খ্রিষ্টান ধর্মের ইতিহাস

প্রাচ্যে আলেকজান্ডারের বিশাল বিজয়াভিযানের ফলে গ্রিক সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিশ্বের রূপকে বিশেষভাবে বদলে দেয়। এতে করে গ্রিক সংস্কৃতি, জ্ঞান ও ভাবধারা শুধু বিজিত অঞ্চলেই বিস্তৃত হয় নি, প্রাচ্যীয় (আরব, ভারতীয়, মিশরীয় এবং পারস্যীয় ইত্যাদি) সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও ধর্মীয় ভাবনাও পুরো সাম্রাজ্যে বিস্তৃত হওয়ার পথ সুগম করে, যার ফলে একটি সঙ্কর ভাবধারার উদ্ভব ঘটে, যাকে বলা হয় হেলিনিজম।

এটা সর্বজনবিদিত যে, খৃষ্টপূর্ব প্রথম শহস্রাব্দে গ্রিক সমাজে নৈতিক, দার্শনিক, সাহিত্যিক ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনায় এক অভাবনীয় বিপ্লব ঘটে। বিশেষত সক্রেটিসের (মৃঃ 399 BC) দার্শনিক ও নৈতিক ভাবনা গ্রিক সমাজে এক বলিষ্ঠ প্রভাব ফেলে। সক্রেটিসের চিন্তাচেতনা ও শিক্ষা পরবর্তীতে প্লেটো, এ্যারিস্টোটল ও ইউক্লিদের মত মহান দার্শনিক ও চিন্তাবিদের আবির্ভাব-ই ঘটায় নি, তাঁর বেশকিছু সহচর সক্রেটিসের শিক্ষার অনুকরণ করতঃ বেশ কয়েকটি কখনো কখনো বিরুদ্ধাচারী, এমনকি উদ্ভট দার্শনিক ভাবধারা ও সামাজিক আন্দোলনের উদ্ভব ঘটায়।

(১) প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ -- সক্রেটিসের না স্বয়ং প্লেটোর? সক্রেটিস নিজে কোন লেখা রেখে যান নি। ফলে তাঁর সবচেয়ে স্বনামধন্য শিষ্য প্লেটোর লেখা থেকে আমরা সক্রেটিসের চিন্তাচেতনা ও ভাবধারা সম্পর্কে জানতে পারি। সক্রেটিস অনেকাংশে অরাজনৈতিক ছিলেন। তবে প্লেটো আমাদেরকে জানান যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা সক্রেটিসের অপছন্দ ছিল, সক্রেটিসের সে অপছন্দের ভিত্তিতেই প্লেটা তার ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে এক স্বৈরাচারী ও অসমানাধীকারী রাজনৈতিক ভাবনার রূপরেখা চিত্রিত করেন। তবে বাস্তবে গণতন্ত্রের প্রতি সক্রেটিসের ছিল সুদৃঢ় সমর্থন এবং প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ ছিল গণতন্ত্রের প্রতি তার নিজস্ব অনাস্থার ফসল মাত্র কিংবা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে তার প্রিয় গুরু সক্রেটিসের মৃত্যুতে তার আক্রোশের ফসল হিসেবে।

(২) অ্যারিস্টিপাস – সুখের খোজে আত্মনিয়ন্ত্রণ না আত্মনিবেদন? বর্তমান লিবিয়ার সাইরীনি শহরের এ্যারিস্টিপাস ছিলেন সক্রেটিসের আরেক নামকরা শিষ্য। সক্রেটিসের মৃত্যুর পর এ্যারিস্টিপাস সাইরীনিতে কথিত সক্রেটিসের শিক্ষার ভিত্তিতে এক জীবনাচরণ মূল দার্শনিক ভাবধারা প্রতিষ্ঠিত করে, যাকে বলা হয় সাইরীনিয়াক। সক্রেটিস মনে করতেন যে সুখের খোজে মানুষের যৌক্তিক আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং সদাচার ও ন্যায়পরায়ণতা চর্চা প্রয়োজন। এ্যারিস্টিপাস সক্রেটিসের আত্মনিয়মানুবর্তিতাকে শুধুই সুখের তরে উৎসর্গ করেন। সক্রেটিস মনে করতেন, সুখী হওয়ার জন্য সততা ও সৎপন্থা চর্চা আবশ্যক। এ্যারিস্টিপাস এর ব্যাখ্যায় ভাবতেন, যতক্ষণ সে সুখী ততক্ষণ সে সৎপন্থা চর্চা করছে।

এভাবে এ্যারিস্টিপাস সক্রেটিসের ভাবনাকে এক অবারিত ও বিশ্রী উপভোগ-ভিত্তিক আনন্দবাদী আন্দোলনে রূপান্তরিত করে। সক্রেটিসের প্রত্যাশিত সৎপন্থা ও ন্যায়পরায়নতা চর্চার তাতে কোন গুরুত্ব ছিল না। তারা বিশ্বাস করতো – জীবনে আনন্দ-ফূর্তি হচ্ছে একমাত্র ভাল জিনিস এবং ব্যাথা-বেদনা শুধুই মন্দের প্রতীক। যদিও সাইরীনিয়াক ভাবধারা এক শতাব্দের মধ্যেই উঠে যায়, পরবর্তীতে তা এপিকিউরিয়ান নামক আরেকটি অধিক নান্দনিক ভাবধারা ও সামাজিক আন্দোলনের মাঝে পুনর্জীবন লাভ করে।

(৩) অ্যান্টিসথিনেস – সুখের তরে সন্যাস চর্চাঃ আরেক শিষ্য এ্যান্টিস্থিনেস সক্রেটিসের সুখের খোজে আত্মনিয়ন্ত্রণ চর্চার উপদেশের ভিত্তিতে আরেক সামাজিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন, যাদেরকে বলা হত ‘সিনিক্স’ এবং তার মূল কথা ছিল এ্যারিস্টিপাসের সাইরিনিয়াক তত্ত্বের ঠিক বিপরীত। সুখ অর্জনের মনের দৃঢ়তা ও সহজ-সরল জীবন চলা – সক্রেটিসের এ দু’টো উপদেশের উপর জোর দেন এ্যান্টিসথিনেস। সক্রেটিস আকাঙ্ক্ষা পূর্তি চেয়ে আকাঙ্ক্ষা বর্জনের উপর জোর দিতেন এবং ব্যক্তি জীবনে তিনি অর্থ-সম্পদ ও আরাম-বিলাসিতা বর্জন চলতেন। সে ভিত্তিতে এ্যান্টিসথিনেস একটা দারিদ্র্য আলিঙ্গনকারী সন্যাসী আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন।

সক্রেটিস ভাল মানুষ হওয়া ও ভাল কাজ করার উপর জোর দিতেন এবং বলতেন – যে ভাল কাজ করে কেউ তার ক্ষতি করতে পারে না। সে ভিত্তিতে সিনিকরা অপকার ও ক্ষতি থেকে নিজেদেরকে আড়াল করার জন্য শুধুই ভাল হওয়া, ভালোত্ব অর্জন করার উপর জোর দিতেন। এ বাইরে তাদের আর কিছুরই প্রয়োজন ছিল না। এভাবে সক্রেটিসের সৎ ও পূণ্যবান জীবন লাভ বিষয়ক শিক্ষাকে সিনিকরা এক চরম অস্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে যায়, যেখানে স্বাভাবিক জীবনের যাবতীয় পার্থিব বিষয় ও কর্মকাণ্ড একেবারেই বিবর্জিত। ভাল হোক কিংবা মন্দ – তারা এসবকে বোকামি, অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাকৃতিক মনে করতো। প্রাকৃতিক ও সহজ-সরল জীবন চলাই ছিল তাদের জাগতিক দর্শনের মূল মন্ত্র।

সিনিক আন্দোলনের এক অনুসারী ছিল কৃষ্ণ সাগর অঞ্চলের সিনোপির অধিবাসী ডিওজিনিস (~৪০০-৩২৫ খৃঃপূঃ)। ডিওজিনিস ছিলেন এক চরমপন্থী প্রকৃতিবাদী, যিনি সিনিক আন্দোলনকে আরও চরম সন্যাসী ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় উন্নীত করেন। তিনি মনে করতেন যে এ্যান্টিসথিনেস তার নিজ শিক্ষা অনুসরণ করতে ব্যর্থ ছিলেন।

সে ভাবনা থেকে তিনি সিনিক সন্যাসবাদকে এক চরম ‘পাগলামী ও অস্বাভাবিক জীবনাচার’ প্রক্রিয়ায় উন্নীত করেন। কিংবদন্তি আছে যে, ডিওজিনিস এক মাটির ভাড়ে বাস করতেন এবং সিনিকদের মাঝে প্রকাশ্যে হস্তমৈথুন চর্চা চালু করেন। সত্যি কি মিথ্যা, তাকে লোকে ‘কিয়ন’ (কুকুর) বলে ডাকত, কেননা তিনি ‘জটিলতাহীন, প্রবৃত্তি-ভিত্তিক ও লজ্জাহীন প্রাণীর মত জীবন চলায় নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন, কেননা প্রাণীকূলকে তিনি প্রাকৃতিক গুণাবলীর সত্যিকার প্রতিনিধি বা উপস্থাপক বিবেচনা করতেন।

সত্যিকার প্রাকৃতিক জীবন চলতে গিয়ে তিনি সবরকম ধন-সম্পদ, আরাম-আয়েস ও আনুষ্ঠানিক পারিবারিক জীবন বর্জন করেন, এমনকি নাগরিক জীবনের সকল বাধা-নিষেধ – যেমন অজাচার কিংবা মানব মাংস খাওয়ার নিষিদ্ধতা, বিবাহ প্রথা, সামাজিক শ্রেণী বিভাজন এবং গতানুগতিক ধর্ম। আদর্শ সমাজ হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও বিচার-বিবেচনা সম্পন্ন এক ঢিলেঢালা ত্যাগী সম্প্রদায় – যারা যে কোন সামাজিক সম্পর্কেই যুক্ত হতে পারবে সকল পক্ষের অনুমোদনের ভিত্তিতে এবং সেখানে থাকবে না কোন গতানুগতিক বাধা-নিষেধ।

প্লেটো ডিওজিনিসকে ‘এক পাগল বনে যাওয়া সক্রেটিস’ বলেছিলেন সঙ্গত কারণেই। তথাপি মনে হচ্ছে, তার অস্বাভাবিক কার্যকলাপ তাকে যথেষ্ট জনপ্রিয় করে তুলেছিল – কেননা যখন তার মাটির ভাড়টি ভেঙ্গে যায় তখন এ্যাথেন্সবাসী একসাথে হয়ে তাকে আরেকটা কিনে দিয়েছিল। ডিওজিনিসের আন্দোলনটি অনেক শতাব্দী টিকে ছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় খৃষ্টীয় শতাব্দে সমাজের যাবতীয় ভবঘুরে হিপ্পি, উন্মুক্ত ভালবাসা পন্থী ও তল্পিতল্পা সহ ঘুর্ণমান ভিখারীরা আন্দোলনটিতে আকর্ষিত হয়।

ডিওজিনিসের খ্যাতনামা ছাত্র ও দার্শনিক থিবসের ক্রেইটস (365–285 BC) নিজের সব ধনসম্পত্তি বিলিয়ে দিয়ে সিনিক সম্প্রদায়ে যোগদান করেন। হিপার্কিয়া নামের ধনী পরিবারের এক মেয়ে ক্রেইটসের সাথে পরিচয়ের পর তার প্রেমে পড়ে যায় এবং তার সাথে যোগ দেওয়ার জন্য আত্মহত্যার ভয় দেখিয়ে বাবা-মার অনুমতি আদায় করে। দম্পত্তিটি এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াতো, এ্যাথেন্সের রাস্তায় দারিদ্রের জীবন যাপন করতো এবং প্রকাশ্যে যৌনকর্মের পর নৈশভোজে যেত।

(৪) ইউক্লিদের যুক্তির কারখানা – সক্রেটিসের আরেক নিবেদিতপ্রাণ শিষ্য মেগারার ইউক্লিদ (435-365 BC) সক্রেটিসের শিক্ষায় নৈতিক শুদ্ধি ও যুক্তিবাদের প্রতি অনুরক্ত হন। তিনি যৌক্তিক তর্কাতর্কিতে, বিশেষত আপাতবিরোধী যুক্তিতর্কে, আসক্ত হয়ে পড়েন, এবং তার নিজ বাসভূম মেগারাতে এক পাঠচক্র প্রতিষ্ঠা করেন, যার সম্পর্কে তার এক প্রতিদ্বন্দ্বী বলেছিলেন, ‘ঝগড়াটে ইউক্লিদ মেগারাবাসীকে বাদানুবাদের প্রতি উন্মত্ত ভালবাসায় উদ্বুদ্ধ করতেন’। ইউক্লিদের পাঠশালা ‘যুক্তি ও ভাষা বিষয়ক অনেকগুলো সর্বোচ্চ দীর্ঘস্থায়ী দ্বাঁদ্বার জন্ম দেয়’ এবং মেগারাকে এক হাস্যকরভাবে অতিরঞ্জিত ‘যুক্তিতর্কের কারখানায়’ রূপান্তরিত করে।

সক্রেটিসের ধ্যানধারনা ও চিন্তাচেতনা, যার কিছু কিছু কিছুটা পাগলাটে হলেও নিঃসন্দেহে এক বৈপ্লবিক বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক স্বর্ণখনি রেখে যায়, যা অনুসরণ করতে গিয়ে তার শিষ্যরা এতটা হাস্যকর রকম চরমে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়। এ প্রেক্ষাপটে যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রূপে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠে, তা হচ্ছেঃ গতানুগতিক চালচলন, প্রজ্ঞা ও ঐতিহাসিক অর্জন বিরোধী যাবতীয় সব উদ্ভট সামাজিক আন্দোলনের প্রতিও পৌত্তলিক গ্রিক সমাজের অবিশ্বাস্য রকমের সহনশীলতা।

প্রাচ্যে হেলিনিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিস্তার ইহুদীদেরকে সে সহনশীলতার মুখোমুখী করে। সক্রেটিসের কিছু কিছু উর্বর ভাবনা ফিলিস্তিনের ইহুদীদ সমাজের অংশবিশেষকে এতটাই প্রভাবিত করে যে, তাদের কেউ কেউ — যেমন প্রধান পুরোহিত জেইসন ও মেনিলাউস এবং তাদের সমর্থকরা হেলিনিজমের সংস্পর্শে তাদের সমাজ থেকে কট্টর ও অসহনশীল ইহুদী ভাবধারা উঠিয়ে দিতেও প্রস্তুত ছিল। আর অন্যদিকে যীশু সংস্কারের নামে ইহুদী ধর্মের অনেক মৌলিক শিক্ষা উঠিয়ে দিয়ে সক্রেটিস উদ্ভূত নৈতিক ভাবনা প্রচলনের জন্য এক নৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন শুরু করেন, যা নিম্নে আলোচনা করা হবে।

যীশুর সুবর্ণ নীতি না সক্রেটিসের? জীবন চলা সম্পর্কে সক্রেটিসের মূল সুর ছিল ভাল ও পুণ্যবান জীবন যাপন করা। যে ভাল তার কেউ ক্ষতি করতে পারে না। ভাল হওয়ার জন্য, অন্যের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ার জন্য, তোমাকেও অন্যের ক্ষতি বা অপকার করা থেকে বিরত থাকতে হবে – যা কিনা সুখ্যাত ‘সুবর্ণ নীতি’র (গোল্ডেন রুল) মূল ভিত্তি।

৩৯৯ খৃষ্টপূর্বাব্দে আলাদতে বিচারে এ্যাথেন্সের নবীনদেরকে কলুষিত করার দায়ে সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। অভিযোগটির বিষয়ে প্রতিক্রিয়ায় সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘কাউকে কলুষিত করা মানে তার ক্ষতি করা এবং কারও ক্ষতি করলে সে তোমার পালটা ক্ষতি করবে।’ অর্থাৎ সক্রেটিস কখনোই অন্যের ক্ষতি করে নিজের ক্ষতি ডেকে আনবে না। সক্রেটিসের এই নীতিই ৪ শতাধিক বছর পর যীশু প্রচারিত ‘সুবর্ণ নীতি’তে রূপ নিয়েছেঃ ‘সুতরাং সবকিছুতেই অন্যের প্রতি তোমরা শুধু এমন কাজই করবে, যা তোমরা চাও অন্যেরাও তোমাদের প্রতি করুক।

ডান গালে চড় মারলে বাম গালও এগিয়ে দাওঃ সক্রেটিস শুধু অন্যের ক্ষতি বা অপকার করা থেকেই বিরত থাকাতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন নি, বরং আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছেন। যে সক্রেটিসের ক্ষতি করবে, তার ক্ষতি করারও বিরোধী ছিলেন তিনি; অপকর্মের জবাবে অপকর্মের বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। অনেকটা সক্রেটিসের এই নৈতিক অবস্থানই ধ্বণিত হয়েছে যীশুর আরেক প্রসিদ্ধ বাণীতেঃ কেউ তোমাকে ডান গালে আঘাত করলে, বাম গালটিকেও তার প্রতি এগিয়ে দাও। আঘাতের বিপরীতে পালটা আঘাত থেকে বিরত থাকাই যীশুর এই বাণীটির মূল বক্তব্য। এবং যদিও খুব কম খৃষ্টানই আজ এ উপদেশ অনুসরণ করবে, ব্যক্তিগতভাবে সক্রেটিস এর প্রয়োগের পক্ষে দৃঢ় ছিলেন। কেননা এর মাঝে নিহিত ছিল সক্রেটিসের আধ্যাত্বিক ভাবনার সবচেয়ে বিষয় – আত্মার কল্যান।

শত্রুকেও ভালবাসঃ সক্রেটিস বলতেন, সব ধরনের অপকর্ম থেকে বিরত থাকো, কেননা আত্মা ‘খারাপ কর্ম দ্বারা আহত হয়, আর ভাল কর্ম দ্বারা লাভবান হয়’। তাঁর মতে, সবাইকে ভাল কাজ করতে হবে, তা যে পরিস্থিতিতেই হোক না কেন, কেননা সেটাই সঠিক পন্থা। অপকর্মে নিযুক্ত হওয়া, কিংবা অন্য কেউ খারাপ কাজ করে বলে নিজেও খারাপ কাজ করা, ইত্যাদির মাধ্যমে কেউ শুধু নিজেরই ক্ষতি করে, নিজ আত্মাকে আহত করে। ‘ভাল মানুষকে কোন কিছুই ক্ষতি করতে পারে না – না এ জীবনে, না পরকালে’, মনে করতেন সক্রেটিস।

শত্রুর ক্ষতি করা গ্রিক সমাজে গ্রহণযোগ্য ছিল এবং সক্রেটিসের এ কঠোর নৈতিক অবস্থান গ্রিক সমাজের সে গতানুগতিক নৈতিক ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ করে। সক্রেটিসের মতে, শত্রুর ক্ষতি করাও উচিত নয়; যদি কিছু করতেই চাও উপকার কর – যা কিনা যীশুর সুপ্রসিদ্ধ ‘শত্রুকেও ভালবাস’ (ম্যাথিউ ৫:৪৪) শিক্ষাটির মূল কথা।



সক্রেটিসের শিক্ষায় এসব নৈতিক ভাবনার অবতারণা এবং ৪ শতাধিক বছর পর কথিত যীশু কর্তৃক খৃষ্ট বাইবেলে সেগুলোর চমৎকার ভাষায় উপস্থাপন – এ দু’য়ের মাঝে একটা মৌলিক ব্যবধান রয়েছে। যীশুর ক্ষেত্রে এগুলোর একটা স্বর্গীয় উদ্দেশ্য ও অনুপ্রেরণা রয়েছে, যে ভক্তরা সেগুলো অনুসরণের মাধ্যমে বহুল লাভবান হবে, পর জীবনে ঈশ্বরের অশেষ কৃপা ও প্রতিদান উপভোগ করবে। কিন্তু সক্রেটিসের জন্য এমন প্রাচুর্যপূর্ণ দৈবধনের কোন প্রত্যাশা ছিল না, না ছিল কোন স্বর্গীয় শক্তির ইচ্ছে বা ইঙ্গিত।

তার মতে, কেউ এসব নৈতিক গুণাবলী চর্চা করবে শুধু পার্থিব ও মানবীয় কারণে – শুধুই একটা ভাল, নৈতিক ও ন্যায়পরায়ন জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে, পৃথিবীতে শুধুই একটা আদর্শ, সম্মানজন ও সুখী জীবন অতিবাহিত করার লক্ষ্যে, এবং তা কারও নিজেরই স্বার্থে, মানবিক ও নৈতিক হওয়ার উদ্দেশ্যে। তিনি মনে করতেন, ‘সৎ জীবনযাপন মানেই সম্মানজনক জীবনযাপন’ এবং ‘ন্যায়পরায়ন ব্যক্তি সুখী, অন্যায়কারীর জীবন শোচনীয়।

সিজারকে তার প্রাপ্য দাও, ঈশ্বরকে তার প্রাপ্যঃ যীশুর আরেকটি সুপ্রসিদ্ধ বাণী হচ্ছে, ‘সিজারকে দাও যা তার প্রাপ্য এবং ঈশ্বরকে দাও যা ঈশ্বরের প্রাপ্য’ (ম্যাথিউ ২২:২১), যা কিনা পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে রাষ্ট্রকে উপাসনালয় থেকে পৃথক করতে সাহায্য করেছে। এ বাণীর মূলমন্ত্রটিও সক্রেটিসের শিক্ষার মাঝে অন্তর্নিহিত। একদিকে সক্রেটিস অন্যায় সরকারী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পক্ষে ছিলেন যাতে রাষ্ট্র সেগুলোকে সংশোধন কোরে ভালতর সমাজব্যাবস্থা অর্জনের লক্ষ্যে, অন্যদিকে তিনি ভাবতেন নাগরিকদের উচিত রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের অনুগত হওয়া, রাষ্ট্র-বিবেচিত শাস্তি মেনে নেওয়া ইত্যাদি।

তাইতো মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত সক্রেটিসকে এক বন্ধু জেল থেকে পালানো ও এ্যাথেন্স ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তিনি মনে করতেন ‘বৈধ সরকারের ও সঠিক আইনী প্রক্রিয়ার অনুগত হওয়া ছিল তাঁর নৈতিক দায়বদ্ধতা, এবং সক্রেটিস এ্যাথেন্সকে ভালবাসতেন এবং অন্যত্র জীবনকে উপভোগ করবেন না মনে করতেন’।

যীশুকে পাকড়াও করার পরও আমরা তার মাঝে অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গির চিহ্ন দেখি। তার গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে যীশু অনুসারীদেরকে সহিংসতা থেকে নিরুৎসাহিত করেন, এবং অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই রোমান কর্তৃপক্ষের মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি মেনে নিয়ে এটাকে ‘স্বর্গীয় অভিপ্রায়’ হিসেবে উপস্থাপন করতঃ বলেন, ‘শাস্ত্রীয় বিধান অবশ্যই পূর্ণতা পাবে’ (মার্ক ১৪:৫১, ম্যাথিউ ২৬:৫৪)।

গস্পেলে যীশুর এসব বিশেষ শিক্ষাগুলো ছাড়াও তার আরেক প্রসিদ্ধ শিক্ষা, ব্যাভিচারীকে শাস্তি না দেওয়া, মুসার আইনে যার শাস্তি পাথর-ছুড়ে হত্যা, সেটাও তার ভাবনায় সেকালে ফিলিস্তিনে বিরাজমান সহনশীল হেলিনীয় সংস্কৃতির প্রভাবেরই ফসল মাত্র। যীশু গসপেলে ‘অমর আত্মার’ ধারনা উপস্থাপন করতঃ বলেন, ‘যারা দেহকে হত্যা করতে চায় তাদেরকে ভয় করো না, কেননা তারা আত্মাকে হত্যা করতে পারবে না’ (ম্যাথিউ ১০:২৮)।

ইহুদী ধর্মশাস্ত্র তৌরাত বা ওল্ড টেস্টামেন্টে আত্মার ধারনা অনুপস্থিত। অথচ গ্রিক দার্শনিক ও আধ্যাত্বিক ভাবনায় আত্মার ধারনাটি যীশুর জন্মের বেশ কয়েক শতাব্দী আগেই সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। উল্লেখ্য সক্রেটিসের নৈতিক ও আধ্যাত্বিক ভাবনার মূলে ছিল ‘আত্মার কল্যান’ সাধন – যা ইতিমধ্যে আলোচণা করা হয়েছে।

মিশরে যিশুর শৈশবঃ আমরা দেখেছি যে, খ্রিস্ট বাইবেলের প্রসিদ্ধ নৈতিক শিক্ষা ও আধ্যাত্বিক ভাবনাগুলো প্রাচীন গ্রিসে যিশুর জন্মের শতশত বছর আগেই উদ্ভূত হয়েছিল। ফিলিস্তিনিরা আলেকজান্ডারের সময় হেলিনিয় ও পরবর্তীতে গ্রিকো-রোমান সভ্যতার অংশ হয়ে পড়ে, এবং সে পরিবেশেই যিশুর জন্ম ও বড় হওয়া। এবং এসব নৈতিক ও আধ্যাত্বিক ভাবনাগুলোকে ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে গ্রহণ করে যিশুর ধর্ম প্রচার মিশন থেকে বোঝা যায়, হেলিনিয় সভ্যতার অন্তর্ভূক্ত গ্রিক ও অন্যান্য এশীয় ভাবধারা ফিলিস্তিনের ইহুদি সমাজকে, অন্তত এর অংশ-বিশেষকে, কতটা প্রভাবিত করেছিল! যিশুর মিশরে বড় হওয়া আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয়।

বিভিন্ন তথ্যমতে যিশু ৬ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত মিশরে বাস করেন। আলেকজান্ডারের নির্দেশানুসারে নির্মিত মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরটি পরবর্তীতে হেলিনীয় সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র, ইহার বুদ্ধিবৃত্তিক কারখানা, হিসেবে রূপ লাভ করেছিল। সে-যুগের সেরা গ্রিক দার্শনিকগণ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জন্য আলেকজান্দ্রিয়ার সুবিখ্যাত পাঠাগারে জড়ো হতেন। ঐতিহাসিকভাবে এর আগে ইহুদীরা সাধারণত কখনও ধর্ম-বহির্ভূত বিষয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় আগ্রহ দেখায় নি।

অথচ আলেকজান্দ্রিয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার উর্বরতা এতটাই প্রেরণাদায়ক ছিল যে, আমরা দেখি কিছু ইহুদি সেখানেই প্রথম বৈশ্বিক বিষয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক চর্চায় অংশ নিতে শুরু করে। তাদের মধ্যে ছিল যিশুর সমসাময়িক হেলিনিয় ইহুদি দার্শনিক ফিলো জুদিয়াস (20 BC–50 AD), যিনি প্রাচীন গ্রিক প্রজ্ঞাশীলতা, বিশেষত বৈরাগ্যবাদকে (Stoicism) তার দার্শনিক কর্মে অন্তর্ভূক্ত করেন।

সেকালে মিশরে ইহুদিদেরকে ঘিরে বিদ্যমান আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, তা হচ্ছে জোর ইহুদি-বিরোধী প্রচারণা ও উত্তেজনা। গ্রিক শাসনাধীনে আসার পর বিজিত মিশরিয়দেরকে সুযোগ-সুবিধার জন্য ইহুদিদের সাথে একই শর্তে প্রতিযোগিতা করতে হতো, কেননা উভয়ই নাগরিকত্ব বহির্ভূত বিবেচিত ছিল। কাজেই ইহুদীরা স্থানীয় মিশরিয়দের সাথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুযোগে সমানে সমান প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে বাধ্য হলে মিশরিয়দের মাঝে ক্রমেই ইহুদি-বিরোধী অসন্তোষ দানা বাধতে থাকে এবং মিশরিয় সাহিত্য ও বক্তৃতায় ইহুদি-বিদ্বেষ ধ্বনিত হতে থাকে।

যিশুর সমকালীন মিশরিয় বক্তা অ্যাপিওন (মৃঃ খ্রি: ৪৫) ছিলেন এক খ্যাতনামা ইহুদি-বিদ্বেষ প্রচারক। ইহুদি-বিরোধী প্রচারণা সেখানে তখন এতটাই জোরদার ছিল যে, ইহুদি বুদ্ধিজীবি জোসেফাস নিজ ধর্মীয় গোষ্ঠীর সমর্থনে অ্যাপিওনের সবচেয়ে বিষাক্ত ইহুদি-বিরোধী বক্তব্যগুলো খণ্ডন করতঃ ‘এগেইন্সট অ্যাপিওন’ শীর্ষক এক নিবন্ধ রচনা করেন। এসব বিদ্বেষমূলক প্রচারণাগুলো – হোক সে মিশরিয় কিংবা রোমান লেখক, দার্শনিক বা রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিত্ব লিখিত – তার মূলে ছিল ইহুদি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও ভাবধারাকে সমালোচনা বা আঘাত করা – বিশেষত ইহুদিদের অসামাজিক ও বিচ্ছিন্নতা-মুখী মনোভাব, এবং ইহুদি ধর্মের নির্মম ও অসহনশীল বিধানগুলো।

যিশুর সময়ে অ্যাপিওন ও সহযোগীদের ইহুদি-বিদ্বেষী প্রচারণা মিশরে তুঙ্গে উঠেছিল ছিল, যা শীঘ্রই সহিংসতা ও দাঙ্গায় রূপ নিতে শুরু করে যিশুর মৃত্যুর (৩৩ সাল) মাত্র কয়েক বছর পরে (৩৮-৪১ সাল)। ঘরের পাশে মিশরে ইহুদি-বিরোধী এসব প্রচারণা ও অসন্তোষ অবশ্যই যিশুর মনে প্রভাব ফেলার কথা।

পরবাসে ভিন্ন বাস্তবতার সম্মুখীন ইহুদি জাতিঃ ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত ইহুদিরা প্রথমত গ্রিকো-হেলিনিস্ট ও অতঃপর গ্রিকো-রোমান সাম্রাজ্যের পরবাসী জীবনে ২টি অপরিচিত বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। (১) তারা নির্বাসনে ব্যাপক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা ও সার্বজনীন সহনশীলতা দেখতে পায়, যা ছিল তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ভাবধারা ও অভিজ্ঞতা থেকে খুবই ভিন্ন। (২) অন্যদিকে তারা তাদের অসামাজিক ও অসহনশীল সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ভাবধারার কারণে বিদ্বেষী প্রচারণার সম্মুখীন হয়, যার বিরুদ্ধে তাদের হাতে জবাব ছিল সীমিত। এ পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনের কিংবা নির্বাসনের ইহুদি সমাজের অপেক্ষাকৃত উদার অংশ হেলিনিয় সংস্কৃতির সার্বজনীন সহনশীলতা ও মানবিকতার ভাবধারায় বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়ে। সেই সাথে পরবর্তীতে সমালোচকদের ইহুদি-বিদ্বেষী প্রচারণা তাদেরকে নিঃসন্দেহে বিচলিত করে। ফলে আমরা দেখি ফিলিস্তিনে ও নির্বাসনে উভয় জায়গাতেই সমাজের সম্ভ্রান্ত অংশ হেলিনিয় সংস্কৃতিতে আবিষ্ট হয়ে পড়ে।

হেলিনিয় সহনশীলতা ও উদারতার প্রভাবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজস্ব কট্টর ও অসহনশীল ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রতি এতটাই বিরূপ মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠে যে, জেরুজালেম গির্জার পুরোহিত জেইসন ও মেনিলাউস ও তাদের হেলিনিজম-মুখী সমর্থকরা সম্রাট এপিফেনিস-এর ফিলিস্তিনি ইহুদি সমাজকে জোরপূর্বক হেলিনিয়করণ প্রক্রিয়াকে সক্রিয় সমর্থন দেয় (খ্রি:পূ: ১৭০-১৬০-এর দশক)। এমনকী তারা সম্রাট এপিফেনিসের ইহুদি ধর্ম বিলুপ্তকরণমূলক রাজকীয় ঘোষণাপত্রকেও সমর্থন দেয়। এর প্রায় ২ শতাব্দী পর মিশরে বসবাসকারী যিশু নিঃসন্দেহে বিদ্যমান গ্রিকো-হেলিনিস্ট সভ্যতা ও সংস্কৃতির উদারতা, সহনশীলতা ও অন্তর্নিহিত সার্বজনীন সুর দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।

অন্যদিকে তার সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে চলমান বিদ্বেষী প্রচারণাও তাকে নিঃসন্দেহে বিচলিত করতো। হতে পারে এ অভিজ্ঞতাই যিশুকে ইহুদিবাদের সংস্কারে উদ্দীপিত করেছিল, কিংবা ব্যক্তিগত অনুপ্রেরণা বা ঐশ্বরিক নির্দেশে তিনি ধর্মীয় প্রচারণার মিশন হাতে নেন। তবে সমালোচকগণ ইহুদি ধর্মের যেসব বিষয়কে কেন্দ্র করে ইহুদি-বিদ্বেষী প্রচারণা চালাতেন, যিশুর ধর্মীয় সংস্কার প্রচেষ্টায় সে বিষয়গুলোর উপর জোর দিতে দেখা যায় এবং তার ধর্মীয় সংস্কার প্রক্রিয়ার সার্বিক উদ্দেশ্য কট্টর ও অসহনশীল ইহুদি ধর্ম ও সংস্কৃতিকে হেলিনিয় সহনশীলতা, প্রজ্ঞা ও সার্বজনীনতার সাথে একাত্মকরণমূলক মনে হয়। এবং তা করতে গিয়ে যিশুকে সক্রেটিসের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও ভাবনাকে তার গসপেলে সংযুক্ত করতে দেখা যায়, যা মুসার আইনের পুরোপুরি বিপরীতধর্মী।

খ্রিস্টধর্মীয় তত্ত্বে প্রাচীন মিশরিয় ধর্মের প্রভাবঃ যিশুর ধর্মীয় তত্ত্বে সক্রেটিসের শিক্ষা ও ভাবনা তথা গ্রিক বা হেলিনিয় প্রভাব ছাড়াও অন্যান্য, বিশেষত মিশরিয় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ভাবনার, যথেষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। শৈশবে যিশুর বাসভূমি মিশর, যা ছিল পৃথিবীর প্রসিদ্ধ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী এক প্রাচীনতম অগ্রগামী সভ্যতা। এবং খ্রিস্টধর্মের বেশকিছু মৌলিক তত্ত্ব ও বৈশিষ্ট মিশরিয় ধর্ম ও সংস্কৃতিতে বিদ্যমান ছিল বলে খোঁজ পাওয়া যায় – যেমন (১) যিশুই ঈশ্বর কিংবা এক কুমারী সতী নারীর গর্ভে জাত ঈশ্বরের পুত্র, (২) তার ১২জন শিষ্য, (৩) তাকে শুলে চড়িয়ে হত্যা, (৪) কবর থেকে মৃত যিশুর পুনরুত্থান, (৫) ধর্মীয় প্রতীক ক্রুশ ইত্যাদি।

মিশরিয় ঈশ্বর ওসিরিস ও পুত্র হোরাস সম্পর্কিত আখ্যান ও খ্রিস্টধর্মীয় ঈশ্বর ও ঈশ্বর পুত্র সম্পর্কিত আখ্যানের মাঝে বিশেষ মিল রয়েছে। অসিরিস মানব ইতিহাসের সবচেয়ে পুরাতন ঈশ্বরদের মাঝে অন্যতম, যার নাম পালেরমো প্রস্তরে খ্রি:পূ: ২৫০০ সালে খোদিত দেখা যায় এবং খ্রিস্ট ধর্মের উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত মিশরে পূজিত হতেন। ওসিরিস ছিলেন পরকালে মৃতদের জন্য করুণাশীল বিচারক, জীবনদাতা, ও ‘ভালবাসার গুরু’। করুণা, ভালবাসা ও জীবনদান – এই তিনটি খ্রিস্ট ইশ্বরেরও মৌলিক বৈশিষ্ট্য।

ওসিরিস-এর উপাখ্যানে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু এবং পুনরুত্থানের কাহিনীও বর্তমান। ওসিরিসের ভাই সেট, যে ছিল মন্দের প্রতীক এবং মরুভূমি, ঝড়-তুফান ও বিশৃংখলার দেবতা, সে ওসিরিসকে হত্যা করে। ওসিরিসের স্ত্রী আইসিস তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ খুঁজে পায় এবং মন্ত্র পড়ে তাকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলে। এই ঘটনার স্মৃতিচারণে মিশরীয়রা ১৩ই নভেম্বরে এক উৎসব পালন করতো। উৎসবটির প্রথম পর্বে একটি প্রকাশ্য নাটকে ওসিরিসকে নির্মমভাবে হত্যা ও ক্ষতবিক্ষত করা দেখানো হতো; দ্বিতীয় পর্বে স্ত্রী আইসিস কর্তৃক তার মৃতদেহ খোজাখুজি ও উদ্ধার এবং পুনরুত্থিত ওসিরিসের বিজয়ীর বেশে প্রত্যাবর্তন, এবং সবশেষে ওসিরিসের পুত্র হোরাসের হাতে শয়তান সেট-এর পরাজয় প্রদর্শিত হতো।

ত্রাণকর্তা যীশুর মিল রয়েছে প্রাচীন মিশরিয় আরেক দেবতা ‘শেদ’-এর সাথে, যার নামের অর্থ ত্রাণকর্তা। শেদ পরিত্রাণের প্রতীক এবং তাকে হোরাস, বিশেষত ‘শিশু হোরাস’-এর প্রতিরূপ গণ্য করা হয়। হোরাস ও খ্রিস্টধর্মের মাঝে এক শক্ত সংযোগ পাওয়া যায় প্রাথমিক যুগের খ্রিস্টানদের কবরে স্থাপিত প্রতিকৃতিতে। কবর থেকে উদ্ধারকৃত এক তাবিজে একপাশে যিশু ও অন্যপাশে হোরাসরূপী শেদ-এর ছবি দেখতে পাওয়া যায়। ওসিরিস সম্পর্কে মিশরিয়দের ধারনা ব্যাখ্যা করতঃ স্যার ই, এ, উয়ালিস বাজ লিখেছেনঃ

‘সকল যুগের মিশরিয়রাই বিশ্বাস করতেন যে, ওসিরিস ছিল স্বর্গ উদ্ভূত; তিনি শয়তানী শক্তির হাতে মৃত্যুবরণ ও ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন; এক বিরাট লড়াইয়ের পর তিনি পুনরুত্থিত হন এবং অতঃপর যমরাজ্যের অধিশ্বর ও মৃতদের বিচারক হন; এবং তিনি যেহেতু মৃত্যুকে জয় করেছিলেন, পুণ্যবানরাও অনুরূপে মৃত্যুকে জয় করতে পারবে।

ওসিরিসের উপাখ্যানের সাথে যিশুর কাহিনীর সংযোগ ব্যাখ্যা করতে স্যার বাজ লিখেন, “খ্রিস্টান মিশরিয়রা ওসিরিসের মাঝে যিশুর নমুনা খুঁজে পায়, এবং পুত্র হোরাসকে দুগ্ধপানকারী আইসিসের ছবি ও ভাস্কর মূর্তি থেকে তারা কুমারী মেরি ও শিশু যিশুর প্রতিকৃতির ধারনা পায়।”
খ্রিস্টান-পূর্ব যুগে ব্যবহৃত ‘ক্রুশ’ প্রতীকঃ খ্রিস্টধর্মের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকি পরিচিতি হচ্ছে ‘ক্রুশ’। খ্রিস্টপূর্ব মিশরীয়, এমনকী গ্রিক, উপাখ্যানে পরিত্রাণের উপায়রূপী ঈশ্বর বা প্রতীক ছিল, যা ‘ক্রুশ’ আকৃতির।

প্রাচীন মিশরিয় জেদ স্তম্ভ, যা কিনা দুই বোন কর্তৃক ঘেরা ওসিরিসের মেরুদণ্ড ও স্থিতিশীলতার প্রতীক – সেটা দেখতে অনেকটা ক্রুশে চড়ানো যিশুর মত। মিশরীয় প্রতিকৃতিতে ওসিরিসের স্ত্রী আইসিসকে ক্রুশ আকৃতিতে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা দেখতে ঠিক ক্রুশে চড়ানে যিশুর মত। এমনকি নানান মিশরিয় বন্দনাগীতি ও কফিন লিপিতে সূর্যদেবতা হোরাসকে আকাশে উড়ন্ত পাখাধারী বাজপাখী রূপে প্রদর্শন করা হয়েছে, যা দেখতে অনেকটা ক্রুশ আকৃতির। আবার মৃত ওসিরিসকে জীবিত করতে হোরাস জীবন দানের প্রতীক হিসেবে ‘ক্রুশ আকৃতির হুক (আঙটা)’ ব্যবহার করেন, যা খ্রিস্টধর্মে যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণকে মানবজাতির পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে উপস্থাপন বা বিবেচনার অনুরূপ।

মিশরের বাইরে গ্রিক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কল্পকাহিনীতেও ‘ক্রুশ’ প্রতিকৃতি বিদ্যমান ছিল। গ্রিক পুরানের অ্যান্দ্রোমেদা নামক কথিত ইথিউপীয় রাজকন্যা, ইংরেজীতে যে ‘চেইন্ড লেডি’ নামে পরিচিত, তাকে দেখানো হয় প্রস্তরখণ্ডে শৃংখলায়ীত যেখান থেকে স্বামী পার্সিউস তাকে উদ্ধার করে। গ্রিক কল্পকাহিনীতে জ্ঞানের দেবতা প্রমিথিউস, মানবজাতিকে জ্ঞানের প্রদীপ দানের কারণে ঈশ্বর জিউস যাকে শাস্তি দিয়েছিল, তাকেও অনেকক্ষেত্রে পাহাড়-চূড়ায় প্রস্তরখণ্ডে শৃংখলায়িত দেখা যায়। প্রস্তরখণ্ডে শৃংখলায়িত অ্যান্দ্রোমেদা ও প্রমিথিউস দেখতে প্রায় ক্রুশে চড়ানো যিশুর মত। অন্যদিকে খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ সালের দিকের এক ফুলদানীতে প্রমিথিউসকে এক খাম্বায় শৃংখলায়ীত দেখা যায়, যা দেখতে ঠিক ক্রুশে চড়ানো যিশুর প্রতিকৃতির মত।

অন্যদিকে প্লেটো তার গ্রন্থে (৩৬০ খ্রি:পূঃ) বিশ্ব-আত্মাকে আকাশে ভাসমান এক ‘স্বর্গীয় ক্রুশ’রূপে উপস্থাপন করেন। প্লেটোর ‘স্বর্গীয় ক্রুশ’ সম্পর্কে প্রাথমিক যুগের চার্চ-ফাদার জাস্টিন মার্টার (মৃঃ 165 AD) তার ‘ফার্স্ট অ্যাপোলোজি’ গ্রন্থের ‘প্লেটোস ডক্ট্রিন অব দ্যা ক্রস’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে (৬০/১) লিখেছেনঃ এবং গ্রন্থে ঈশ্বরের পুত্রের শারীরিক বর্ণনায় প্লেটো লিখেছেন, ‘তিনি তাকে ক্রুশ আকারে আসমানে স্থাপন করলেন।’ খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিক রেভঃ হিউগো রাহনার-এর মত প্রাথমিক যুগের খ্রিস্টানদের মতে এটা ছিল, ‘ক্রুশবিদ্ধ স্বর্গীয় বিশ্ব-নির্মাতার একটা পৌত্তলিক অনুকৃতি, যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ব্যপ্ত এবং ইহাকে ক্রুশের রহস্যের চারিদিকে ঘূর্ণমান রাখে।’

রচনাটিকে ছোট রাখতে আলোচনা আর না বাড়িয়ে মোটামুটি নিশ্চয়তার সাথেই বলা যায় যে, খ্রিস্টধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিকৃতি যে ‘ক্রুশ’, তা যিশুর সময়ে মিশরিয় ও গ্রিক ধর্মীয় গাথায় প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত হতো। খ্রিস্টধর্ম সম্ভবত সেখান থেকে প্রতীকটিকে আত্মস্থ করেছে।

ফরাসি ইতিহাসবিদ চার্লস দুপিউস (মৃঃ ১৮০৯) জানান, রোমান সূর্যদেবতা জেনাস-এর ঠিক যিশুর মত বৈশিষ্ট্য ছিল – যেমন কুমারীর গর্ভে জন্মলাভ, পুনরুত্থান ও ১২জন শিষ্য ইত্যাদি। তিনি লিখেছেন, কবে আমরা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরব এক ঈশ্বরের ভাণধরা ইতিহাস, যিনি কুমারী মাতার গর্ভে দক্ষিণায়নের দিন (উইন্টার সলস্টিস, ~২২ ডিসেম্বর) জন্মগ্রহণ করেন, যিনি নরকে ডুবার পর ঈস্টারে (বসন্তে দিবারাত্রি সমান দৈর্ঘ্যের দিন) পুনরুত্থিত হন, যার পেছনে থাকে ১২জন ধর্ম-প্রচারক শিষ্য, যাদের গুরুর (অর্থাৎ যিশু) রয়েছে জেনাসের সকল বৈশিষ্ট্য।

তিনি অন্ধকার জগতের রাজপুত্রকে জয়কারী এক ঈশ্বর, যিনি মানবজাতিকে আলোর রাজ্যে পুনর্স্থাপিত করেন, এবং যিনি প্রকৃতির মন্দ দিক জয় করেন – যা কিনা শুধুই এক সৌর কল্পকাহিনী অনুরূপভাবে হার্ব কাটনার লিখেছেন, প্রায় সবগুলো সূর্য-দেবতারই মা হিসেবে রয়েছে এক অক্ষত কুমারী... যিশুর মতই মিথ্রা ও অন্যান্য সূর্য-দেবতার জন্মদিন ছিল ২৫ ডিসেম্বরের আশেপাশে এবং তার ১২জন অ্যাপোসল অবশ্যই রাশিচক্রের ১২টি প্রতীকের অনুরূপ। যখন যিশু (যে ছিল ন্যায়পরায়নতার সূর্য) ক্রুশবিদ্ধ হয়, তার সাথে স্বভাবতই সূর্যও মারা যায়, অর্থাৎ অস্তমিত হয়। এবং পরদিন, অর্থাৎ ইস্টারের দিন, সূর্যের সাথে সে আবার পুনরুত্থিত হয়।

কাজেই এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, খ্রিস্টটধর্মের সবগুলো ভিত্তিমূলক বৈশিষ্ট্য ও প্রতিকৃতিই – যেমন যিশুর কুমারী মাথার গর্ভে জন্ম, ১২জন অপেসলপোসল, ক্রুশবিদ্ধকরণ, পূনরুত্থান ও খৃষ্টধর্মীয় প্রতীক ‘ক্রুশ’, এগুলোর সবই যীশুর জন্ম-পূর্ব মিশরীয় ও গ্রিক পৌত্তলিক ধর্মে ও পৌরানিক আখ্যানে প্রচলিত ছিল।

প্রাথমিক খ্রিস্টান পণ্ডিতদের লেখায়ও সেটা প্রমাণিত হয়। যেমন খ্যাতনামা খিস্টোনদের লেখক টার্টুলিয়ান (মৃঃ ২২০ সাল) সমকালীন পৌত্তলিকদেরকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, আমরা আগেই দেখিয়েছি যে, তোমাদের দেবতারা এসেছে ‘ক্রুশ’ আকৃতির প্রতিকৃতি থেকে। কিন্তু তোমরা বিজয়কেও পূজা করো, কেননা তোমাদের বিজয়স্মারকগুলোর কেন্দ্রস্থলে থাকে ‘ক্রুশ’। রোমান শিবিরে ধর্মচর্চা যুদ্ধ পতাকার পূজা মাত্র, যেখানে পতাকাকে সকল দেবতাদের উপর স্থাপন করা হয়। আন, পতাকা থেকে গড়িয়ে পড়া প্রতিকৃতিগুলো ‘ক্রুশ’ আকৃতির অলঙ্কার ছাড়া আর কিছুই না। তোমাদের পতাকা ও ব্যানারগুলো থেকে ঝুলন্ত অলঙ্কারগুলো ‘ক্রুশ’ আকৃতির জামা মাত্র।

এখানে টার্টুলিয়ান সুস্পষ্ট করে বলছেন যে, খৃষ্টপূর্ব পৌত্তলিক ধর্মগুলোতে ঈশ্বরকে ‘ক্রুশ’ আকৃতির প্রতীকরূপে ব্যবহার করা হতো। আরেক রচনায় তিনি এটাকে আরও সুস্পষ্ট করে তোলেনঃ পৌত্তলিকরা নিজেরাই ‘ক্রুশ’কে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে ব্যাপক ব্যবহার করেছে, তাদের নিজেদের দেবমূর্তিকে ‘ক্রুশ’ আকৃতির একটা কাঠামোর উপর বানানো হতো।

প্রাথমিক যুগের আরেক খৃষ্টান লেখক ফেলিক্স মিনিকিউস (লেখার কাল ১৫০-২৭০ সাল) খৃষ্টপূর্ব পৌত্তলিক সমাজে ক্রুশের ব্যবহার সুবিস্তৃত ছিলঃ বরং তোমরাই কাঠের ঈশ্বরকে পূজার জন্য পবিত্রায়িত করো, কাঠের ক্রুশকে ভালবাস – সম্ভবত তোমাদের ঈশ্বরের অংশ হিসেবে। তোমাদের প্রত্যেকটি পতাকা এবং ব্যানার – সেগুলো সোনায় মোড়া ও অলঙ্কারিত ক্রুশ ছাড়া আর কি? তোমাদের বিজয়স্মারকগুলো শুধু একটা ক্রুশের অনুকৃতিই নয়, তাতে একজন মানুষও জোড়া লাগানো থাকে।

অন্যত্র ফাদার জাস্টিন মার্টার সুস্পষ্ট করে বলেন যে, খৃষ্টানরা কেবল ক্রুশ প্রতীকটির ধারনাই পৌত্তলিকদের থেকে গ্রহণ করে নি, কুমারী মায়ের গর্ভে মানুষ-রূপে ঈশ্বরের জন্ম, তাকে ক্রুশবিদ্ধ করণ, তার পুনরুত্থান ও স্বর্গে উড্ডয়নের ধারনাও যখন আমরা এটাও বলি যে, ঈশ্বরের প্রথম সন্তান ‘শব্দ’ কোন যৌনমিলন ছাড়াই জন্মেছিল, যে আমাদের শিক্ষক যীশু খৃষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ করে মারা হয়েছিল, এবং তিনি জেগে উঠেন ও স্বর্গে উত্থিত হন, তখন আমরা এমন কিছু বলি না, যা তোমরা জুপিটারের সম্মানিত পুত্রদের ব্যাপারে বিশ্বাস করো না
এ পর্বে আলোচিত হয়েছেঃ যীশুর মেসিয়া মিশনের আসল উদ্দেশ্য কী ছিল? যীশুর কোন রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ছিল কি? ছিল কি রোমান শাসকদের সাথে তার কোন রকম বোঝাপড়া? এবং বাস্তব যীশুর অস্তিত্ব বিনাও খ্রিস্টধর্মের উৎপত্তি সম্ভব ছিল কি?

যীশুর জন্ম ও জীবনকালে ফিলিস্তিন ও পরদেশে ইহুদী সমাজ কী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, এতক্ষণে পাঠকবৃন্দ তা কিছুটা উপলব্ধি করতে পারবে।এবং সে পরিস্থিতিই সম্ভবত যীশুকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ইহুদী ধর্মের সংস্কারের মিশনে, এবং অপ্রত্যাশিতভাবে তার চূড়ান্ত ফলাফল হয় একটা নতুন ধর্মের উৎপত্তি।

আমরা দেখি যীশু সাম্রাজ্যবাদী রোমানদের প্রতি আনুগত্য দেখাতে ইহুদীদেরকে উপদেশ দেন।তাহলে ফিলিস্তিনের রোমান শাসকদের সাথে যীশুর কোনরূপ বোঝাপড়া ছিল কি? অসম্বভব নয়।কারণ ইহুদী ধর্মীয় তত্ত্ব বা মুসার বিধান অনুসারে ইহুদীরা হচ্ছে ঈশ্বরের চয়নকৃত জনগোষ্ঠী, খোদ ঈশ্বরের সম্পত্তি (ডিউঃ ৭:৬)। ইহুদীরা দাসত্ব করবে, সেবা করবে, শুধুই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের (জেহভার) – ঈশ্বরের আইন ও বিধান প্রতিপালনের মাধ্যমে।তারা ইহুদী-বহির্ভূত কর্তৃপক্ষের দাসত্ব ও বশ্যতা মেনে নেবে না।বরং তৌরাতের বিধান অনুযায়ী ঈশ্বরের চয়নকৃত জনগোষ্ঠী হিসেবে ইহুদীরা অন্য জনগোষ্ঠীর উপর রাজত্ব করবে, অন্যরা ইহুদীদের জন্য দাসত্ব খাটবে, ইহুদীদের সেবা করবে। যেমনঃ

(১) ‘তোমরা যুদ্ধের জন্য ভিন্ন জনগোষ্ঠীর জনপদের দ্বারে পৌঁছে প্রথমে তাদেরকে শান্তিচুক্তির প্রস্তাব দাও।তারা শান্তি প্রস্তাবে রাজী হয়ে তোমাদের জন্য জনপদের দরজা উন্মুক্ত করলে সেখানকার সব মানুষকে তোমরা জোরপূর্বক তোমাদের জন্য বেগার খাটতে বাধ্য করবে। (ডিউঃ ২০:১০-১৬)

(২) ‘বিদেশীরা তোমাদের শহরের দেয়াল নির্মাণ করবে এবং তাদের রাজাগণ তোমাদের সেবা করবে... তোমাদের শহরের দরজা সর্বদা, দিন-রাত, খোলা থাকবে যাতে বিদেশীরা তাদের ধনসম্পদ তাদের রাজাদের তত্ত্বাবধানে যখন-তখন আনতে পারে।যেসব জাতি বা রাজ্য তোমাদের সেবা করবে না, তারা ধ্বংস হবে; তাদেরকে নির্মমভাবে গুড়িয়ে দেওয়া হবে... (ইসাঃ ৬০:১০-১২)

(৩) অপরিচিতরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমাদের গরু-ছাগলকে ঘাস খাওয়াবে; তোমাদের জমি চাষ করবে এবং আঙুরবাগান পরিচর্চা করবে।তোমাদেরকে বলা হবে ঈশ্বরের প্রতিনিধি; জনগণ তোমাদেরকে ঈশ্বরের যাজক হিসেবে সম্মান করবে; তোমরা অন্যান্য জাতির সম্পদ উপভোগ করবে, এবং অন্যের ধনসম্পদে তোমরা গৌরবান্বিত হবে। (ইসাঃ ৬১:৫-৬)

অথচ যীশুর গস্পেলে (ম্যাথিউ ২২:২১) আমরা যীশুকে বলতে দেখি – সীজারকে (রোমান শাসককে) দাও যা তার প্রাপ্য, যা নিঃসন্দেহে পৌত্তলিক রোমান রাজশক্তির সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের উপদেশ মাত্র, এবং ইহুদী ঈশ্বরীয় বিধানের বিরুদ্ধাচরণ।
যীশুর রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা? খৃষ্টানরা দাবী করে যে, যীশুর মিশরের উদ্দেশ্য ছিল শুধুই আধ্যাত্বিক, রাজনৈতিক নয়; তাই তিনি রোমান শাসকদের সাথে টেক্কা দেওয়া থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করেন।

যীশুর মিশন শুধুই আধ্যাত্বিক ছিল – এ দাবীটির যথার্থতা যাচাই করা প্রয়োজন। ফিলিস্তিনে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ২টি স্তর বিদ্যমান ছিল।রোমানরা ছিল সর্বেসর্বা সাম্রাজ্যবাদী রাজশক্তি।দ্বিতীয় স্তরে ইহুদীদের প্রত্যেকটি শহরে থাকত স্যানহেদ্রিন নামক ইহুদী সামাজিক-রাজনৈতিক পরিষদ।পরিষদগুলোর প্রতিনিধিত্ব করতো ২৩ থেকে ৭১ গণ্যমান্য ইহুদী ব্যক্তির এক কমিটি এবং তারা ইহুদী সমাজের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়াদি পরিচালনা করতো।ফিলিস্তিনে রোমান শাসকরা স্যানহেদ্রিনের সাথে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে তাদের শাসনকার্য চালাতো।

কথা হচ্ছে, যীশু যদিও শোষণকারী ও প্রায়শঃ নির্মম সাম্রাজ্যবাদী রোমানদের প্রতি আনুগত্য দেখানোর নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু স্যানহেদ্রিন-এর ব্যাপারে তার ভিন্ন প্রত্যাশা ছিল।তিনি স্যানহেদ্রিন প্রতিনিধিদেরকে কড়া ও প্রায়শঃ আক্রমণাত্মক ও অশালীন ভাষায় গালাগালি করেন, তাদেরকে শিক্ষাগুরু বলে ডাকা থেকে বিরত থাকতে ইহুদীদের উপদেশ দেন এবং দাবী করেন, কেবল যীশু নিজে শিক্ষাগুরু হওয়ার যোগ্য (ম্যাথিউ ২৩)।অন্য কথায়, যীশু নিজে স্যানহেদ্রিন পরিষদের নেতৃত্ব নিতে চেয়েছিলেন।

ফলে এটা অনুমান করা অযৌক্তিক নয় যে, যীশুর রোমান শাসকদের সাথে এমন একটা বোঝাপড়া ছিল যে, ঘনঘন ইহুদী বিদ্রোহ ও রক্তপাতে সিক্ত ফিলিস্তিনে তিনি ইহুদীদেরকে রোমান রাজশক্তির অনুগত করার চেষ্টা চালাবেন, স্বভাবত কট্টর ও অসহনশীল ইহুদীদেরকে সহনশীল ও গ্রিকো-রোমান সংস্কৃতি ও ভাবধারার সাথে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করবেন ইত্যাদি।এরূপ অনুমানের সপক্ষে গস্পেলে ইঙ্গিতও পাওয়া যায়।যেমন গস্পেলে উল্লেখ আছে যে, ফিলিস্তিনের রোমান শাসকরা যীশুর কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য সম্পর্কে উয়াকিবহাল ছিল, এমনকি সম্ভবত তার মিশনের পক্ষপাতি ছিল।

ফিলিস্তিনে প্রথমত সিলিউসিদ ও পরে রোমান শাসকরা রক্তক্ষয়ী ইহুদী বিদ্রোহের সম্মুখীন হয়েছে বার বার।প্রকৃতপক্ষে ফিলিস্তিনে ইহুদী বিদ্রোহ উভয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মেরুদণ্ডই নড়বড়ে করে ফেলার জন্য দায়ী ছিল।ক্ষুদ্র ভূখণ্ড ফিলিস্তিনের ছোট্ট ইহুদী জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তারা যেরূপ ভয়ঙ্কর ও দৃঢ় প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়, তা আর কোথাও হয় নি।

যীশুর সমসাময়িক কালে ফিলিস্তিনে রোমান শাসন – খৃঃপূঃ ৬৩ অব্দে রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিদ্বন্দ্বী পম্পি দ্যা গ্রেইট ফিলিস্তিনকে রোমান সাম্রাজ্যের সাথে সংযুক্ত করলে ইহুদীরা প্রবল বিরোধীতা করে এবং তাদের সে অসন্তোষ আর কখনোই স্তিমিত হয় নি।এরপর খৃষ্টীয় ৬ সালে জুদিয়া অঞ্চলকে সরাসরি রোমান শাসনের অধীনে আনলে ইহুদীরা প্রথম সঙ্ঘবদ্ধ বিদ্রোহ শুরু করে, যার উদ্যোক্তা ছিল জিলোট নামধারী গোড়া ইহুদী সম্প্রদায়।রোমান শাসকরা তা নির্মমতার সাথে দমন করে।

কিন্তু ইহুদী সম্প্রদায়ের মাঝে অসন্তোষ নিরবে জমা বাধতে থাকে, যা ১৬-১৭ খৃষ্টাব্দে আবার অস্থিরতায় রূপ নেয় এবং রোমান প্রতিনিধি পিলেট-এর শাসনকালে (২৬-৩৬ সাল) তা বিকট বিদ্রোহরূপে জ্বলে উঠে।এরূপ অস্থিরতার সময়ে অত্যুৎসাহী ত্রাণকারী ধর্মগুরুরা পরবাস থেকে ফিলিস্তিনে এসে বিদ্রোহে যোগ দিত।ঐতিহাসিক সেসিল রথ-এর মতে যীশু ছিলেন এমন এক বিপ্লবী ধর্মগুরু, যাকে পিলেট ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করে।

পিতৃভূমি ফিলিস্তিনে ইহুদীদের এ অদম্য চেতনার খোজ পাওয়ায় যায় সেখানে প্রথম বহির্দেশীয় দখলদার এ্যাসিরীয়দের সময় থেকেই।পারস্য সম্রাট সিরাস দ্যা গ্রেট (মৃঃ খৃঃপূঃ ৫২৩) এ্যাসিরীয়দের দ্বারা ধ্বংসকৃত ফেরুজালেম গীর্জা পুনর্নিমাণের অনুমতি দিলেও সম্রাটের ফিলিস্তিনস্থিত প্রতিনিধিরা গীর্জাটি মেরামতের বিরোধীতা করেছিল ধর্মীয় কারণে ইহুদীদের চিরাচরিত বিদ্রোহী চরিত্রের কারণে।এবং সেলিউসিদ সম্রাট এ্যাপিফেনিসের হেলিনাইজেশনের বিরুদ্ধে খৃঃপূঃ ১৬০-এর দশকে যে ধ্বংসাত্মক হাসমোনিয়ান বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে, তার আগুন পরবর্তী রোমান শাসনামলে যীশুর সময় (১-৩৩ সাল)পর্যন্ত।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url