কলকাতা ফুটবল লিগ

কলকাতা ফুটবল নিয়ে অনেক আলোচনা হয়, প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো বিষয়ে, ঘটি-বাঙ্গাল, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ট্রফি এসব নিয়ে. আমি নিজেও লিখি বা অন্যরাও লেখেন, পড়ি, মতামত দেই. কিন্তু আজ স্কুলে বসে বসে ভাবছিলাম মোহনবাগানের একটি বিষয় নিয়ে সেই অর্থে আলোচনা প্রায় হয়নি. ঐতিঝ্যের নাম মোহনবাগান। কিছু না জানা তথ্য, যা বেশীর ভাগ মোহনবাগানীরাও জানেন না।

আপনারা জানেন ১৯১১ তে মোহনবাগান ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্ট কে হারিয়েছিল। কিন্তু জানেন কি, এর ফলেই ব্রিটিশরা ১৯১১ তে রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে সরিয়ে নেয়। বাঙাল-ঘটি যদি না থাকত তা হলে কলকাতার ফুটবল হয়ত এমন বাঁধনছেড়া উন্মাদনার জন্ম দিতে পারত না। এই সত্যকে সামনে রেখে যখন একটু সিরিয়াস আলোচনা করব ভাবছি তখনুই হঠাৎ মনে হল এই বহুপ্রচলিত শব্দদুটোর মানে কী, অথবা সত্যিই কোনও মানে আছে কিনা। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ খুলে বাঙাল শব্দটা পাওয়া গেল, তার এক রকম মানেও পাওয়া গেল। জানা গেল বহু প্রাচীন একটা শব্দ।

ঘটি শব্দটা অবশ্যই পাওয়া গেল কিন্তু জলের পাত্র ছাড়া আর কোনও মানে পাওয়া গেল না। বাঙাল শব্দের অর্থ পূর্ববঙ্গের মানুষ, কেউ কেউ পূর্ববঙ্গের মুসলমান অর্থেও জানে। অর্থাৎ যে বাঙাল-ঘটি প্রসঙ্গ নিয়ে আমরা আলোচনা করতে চাইছি তাতে বাঙাল শব্দটা নিয়ে কোনও বিভ্রান্তি রইল না। কিন্তু ঘটি? ফুটবলকে কেন্দ্র করে যে ঘটি শব্দের জন্ম বা রচনা তার মানে তো আর ঘড়া বা জলের পাত্র নয়।

এই ঘটির মানে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ- মোর প্রিসাইসলি, মোহনবাগানের সমর্থক। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, যে ঘটি শব্দটা ফুটবলকে ঘিরে ব্যবহৃত হয় তার কোনও আভিধানিক অস্তিত্বই নেই। সেই কারণেই বোধহয় ঘটিনামা বলে কোনও কিছু অঙ্কুরিত হতে পারেনি। আর বাঙালনামা অঙ্কুরিত হয়েছে, বিকশিত হয়েছে, ক্রমে প্রসারিত হয়েছে শাখাপ্রশাখায় এবং সুরভি ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা বাংলা জুড়ে।

স্বাধীনতা বা দেশভাগের আগে থেকেই বহু বাঙালি পূর্ববঙ্গ ছেড়ে এ বঙ্গে চলে আসা শুরু করেছিলেন। যাঁরা চলে এলেন বা আসছিলেন তাঁরা খুব আনন্দের সঙ্গে বা উন্নততর জীবনের খোঁজে আসছিলেন তা তো নয়। নানা কারণে নিজেদের ভিটেতে আর থাকা যাচ্ছিল না। জমিজমা, বসতবাড়ি তো আর সঙ্গে নিয়ে আনা যায় না। যাঁরা আসছিলেন তাঁরা সবকিছু ছেড়েই আসছিলেন। এ বঙ্গে যে তাঁদের জন্য সবকিছু প্রস্তুত ছিল তা-ও নয়। বরঞ্চ চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার অন্ধকার কাটিয়ে নতুন করে সেটল করার, নতুন করে বাঁচার লড়াই শুরু করতে হয়েছিল ছিন্নমূল এই মানুষগুলোকে।

ওভাবে দেশভাগ করে দিলে সাধারণ মানুষের এমনটাই দশা হয়। কিন্তু সুখের কথা এই যে এই বঙ্গে এসে ছিন্নমূল মানুষরা নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াই করতে গিয়ে তাঁদের মননশীলতা, সংস্কৃতিচেতনা আর ক্রীড়াপ্রেমকে অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছিলেন। ফলে, এই বঙ্গে নতুন করে গতি পেয়েছিল বামপন্থার চর্চা, প্রাণ পেয়েছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা আর উৎসাহ পেয়েছিল ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে সামনে রেখে ফুটবল খেলার উন্মাদনা। আমরা যদি পঞ্চাশ দশকের বাংলা সঙ্গীত আর তার পরের বাংলা সঙ্গীতের দিকে তাকাই তাহলে স্পষ্ট বোঝা যাবে যে পরবর্তী সময়ের বাংলা গানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রভাব কীভাবে পড়েছে। বাংলা আধুনিক গান বলতে যেটা বোঝায় সেই গানের কথায় এল পরিবর্তন এবং সুরেও এল সম্মোহনী ‘মেলডি’।

বামপন্থী আন্দোলন তরুণসমাজকে ছাত্রসমাজকে প্রভাবিত করতে শুরু করল। আর ফুটবল মাঠে এল পরিবর্তন। পঞ্চাশ দশকের আগে পর্যন্ত মোহনবাগান ভারতীয় ফুটবলের মুখ। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ দলকে হারিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ঝড় তুলেছিল মোহনবাগান। তার পর থেকে তারাই ভারতীয় ফুটবলের মূল প্রতিনিধি। তিরিশ দশকে মহামেডান স্পোর্টিং পর পর পাঁচবার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইংরেজ দলগুলোর ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল।



কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের সেভাবে কোনও জোরালো প্রতিনিধিত্ব ছিল না। পঞ্চাশ দশকের তথাকথিত ‘বাঙাল’ সমর্থকরা ইস্টবেঙ্গল দলকে উৎসাহ দিতে মাঠে নেমে যেতে শুরু করল। দলের পাঁচ দুরন্ত খেলোয়াড় ভেঙ্কটেশ, আপ্পারাও, ধনরাজ, আমেদ আর সালে- পঞ্চপাণ্ডব নামে বিখ্যাত হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে ইস্টবেঙ্গল ফুটবলে মোহনবাগানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উজ্জ্বল হতে শুরু করল।

এভাবেই ষাটের দশক গড়িয়ে যেতে লাগল। কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হল, চারু মজুমদারের হাত ধরে নকশাল আন্দোলন দানা বাঁধল। দীর্ঘদিন ধরে রাজ্যের শাসনে থাকা কংগ্রেস ক্রমে বাংলায় ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছিল। কমিউনিস্ট পার্টির যে অংশের সঙ্গসদীয় গণতন্ত্রে আস্থা ছিল তাদের নেতা প্রমোদ দাশগুপ্ত ও জ্যোতি বসু নিজেদের শক্তি ও সংগঠনকে ক্রমে মজবুত করছিলেন। সব মিলিয়ে বাংলার রাজনৈতিক আবহাওয়া অস্থিরতার ঝড়ে টালমাটাল হয়ে উঠল। ছাত্রসমাজ ও তরুণসমাজের সামনে নেমে এল অনিশ্চয়তার অন্ধকার। এই অন্ধকারে বিভ্রান্তের মত ভেসে বেড়াচ্ছিল বাংলার তরুণসমাজ।

এই অনিশ্চয়তা আর বিভ্রান্তির অস্থিরতা কাটাতে তারা দিনের শেষে চলে আসত কলকাতা ময়দানে ফুটবল খেলা দেখতে। ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান বা মহামেডান স্পোর্টিং দলের রথে চেপে পছন্দের খেলোয়াড়ের সঙ্গে নিজেকে আইডেন্টিফাই করে জেতার স্বাদ, সাফল্যের আনন্দ পেতে চাইত তারা। সেটা সত্তর দশক। স্কুল-কলেজে পরীক্ষা হবে কিনা ঠিক নেই, ভবিষ্যতের কোনও স্থিরতা নেই, কখন পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে জানা নেই- সারাদিন এই অনিশ্চয়তা ভারি করে তুলত তখনকার তরুণসমাজকে। ভেতরের জ্বালা জুড়োবার জন্য সাহিত্য, নাটকে ডুবে জেতে চাইত।

কিন্তু সেখানে তো সাফল্য বা ব্যর্থতার সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে ফেলা যায় না। তার জন্য খেলার মাঠটাই ছিল উপযুক্ত জায়গা। ছিন্নমূল পরিবারের বড়রা তো একধরণের অনিশ্চয়তা পার হয়ে এসেছে এবং সেই অনিশ্চয়তা পার হয়ে তারা প্রতিষ্ঠিতও হয়েছে বা হচ্ছে। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম আবার সম্মুখীন হয়েছে অনিশ্চয়তার, সুদূরেও এমন কোণও আলোর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিলে না সত্তর দশকের গোড়ায় যার তাগিদে অন্ধকার পার হয়ে যাওয়া যায়। এমনই এক অনিশ্চিত, বিভ্রান্তিকর সময়ে খেলার মাঠ তাদের সাফল্যের স্বাদ দিত।

এই কারণেই বাংলায় তখন ফুটবল হয়ে উঠেছিল এর জনপ্রিয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url