সকল বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে এটি বুদ্ধ পূর্ণিমা নামে পরিচিত। বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ ও মহাপরিনির্বাণ একই দিনে অর্থাৎ বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে হয়েছিল বলে বৈশাখী পূর্ণিমাকে বুদ্ধ পূর্ণিমা নামে আখ্যায়িত করা হয়।
আজ থেকে ২৫৫৮ বছর পূর্বে বৈশাখী পূর্ণিমা বা বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিতে মহামতি গৌতম বুদ্ধ আভির্ভূত হয়েছিলেন বা শুভ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ধন ধান্য ও সম্পদ প্রাচুর্যে ভরা কপিরাবস্তু রাজ্যের শাক্য বংশের রাজা ছিলেন শুদ্ধোধন। রাজা শুদ্ধোধন পত্নী রাণী মহামায়ার গর্ভে দেবদহে (রাণী মহামায়ার পিতৃগৃহ) যাওয়ার পথে লুম্বিনী'র (বর্তমান নেপালে অবস্থিত) শালবনে দেব-মনুষ্যের দুঃখ মুক্তির প্রবল মনোবাসনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন।
গৌতম বুদ্ধের বাল্য নাম ছিল সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থের জন্মের পরপরই তিনি সামনে হেঁটে এগিয়ে গেলেন। সাত পা এগোলেন এবং সপ্তপদে সাতটি পদ্মফুল প্রস্ফুটিত হলো। সিদ্ধার্থ বড় হয়ে অধিত জ্ঞানের কলা ও বিজ্ঞান এবং রনকৌশলের সার্বিক দক্ষতা অর্জন করেন। অতঃপর কোলীয় রাজ্যের রাজা সুপ্রবুদ্ধের কন্যা যশোধরার সাথে সিদ্ধার্থের বিয়ে হয়। রাজ প্রাসাদ, ঐশ্বর্য, রাজকীয় মর্যাদা, বিত্ত বৈভব সবকিছু মিলে পরম সুখে সংসার জীবন উপভোগ করছিলেন সিদ্ধার্থ।
একদিন সিদ্ধার্থ রাজ্য দর্শনে বের হয়ে দেখলেন জরাজীর্ণ, ব্যাধিগ্রস্ত লোক, মৃত ব্যক্তি ও সন্যাসী। মানব জীবনের এসব দূর্ভোগ ও চরম পরিণতি দেখে ও তার ব্যাখ্যা শুনে এবং তা উপলব্দি করে তিনি গভীর চিন্তামগ্ন হলেন এবং বিত্ত বৈভব ও সংসার জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে রাজকীয় জীবন বিসর্জন দিয়ে সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
সিদ্ধার্থ একটি পুত্র সন্তান লাভ করলেন। নাম তার রাহুল। রাহুলের জন্মের সংবাদ পাওয়ার পরপরই সিদ্ধার্থ চিন্তা করলেন সংসারের বন্ধন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া রাজপ্রাসাদের রঙ্গমঞ্চে বাদ্যযন্ত্রসহ নর্তকীদের অপসৃত পরিধেয় কাপড়ে বীভৎস দৃশ্য এবং আরও সবকিছু মিলিয়ে রাজ প্রাসাদকে সিদ্ধার্থের শ্মশানের মত মনে হলো। এসময় তিনি জাগতিক ধর্মের এরূপ বিভিন্ন বীভৎস দৃশ্য দেখে অনিত্য ভাবনায় নিজেকে নিমগ্ন করেন এবং বিত্ত বৈভব-রাজকীয় ঐশ্বর্য ছেড়ে গৃহত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন এবং একদিন আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে রাতে স্ত্রী, পুত্র, রাজ-বৈভবসহ সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে দেব মনুষ্যের কল্যাণে ও মুক্তির পথ অন্বেষণে গৃহত্যাগ করেন।
সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগের পর বিভিন্ন রাজ্য ভ্রমণ শেষে একদিন মাথার চুল নিজে কর্তন করে ঋষিপ্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। এরপর যথাক্রমে পঞ্চবর্গীয় ঋষির সাক্ষাৎ, কৃচ্ছতা সাধন, মধ্যম পন্থা অবলম্বনের মধ্য দিয়ে কঠোর ধ্যানে নিমগ্ন হন। ধ্যানের সময় বাধাদানকারীদের পরাজিত করে দীর্ঘ ৬ বছর কঠোর সাধনার পর ভারতের বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষ মূলে পূর্বনিবাসানুস্মৃতি বা পূর্ব জন্ম বৃত্তান্ত, দিব্যচক্ষু জ্ঞান বা জীবের জন্ম মৃত্যু, আসবক্ষয় জ্ঞান বা জাগতিক ভোগাঙ্খার নিবৃত্তি এই তিন প্রকার জ্ঞান লাভ করার পর বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি বা বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিতেই সর্বজ্ঞতা জ্ঞান বা বোধিজ্ঞান বা বুদ্ধত্ব লাভ করেন।
মহামতি গৌতম বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভের পর মৈত্রীময় বৌদ্ধ ধর্ম সারা বিশ্বময় প্রচার করে দীর্ঘ ৪৫ বর্ষাবাস পূর্ণ করতঃ ভারতের কুশীনগরে ৮০ বৎসর বয়সে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি বা বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিতেই মহাপরিনির্বাণ বা মহাপ্রয়াণ লাভ করেন।
মহামতি গৌতম বুদ্ধ সারা বিশ্বের মানব জাতির দুঃখ-বেদনাকে নিজের দুঃখ বলে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই মানব জীবনের দুঃখ-কষ্ট, জন্ম, জরা, ব্যাধি মৃত্যু স্বচক্ষে দেখে এবং তা উপলব্দি করে তিনি অঢেল সম্পদ, ঐশ্বর্য, রাজকীয় মর্যাদা, বিত্ত বৈভব ও সংসার জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন এবং জন্ম, জরা, ব্যাধি ও মৃত্যু-এই চারটি চিরসত্যের কারণ উদঘাটন এবং মানব জাতির শান্তি ও মুক্তির পথ খুঁজতে নিজেকে গভীরভাবে নিমগ্ন রাখেন। এক সময় রাজপ্রাসাদের বিত্ত-বৈভব ও সুখ এবং স্বজনের মায়া ত্যাগ করে সম্বোধি বা বুদ্ধত্ব লাভের পন্থা অন্বেষণে তিনি বেরিয়ে পড়েন রাজপ্রাসাদ ছেড়ে অজানার পথে। দীর্ঘ ৬ বছর কঠোর সাধনার পর মহামতি গৌতম বুদ্ধ বোধিজ্ঞান বা বুদ্ধত্ব লাভ করেন।
বিত্ত ও বৈভবের মধ্যে বড় হয়েও মহামতি বুদ্ধ উপলব্ধি করেছিলেন ভোগে সুখ নেই, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। তাই অহিংসা পরম ধর্ম এই নীতিকে ধারণ করে মহামতি গৌতম বুদ্ধ সৌহার্দ্য ও শান্তিপূর্ণ একটি বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় আজীবন সাম্য ও মৈত্রীর বাণী প্রচার করে গেছেন। শান্তি ও সম্প্রীতির মাধ্যমে আদর্শ সমাজ গঠনই ছিল তথাগত বুদ্ধের একমাত্র লক্ষ্য।
জগতের দেব-মনুষ্য তথা সকলের বিমুক্তি লাভের পথ প্রদর্শন করেছেন। জগতে হিংসা-হানাহানি বাদ দিয়ে, লোভ-দ্বেষ-মোহ ত্যাগ করে, তৃঞ্চাকে ক্ষয় করে, জন্ম-জরা-ব্যাধি-মৃত্যুকে জয় করে, একমাত্র মুক্তির পথ নির্বাণ-কে আবিষ্কার করেছেন এবং কি পন্থা অবলম্বন করলে নির্বাণ লাভ করা যায় তা মানব জাতিকে আজীবন শিক্ষা দিয়ে গেছেন।
এই দিনটি যথাযোগ্য ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে প্রতি বছরই পালিত হয়। বুদ্ধ পূর্ণিমা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রধানতম উৎসব হিসেবে এই দিনটিতে সরকারি ছুটি থাকে। বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে চলতে থাকে এই মহাপূণ্যময় দিবসটি উদযাপনের যাবতীয় কার্যক্রম। ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু, বৌদ্ধ সম্প্রদায়, বৌদ্ধ বিহার পরিচালনা কমিটি ও বৌদ্ধ ধর্মীয় সংগঠনগুলো এই প্রধান ধর্মীয় উৎসব পালনের লক্ষ্যে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে যাবতীয় ধর্মীয় কার্যাদি সম্পাদন করে থাকেন। বৌদ্ধ বিহারে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করা হয়।
সকালে জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, বুুদ্ধ পূজা, পঞ্চশীল গ্রহণ, অষ্টশীল গ্রহণ, মহাসংঘদান, মহা অষ্টপরিস্কারদান, পবিত্র ত্রিপিটক থেকে পাঠ, ভিক্ষু সংঘকে পিন্ডদান, বিকেলে বুদ্ধ পূর্ণিমার তাৎপর্য শীর্ষক আলোচনা সভা, সন্ধ্যায় আলোক সজ্জা, হাজার বাতি প্রজ্জ্বলন, ফানুস উড্ডয়ন, দেশ ও জাতির মঙ্গল ও সমৃদ্ধি কামনায়, বিশ্ব শান্তি কামনায় এবং জগতের সকল প্রাণীর সুখ-শান্তি ও মঙ্গল কামনা করে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে সমবেত বিশেষ প্রার্থনা। এছাড়া দেশের বিভিন্ন বৌদ্ধ পল্লীগুলোতে এ দিনে মেলা বসে।