হাওড়া স্টেশন

ভারতের ব্যস্ততম রেল স্টেশন হল হাওড়া স্টেশন। বর্তমানে ভারতের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে প্রাচীন স্টেশন হাওড়া ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানির মালিকানাধীন। ১৮৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে, ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানি তৈরী হয়, ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি ও গ্রেট ওয়েস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি কে একত্রিত করে।

১৭ই অগাস্ট ১৮৪৯ সালে, তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানির সাথে, কলকাতা থেকে বর্ধমান পর্যন্ত একটি পরীক্ষামূলক রেল লাইন বসানোর চুক্তি করে। যদিও এর আগেই ১৮৪৫ সালেই, ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানি প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের পরে এই রেল লাইন চালুর আবেদন করেছিল।

ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানির তৎকালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও চিফ ইঞ্জিনিয়ার জর্জ টার্নবুল ও কোম্পানির ইঞ্জিনিয়াররা, ৭ই মে ১৮৫০ সালে, হাওড়া থেকে বর্ধমান পর্যন্ত লাইন পরীক্ষা করে, ট্রেন চালানোর পক্ষে সবুজ সংকেত দেন। ১৮৫৪ সালের ১৫ই অগাস্ট, সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে হাওড়া স্টেশন থেকে হুগলির উদ্দেশ্যে প্রথম ট্রেনটি ছাড়ে। উল্লেখ্য যে, ২৪ মাইল যাত্রাপথের প্রথম ট্রেনের জন্য, রেল কোম্পানি প্রায় ৩ হাজার আবেদন পত্র পেয়েছিল।

ট্রেনটিতে ছিল, ৩টি প্রথম শ্রেণী, ২টি দ্বিতীয় শ্রেণী, তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রীদের জন্য ৩টি 'ট্রাকস' এবং গার্ডের জন্য একটি ব্রেক ভ্যান। এগুলি সবই কলকাতায় তৈরী করা হয়েছিল। প্রথম যাত্রায়, হাওড়া থেকে হুগলী যেতে সময় লেগেছিল ৯১ মিনিট। হাওড়া-হুগলী যাত্রাপথের মাঝে, ট্রেন থামত, তিনটি স্টেশনে- বালি, শ্রীরামপুর ও চন্দননগরে। ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর ভাড়া ছিল ৩ টাকা ও তৃতীয় শ্রেণীর ভাড়া ছিল ৭ আনা।

জর্জ টার্নবুল, ১৭ই জুন ১৮৫১ সালে, প্রথম হাওড়া স্টেশন বিল্ডিং এর জন্য প্ল্যান জমা দেন। যদিও, সরকারি আধিকারিকরা, হাওড়া স্টেশনের জন্য কোম্পানি যতটা জমি চেয়েছিল ততটা জমি দিতে রাজি ছিলেন না। যদিও, রেল কোম্পানির ক্রমাগত বর্ধিত হতে থাকা লাভের অংক দেখে, পরে তাদের মত পরিবর্তন ঘটে।



১৮৫২ সালের জুন মাসে, জর্জ টার্নবুল, পুনরায় হাওড়া রেল স্টেশনের সম্পুর্ন ও পরিমার্জিত প্ল্যান জমা দেন। এবারে, সেই প্ল্যান গৃহীত হয় ও স্টেশন তৈরীর জন্য টেন্ডার ডাকা হয়। ১৮৫২ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত, ৪টি টেন্ডার জমা পড়ে। তখনকার দিনে জমা পড়া ৪টি টেন্ডারের দর ছিল ১লক্ষ ৯০ হাজার টাকা থেকে ২লক্ষ ৭৪ হাজার ৫২৬ টাকার মধ্যে। হাওড়া স্টেশন তৈরীর জন্য, রেল কোম্পানি আনুমানিক খরচের হিসাব ছিল ২লক্ষ ৫০ হাজার টাকা।

রেল কোম্পানি, বর্তমান হাওড়া রেল স্টেশনের জমি অধিগ্রহণ করার আগে, সেই জমিটি ছিল একজন পর্তুগিজ ব্যক্তির, যিনি সেখানে একটি অনাথ আশ্রম চালাতেন ও এর সাথে একটি চার্চ ছিল। কোম্পানি তাঁর কাছ থেকে জমিটি ক্রয় করে, তার অনাথ আশ্রম ও চার্চটিকে কলকাতায় সরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যাবস্থা করে দেয়।

যেহেতু তখন হাওড়া সেতু ছিলনা, তাই হাওড়া স্টেশনে যেতে হত নৌকা দিয়ে হুগলী নদী পার করে। আর হাওড়া স্টেশনের দিকে কোন ঘাট না থাকার জন্য, যাত্রীদের আর্মেনিয়ান ঘাটে নেমে, সেখানে থাকা রেল কোম্পানির টিকিট কাউন্টারে ট্রেনের টিকিট কাটতে হত। ট্রেনের টিকিটের সাথে, নদী পারাপার হবার ভাড়াও জুড়ে দেওয়া থাকত। ১৮৮৬ সালে, হাওড়া পন্টন ব্রীজ তৈরী হবার পরে, এই পদ্ধতি বন্ধ হয়।

১৮৬০ সালে বর্তমানের লাল ইঁট দিয়ে তৈরী হাওড়া স্টেশন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ১৮৬৫ সালের আগে পর্যন্ত হাওড়া স্টেশনে একটি মাত্র প্লাটফর্ম ছিল। ১৮৬৫ সালে, ট্রেন আসা ও যাওয়ার জন্য, দুটি আলাদা প্লাটফর্ম তৈরী করা হয়। ১৮৯৫ সালে, আরো একটি নতুন প্লাটফর্ম বানানো হয় ও হাওড়ায় মোট প্লাটফর্মের সংখ্যা হয় ৩টি। এই প্লাটফর্মগুলি দৈর্ঘ্যে এমনকিছু বড় ছিল না। এর জন্য ট্রেনের প্রায় ৫টি বগি প্লাটফর্মের বাইরেই থাকত। প্রথমের কোচগুলো ছিল ৪ চাকার। ৮ চাকার কোচ, ১৯০৩ সাল থেকে চালু হয়।

হাওড়ার ওপরে, ক্রমাগত যাত্রীর চাপ বাড়ার জন্য, ১৯০১ সালে, নতুন করে হাওড়া স্টেশনকে গড়ে তোলার প্রস্তাব দেওয়া হয়। নতুন হাওড়া স্টেশনের নকশা করেন ব্রিটিশ স্থপতি হেলসেই রিকার্ডো। ১৯০৫ সালে, নতুন ৬ প্লাটফর্মের (সাথে আরো ৪টি নতুন প্লাটফর্ম তৈরী করার জায়গা সমেত) হাওড়া স্টেশন সম্পূর্ণ হয় এবং এর উদ্বোধন হয় ১৯০৬ সালে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url