আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু একজন বাঙালি পদার্থবিদ, উদ্ভিদবিদ ও জীববিজ্ঞানী এবং প্রথম দিকের একজন কল্পবিজ্ঞান রচয়িতা। তাঁর গবেষণা ফলে উদ্ভিদবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে তোলে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহারিক ও গবেষণাধর্মী বিজ্ঞানের সূচনা করে। জগদীশ চন্দ্র বসু ১৮৫৮ সালের ৩০শে নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি অঞ্চলের ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে তাঁর পরিবারের প্রকৃত বাসস্থান ছিল।
বাঙালিরাও বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে নিউটন-আইনস্টাইনের চেয়ে কম যায়না তিনি তা প্রমাণ করেন। জগদীশ চন্দ্র যে গ্যালিলিও-নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী তার স্বীকৃতি দিয়েছিল লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকা, ১৯২৭ সালে। আর আইনস্টাইন তার সম্পর্কে নিজেই বলেছেন জগদীশচন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে কোনটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঋষিতুল্য বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু সম্পর্কে বলেছেন ভারতের কোনও বৃদ্ধ ঋষির তরুণ মূর্তি তুমি হে আর্য আচার্য জগদীশ।
আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর কথা মনে হলেই মনে পড়ে এই বিজ্ঞানীই প্রমাণ করেছিলেন গাছের প্রাণ আছে। কথাটা কিন্তু সর্বাংশে সত্যি নয়। গাছের প্রাণ আছে বলেই বীজ থেকে চারা গজায়। চারা থেকে আস্তে আস্তে বড় হয়ে বৃক্ষে পরিণত হয় আবার একসময় মরে যায়। প্রাণ না থাকলেতো জন্ম-মৃত্যুর চক্রে গাছের জীবন আবর্তীত হতোনা! আমাকে জীবিকার প্রয়োজনে, পেশার প্রয়োজনে দেশের আনাচে-কানাচে যেতে হয়।
পাহাড়-জঙ্গল-মাঠ-নদী-খাল-বিল-গ্রাম-প্রান্তরে যেতে হয়েছে। পথ চলতে কত রকমের যে ঘাসফুল দেখেছি! দেখেছি লজ্জাবতী লতাকে পায়ের স্পর্শে লজ্জাবনত হতে! শুধু ছোট বেলায় নয়, বড় হয়ে, বুড়ো হয়েও লজ্জাবতী লতা দেখলে পাতা ছুঁয়ে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারিনা! বিশেষ করে লতানো ডালের মাথার দিকের কচি পাতা। ঐ কচি পাতার মাথার দুই পাতাকে আলতো করে স্পর্শ করলে এক জোড়া এক জোড়া করে পাতা বন্ধ হয়ে যেত। গাছের প্রাণ না থাকলে লজ্জাবতী কি আমার স্পর্শে সাড়া দিত?
মে ১০, ১৯০১। লন্ডনের রাজকীয় বিজ্ঞান সমিতির কেন্দ্রীয় মিলনায়তন। দীর্ঘদিন এখানে এত লোকের ভিড়ে কোনো বিজ্ঞানী বক্তব্য দেননি। এই বিজ্ঞানী আবার এসেছেন সাত সাগরের ওপার অর্থাৎ ভারত থেকে। দর্শকদের মধ্যে রয়েছেন লর্ড রেইলির মতো বিজ্ঞানকূল শিরোমণি। দর্শকেরা অবশ্য খুব বেশি চমত্কৃত হলেন না পরীক্ষার বন্দোবস্ত দেখে। একটি গাছের মূল একটি বোতলের পানির মধ্যে দেওয়ার ব্যবস্থা, গাছ থেকে কী সব তারটার টেনে এটা কিম্ভূতদর্শন যন্ত্রের সঙ্গে লাগানো।
দর্শকদের জ্ঞাতার্থে বিজ্ঞানী জানালেন, বোতলের ভেতরের তরল পদার্থটি পানি নয়, এটি ব্রোমাইড সলিউশন। উপস্থিত বিজ্ঞানের লোকেরা বুঝলেন অচিরেই গাছটি মরবে। কারণ, হাইড্রোব্রোমিক অ্যাসিডের এই লবণের দ্রবণ সহ্য করার ক্ষমতা গাছের নেই। তাতে অবশ্য তাঁদের ভ্রুক্ষেপ নেই। তাঁদের লক্ষ্য কিম্ভূত যন্ত্রটি।
বিজ্ঞানী গাছের মূলকে সলিউশনে দিয়ে দিলেন আর চালু করে দিলেন তাঁর যন্ত্র। চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটি কাগজের ওপর মানুষের হৃদযন্ত্রের ওঠানামার মতো গ্রাফ আঁকতে শুরু করল। তবে সেটিতে তেমন কোনো চাঞ্চল্য নেই। পেন্ডুলামের মতো একই নিয়মের ওঠানামা। কিন্তু একটু পরই যন্ত্রের গ্রাফে ব্যাপক চাঞ্চল্য দেখা দিল। গ্রাফ বেশ দ্রুত ওঠানামা শুরু করল। মনে হচ্ছে কার সঙ্গে যেন লড়ছে গাছটি। তবে একসময় সব চাঞ্চল্য থেমে গেল। উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা দেখলেন, গাছটি মরে গেছে!
উপস্থিত বিজ্ঞানী ও দর্শকেরা সবাই চমত্কৃত হলেন ভারতীয় বাঙালি বিজ্ঞানীর এই যন্ত্রে। লর্ড রেইলি উঠে গিয়ে দর্শক সারিতে বসা বিজ্ঞানীর স্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে এলেন। উদ্ভিদেরও প্রাণীদের মতো প্রাণ আছে, এই ধারণা কিন্তু নতুন নয়। কারণ, সবাই দেখেছে বীজ থেকে চারা হয়, সেটি মহিরুহ হয় এবং একসময় মরে যায়। কিন্তু উদ্দীপনায় উদ্ভিদও প্রাণীর মতো প্রতিক্রিয়া করে, জোর করে মেরে ফেলা হলে আর্তচিত্কার করে—এমনটা কেউ এর আগে ভাবেননি। ভেবেছেন ওই বাঙালি বিজ্ঞানী। গাছের প্রাণ নয়, আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু প্রমাণ করেছিলেন, উদ্ভিদ ও প্রাণী জীবনের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। এক কথায় উদ্ভিদজীবন প্রাণীজীবনের ছায়া মাত্র।
আজ ৩০ নভেম্বর। আজ এই বিখ্যাত বাঙ্গালের জন্মদিন। জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্ম ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে। সে সময় তাঁর বাবা ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ভগবান চন্দ্র বসু ছিলেন ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। এর পূর্বে তিনি ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ভগবান চন্দ্রই ছিলেন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক। পরবর্তিতে তিনি বর্ধমান ও অন্যান্য কিছু অঞ্চলের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বও পালন করেন।
ইংরেজ সরকারের অধীনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও ভগবান চন্দ্র নিজের ছেলেকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করাননি। জগদীশ চন্দ্রের প্রথম স্কুল ছিল ময়মনসিংহ জিলা স্কুল। বাংলা স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব যুক্তি ছিল। তিনি মনে করতেন ইংরেজি শেখার আগে এদেশীয় ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা আয়ত্ব করা উচিত। বাংলা স্কুলে পড়ার ব্যাপারটি জগদীশ চন্দ্রের জীবনে যেমন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে তেমনি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতেও সাহায্য করেছে।
এর প্রমাণ বাংলা ভাষায় রচিত জগদীশের বিজ্ঞান প্রবন্ধগুলো। ভাষার প্রতি বিশেষ মমত্ববোধ ছাড়াও ভগবান চন্দ্র চেয়েছিলেন তার পুত্র দেশের আপামর জনসাধারণের সাথে মিলেমিশে মানুষ হোক এবং তার মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হোক। তাঁর প্রথম জীবনে বাংলা স্কুলের অধ্যায় জগদীশ চন্দ্রের পরবর্তী জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ছাপ ফেলেছিল।
জগদীশ কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে পড়াশোনা করে ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। এই কলেজে ইউজিন ল্যাফন্ট নামক একজন খ্রিষ্টান যাজক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ওপর তাঁর আগ্রহ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরপর তিনি আইসিএস পরীক্ষায় বসার জন্য ইংল্যান্ডে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও ভগবান চন্দ্র এতে রাজী হননি কারণ তিনি চেয়েছিলেন তাঁর পুত্র একজন বিদ্বান হোন।
বাবার ইচ্ছা ও তার আগ্রহে তিনি ১৮৮০ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান পাঠের উদ্দেশ্যেই লন্ডনে যান, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে বেশিদিন এই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। তাঁর ভগ্নীপতি আনন্দমোহন বসুর আনুকূল্যে জগদীশ চন্দ্র প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্বন্ধে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে ট্রাইপস পাশ করেন। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাশ করেন।
জগদীশ চন্দ্র ১৮৮৫ সালে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে ফিরে আসার সময় বড়লাট লর্ড রিপনকে লেখা ইংরেজ অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ হেনরী ফসেট-এর একটা চিঠি নিয়ে এসেছিলেন। বড়লাট রিপনের অনুরোধে জনশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক স্যার আলফ্রেড ক্রফট জগদীশ চন্দ্রকে প্রেসিডেন্সী কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ দেন। প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যক্ষ চার্লস হেনরী টনী ঐ নিয়োগের বিরোধিতা করলেও তা মেনে নিতে বাধ্য হন। প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দিতেই তিনি বৈষম্যের শিকার হন। তাঁকে কলেজ থেকে গবেষণা করার জন্য কোন সুযোগসুবিধা দেওয়া হয়নি।
উপরন্তু তাঁকে বর্ণবৈষম্যের শিকার হতে হয়। সময় ইংরেজ অধ্যাপকদের বেতন দেওয়া হত ৩০০টাকা আর ভারতীয় অধ্যাপকদের বেতন ছিল ২০০ টাকা। যেহেতু জগদীশ চন্দ্র অস্থায়ী পদে যোগ দিয়েছিলেন, সেহেতু তাঁর বেতন ধরা হয়েছিল ১০০টাকা মাত্র। এই বৈষম্যের প্রতিবাদে জগদীশ চন্দ্র বেতন নিতে অস্বীকার করেন এবং বিনা বেতনে অধ্যাপনার দায়ীত্ব পালন করে গেছেন। অবশেষে জনশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক এবং প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যক্ষ তাদের ভুল বুঝতে পারেন এবং জগদীশ চন্দ্রকে তাঁর প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যাপনার পদে যোগদানের দিন থেকে চাকরি স্থায়ীকরণের পাশাপাশি ইংরেজ অধ্যাপকদের সমান, মাসে ৩০০টাকা হিসাবে বকেয়া বেতন এককালীন পরিশোধ করেন।
তখন থেকেই ইউরোপীয় ও ভারতীয় অধ্যাপকদের বেতনের বৈষম্য দূরীভূত হয়। ইউরোপীয় শিক্ষকদের অনেকেই মনে করতেন ভারতীয়রা বিজ্ঞান শিক্ষাদান এবং গবেষণা কাজের উপযুক্ত নয়। জগদীশ তাদের এই ধারণা ভুল প্রমাণিত করেন। তার সফলতার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর হাতে গড়ে উঠা একদল কৃতী শিক্ষার্থী যাদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, দেবেন্দ্রমোহন বসু, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞান মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার প্রথম আঠারো মাসে জগদীশ যে সকল গবেষণা কাজ সম্পন্ন করেছিলেন তা লন্ডনের রয়েল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়। এই গবেষণা পত্রগুলোর সূত্র ধরেই লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৯৬ সালের মে মাসে তাকে ডিএসসি ডিগ্রী প্রদান করে। এই গবেষণাগুলো একটু ভিন্ন আঙ্গিকে বিচার করতে হবে। প্রতিদিন নিয়মিত ৪ ঘন্টা শিক্ষকতার পর যেটুকু সময় পেতেন সেই সময়টুকুতে তিনি গবেষণার কাজ করতেন।
তার উপর প্রেসিডেন্সি কলেজে তখন তেমন উন্নতমানের কোন গবেষণাগার ছিলনা। অর্থ সংকটও ছিল প্রকট। সীমিত ব্যয়ে স্থানীয় মিস্ত্রীদেরকে শিখিয়ে পড়িয়ে তিনি পরীক্ষণের জন্য উপকরণ প্রস্তুত করতেন। তাঁর এই গবেষণা কর্মগুলোর গুরুত্ব বিবেচনা করেই ইংল্যান্ডের লিভারপুলে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এই বক্তৃতার সাফল্যের পর তিনি বহু স্থান থেকে বক্তৃতার নিমন্ত্রণ পান। এর মধ্যে ছিল রয়েল ইন্সটিটিউশন, ফ্রান্স এবং জার্মানি। সফল বক্তৃতা শেষে ১৮৯৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনি সস্ত্রীক দেশে ফিরে আসেন।
১৮৮৭ সালে ব্রাহ্ম সমাজের বিখ্যাত সংস্কারক দুর্গা মোহন দাসের কন্যা অবলা দাসের সঙ্গে জগদীশচন্দ্র বসুর বিয়ে হয়। বিয়ের আগে অবলা দাস কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে চাইলেও তাকে ভর্তি হতে দেয়া হয়নি, কারণ সেখানে তখন কলকাতা মেডিকেল কলেজে মেয়েদের পড়া নিষেধ ছিল। ১৮৮২ সালে বঙ্গ সরকারের বৃত্তি নিয়ে অবলা মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই) যান পড়াশোনার উদ্দেশ্যে।
সেখানে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অধ্যয়ন শুরু করলেও অসুস্থতার কারণে কলকাতায় ফিরে আসতে বাধ্য হন। তাঁদের বিয়ের সময় জগদীশচন্দ্র বসু আর্থ সংকটের মধ্যে ছিলেন। তার উপর প্রতিবাদী জগদীশ তখন কলেজ থেকে বেতন নিতেন না। এছাড়া জগদীশের বাবার কিছু ঋণ ছিল যার কারণে তার পরিবারকে পথে বসতে হয়। ঐ আর্থিক দুরাবস্থা থেকে অবলা ও জগদীশ অনেক কষ্টে বেরিয়ে আসেন এবং সব ঋণ পরিশোধ করতে সমর্থ হন। ঋণমুক্ত হবার পর মাত্র অল্প কিছুদিন জগদীশের বাবা-মা জীবিত ছিলেন।
প্রেসিডেন্সী কলেজে জগদীশ চন্দ্র বসুর যোগদানের প্রথম আঠারো মাসের গবেষণার মধ্যে মুখ্য বিষয় ছিল অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা। ১৮৯৫ সালে তিনি অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি এবং কোনো তার ছাড়া এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তা প্রেরণে সাফল্য পান। ১৮৮৭ সালে জার্মান বিজ্ঞানী হেনরীখ হার্ৎজ (১৮৫৭-১৮৯৪) প্রতক্ষভাবে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম প্রায় ৫ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট তরঙ্গ তৈরী করেন। এ ধরণের তরঙ্গকেই বলা হয় অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভ। আধুনিক রাডার, টেলিভিশন এবং মহাকাশ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই তরঙ্গের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মূলত এর মাধ্যমেই বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ তথ্যের আদান প্রদান ঘটে থাকে।
ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে লিভারপুলে দেওয়া তাঁর বক্তৃতার বিষয় ছিল অন ইলেকট্রিক ওয়েভ্স। মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে করা গবেষণা ও পরীক্ষণগুলোর ওপর ভিত্তি করেই তিনি বক্তৃতা করেন, যা ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদেরকে চমকে দেয়। এই বিষয়ের উপর ‘টাইম্স' সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়, এ বছর ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের সম্মিলনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বিদ্যুৎ তরঙ্গ সম্পর্কে অধ্যাপক বসুর বক্তৃতা।
১৮৯৬ সালে জগদীশ চন্দ্র বসু বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও সম্মেলনে বক্তৃতা করার জন্য ইউরোপ যান। তার বক্তৃতার বিষয় বস্তু ছিল অদৃশ্য আলোক। তার পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতা শুনে বৈজ্ঞানিক অলিভার লজ, লর্ড কেলভিন বিলেতেই অধ্যাপনা করার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানান, কিন্তু দেশ ছেড়ে তিনি বিদেশে থাকতে চাননি। তাই তিনি দেশে ফিরে আসেন।
১৮৯৮ সালের ১৯ জানুয়ারিতে তাঁর বক্তৃতার বিয় ছিল অন দ্য পোলারাইজেশন অফ ইলেকট্রিক রেইস তথা বিদ্যুৎরশ্মির সমাবর্তন। এই বক্তৃতয় তাঁর সাফল্য ছিল সবচেয়ে বেশি। বিজ্ঞানী লর্ড রয়্যাল তাঁর বক্তৃতা শুনে এবং পরীক্ষাগুলো দেখে বলেছিলেন, এমন নির্ভুল পরীক্ষা এর আগে কখনও দেখিনি! এ যেন মায়াজাল। বিজ্ঞানী জেম্স ডিউয়ার পত্রিকায় লিখেছিলেন; একজন খাঁটি বাঙালি লন্ডনে সমাগত, চমৎকৃত ইউরোপীয় বিজ্ঞানীমণ্ডলীর সামনে দাঁড়িয়ে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অত্যন্ত দুরূহ বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন - এ দৃশ্য অভিনব। এই বক্তৃতার পর তিনি ফ্রান্স এবং জার্মানিতে বক্তৃতা দেন। এ সময় বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক কর্ন তার বন্ধু হইয়ে যান এবং তিনি ফ্রান্সের বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞান সমিতি এর সদস্য মনোনীত হন।
তার পর্যায়ভিত্তিক গবেষণার ক্ষেত্র ছিল: বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ, জৈব ও অজৈব পদার্থের উত্তেজনার প্রতি সাড়া প্রদানের ক্ষমতা এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীর পেশির তুলনামূলক শারীরবৃত্ত। ১৯১৬ সালে তিনি অধ্যাপনার কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের দু’বছরের মধ্যে, ১৯১৭ সালের ৩০ নভেম্বর তিনি ‘জগদীশ চন্দ্র বসু বিজ্ঞানমন্দির’ প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি সেই বিজ্ঞানমন্দিরে গবেষণা পরিচালনা করেন।
বিজ্ঞান শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে জগদীশ চন্দ্রের সফলতার কথা সর্বজন স্বীকৃত। জগদীশ চন্দ্র যে গ্যালিলিও-নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী তার স্বীকৃতি দিয়েছিল লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকা, ১৯২৭ সালে। জগদীশ চন্দ্র বসুর প্রতিভা, তাঁর গবেষণা ও আবিস্কারের বর্ণনা এই ক্ষুদ্র পরিসরে দেওয়া সম্ভব নয়। তাঁর প্রতিভার সরল স্বীকারোক্তি পাওয়া যায় ১৯৭৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পদক বিজয়ী বৃটিশ পদার্থবিদ স্যার নেভিল ফ্রান্সিস মট এর বক্তব্যে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনায় অবস্থিত ১২ মিটার টেলিস্কোপে যে ১.৩ মিলিমিটার মাল্টিবীম রিসিভার ব্যবহার করা হচ্ছে তার মূলেও রয়েছে জগদীশ চন্দ্রের গবেষণালব্ধ ফল যা তার ১৮৯৭ সালের এক গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।
তিনি শুধু বিজ্ঞানীই ছিলেননা। তিনি বাংলা ভাষায় রচিত কল্পবিজ্ঞান কাহিনী রচয়িতাদের মধ্যে প্রথম কয়েকজনের একজন। তাঁর লেখা নিরুদ্দেশের কাহিনী (১৮৯৬), অব্যক্ত (১৯২১), পলাতক তুফান কল্পবিজ্ঞান বিষয়ের উপর রচনায় তাঁর পাণ্ডিত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আজও বিদ্যমান। তাঁর এইসব রচনা বোধিসত্ত্ব চট্টোপাধ্যায়ের হাতে ইংরেজি ভাষাতেও অনুদিত হয়েছে।
তাঁর গবেষণা উদ্ভিদবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে তোলে এবং তাঁর মাধ্যমেই ভারত উপমহাদেশে ব্যবহারিক ও গবেষণাধর্মী বিজ্ঞানের সূচনা হয়। ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স তাঁকে রেডিও বিজ্ঞানের জনক হিসাবে অভিহিত করে। ১৯১৬ সালে ইংরেজ সরকার তাঁকে নাইট উপাধি দেন। ১৯২০ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। জগদীশচন্দ্র বসুই ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি রয়াল সোসাইটির সদস্যপদ লাভ করেন।
১৯২৭ সালে নির্বাচিত হন ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি। ১৯২৮ সালে ভিয়েনার এক একাডেমি অব সাইন্সের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন লিগ অফ ন্যাশন্স কমিটি ফর ইনটেলেকচুয়াল কো-অপারেশন -এর সদস্য। তিনি ছিলেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সাইন্সেস অফ ইন্ডিয়া-এর প্রতিষ্ঠাতা ফেলো, যার বর্তমান নাম ইন্ডিইয়ান ন্যাশনাল সাইন্স একাডেমি। ১৯৩৫ সালে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি ডিগ্রী প্রদান করা হয়।
এই মহান জ্ঞানতাপস ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বরে বিহারের গিরিডিতে মৃত্যুবরণ করেন। আজ তাঁর জন্মদিনে বিজ্ঞান চিন্তা সংগঠণ ও জেসি বোস ইন্সটিটিউটের যৌথ উদ্যোগে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর পৈত্রিক ভিটা মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগরের রাঢ়িখালে আয়োজন করা হয়েছে বর্ণাঢ্য কর্মসূচীর। অনুষ্ঠানের আয়োজক কমিটির প্রধান সুখেন চন্দ্র বন্দ্যোপাধায়ের বক্তব্য থেকে জানা যায় এবারের অনুষ্ঠানে আচার্য জগদীশ-এর এক নাতনী রুণা চৌধুরীসহ পাঁচজন গুণী অংশ নিবেন এবং এবারের আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ হবে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু স্মরণে সাড়ে তিনশ' পাতার এক স্মারকগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন।
মানুষের স্মৃতিশক্তি মাপার সর্বপ্রথম যান্ত্রিক মডেল তৈরি করেছিলেন জগদীশ চন্দ্র বসু। আজ আমরা ঠিক সেই মডেল ব্যবহার না করলেও বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা যতদিন থাকবে – বেঁচে থাকবে জগদীশ বসুর কীর্তি, জাগরুক থাকবে তাঁর জীবনস্মৃতি।
বাঙালিরাও বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে নিউটন-আইনস্টাইনের চেয়ে কম যায়না তিনি তা প্রমাণ করেন। জগদীশ চন্দ্র যে গ্যালিলিও-নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী তার স্বীকৃতি দিয়েছিল লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকা, ১৯২৭ সালে। আর আইনস্টাইন তার সম্পর্কে নিজেই বলেছেন জগদীশচন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে কোনটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঋষিতুল্য বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু সম্পর্কে বলেছেন ভারতের কোনও বৃদ্ধ ঋষির তরুণ মূর্তি তুমি হে আর্য আচার্য জগদীশ।
আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর কথা মনে হলেই মনে পড়ে এই বিজ্ঞানীই প্রমাণ করেছিলেন গাছের প্রাণ আছে। কথাটা কিন্তু সর্বাংশে সত্যি নয়। গাছের প্রাণ আছে বলেই বীজ থেকে চারা গজায়। চারা থেকে আস্তে আস্তে বড় হয়ে বৃক্ষে পরিণত হয় আবার একসময় মরে যায়। প্রাণ না থাকলেতো জন্ম-মৃত্যুর চক্রে গাছের জীবন আবর্তীত হতোনা! আমাকে জীবিকার প্রয়োজনে, পেশার প্রয়োজনে দেশের আনাচে-কানাচে যেতে হয়।
পাহাড়-জঙ্গল-মাঠ-নদী-খাল-বিল-গ্রাম-প্রান্তরে যেতে হয়েছে। পথ চলতে কত রকমের যে ঘাসফুল দেখেছি! দেখেছি লজ্জাবতী লতাকে পায়ের স্পর্শে লজ্জাবনত হতে! শুধু ছোট বেলায় নয়, বড় হয়ে, বুড়ো হয়েও লজ্জাবতী লতা দেখলে পাতা ছুঁয়ে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারিনা! বিশেষ করে লতানো ডালের মাথার দিকের কচি পাতা। ঐ কচি পাতার মাথার দুই পাতাকে আলতো করে স্পর্শ করলে এক জোড়া এক জোড়া করে পাতা বন্ধ হয়ে যেত। গাছের প্রাণ না থাকলে লজ্জাবতী কি আমার স্পর্শে সাড়া দিত?
মে ১০, ১৯০১। লন্ডনের রাজকীয় বিজ্ঞান সমিতির কেন্দ্রীয় মিলনায়তন। দীর্ঘদিন এখানে এত লোকের ভিড়ে কোনো বিজ্ঞানী বক্তব্য দেননি। এই বিজ্ঞানী আবার এসেছেন সাত সাগরের ওপার অর্থাৎ ভারত থেকে। দর্শকদের মধ্যে রয়েছেন লর্ড রেইলির মতো বিজ্ঞানকূল শিরোমণি। দর্শকেরা অবশ্য খুব বেশি চমত্কৃত হলেন না পরীক্ষার বন্দোবস্ত দেখে। একটি গাছের মূল একটি বোতলের পানির মধ্যে দেওয়ার ব্যবস্থা, গাছ থেকে কী সব তারটার টেনে এটা কিম্ভূতদর্শন যন্ত্রের সঙ্গে লাগানো।
দর্শকদের জ্ঞাতার্থে বিজ্ঞানী জানালেন, বোতলের ভেতরের তরল পদার্থটি পানি নয়, এটি ব্রোমাইড সলিউশন। উপস্থিত বিজ্ঞানের লোকেরা বুঝলেন অচিরেই গাছটি মরবে। কারণ, হাইড্রোব্রোমিক অ্যাসিডের এই লবণের দ্রবণ সহ্য করার ক্ষমতা গাছের নেই। তাতে অবশ্য তাঁদের ভ্রুক্ষেপ নেই। তাঁদের লক্ষ্য কিম্ভূত যন্ত্রটি।
বিজ্ঞানী গাছের মূলকে সলিউশনে দিয়ে দিলেন আর চালু করে দিলেন তাঁর যন্ত্র। চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটি কাগজের ওপর মানুষের হৃদযন্ত্রের ওঠানামার মতো গ্রাফ আঁকতে শুরু করল। তবে সেটিতে তেমন কোনো চাঞ্চল্য নেই। পেন্ডুলামের মতো একই নিয়মের ওঠানামা। কিন্তু একটু পরই যন্ত্রের গ্রাফে ব্যাপক চাঞ্চল্য দেখা দিল। গ্রাফ বেশ দ্রুত ওঠানামা শুরু করল। মনে হচ্ছে কার সঙ্গে যেন লড়ছে গাছটি। তবে একসময় সব চাঞ্চল্য থেমে গেল। উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা দেখলেন, গাছটি মরে গেছে!
উপস্থিত বিজ্ঞানী ও দর্শকেরা সবাই চমত্কৃত হলেন ভারতীয় বাঙালি বিজ্ঞানীর এই যন্ত্রে। লর্ড রেইলি উঠে গিয়ে দর্শক সারিতে বসা বিজ্ঞানীর স্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে এলেন। উদ্ভিদেরও প্রাণীদের মতো প্রাণ আছে, এই ধারণা কিন্তু নতুন নয়। কারণ, সবাই দেখেছে বীজ থেকে চারা হয়, সেটি মহিরুহ হয় এবং একসময় মরে যায়। কিন্তু উদ্দীপনায় উদ্ভিদও প্রাণীর মতো প্রতিক্রিয়া করে, জোর করে মেরে ফেলা হলে আর্তচিত্কার করে—এমনটা কেউ এর আগে ভাবেননি। ভেবেছেন ওই বাঙালি বিজ্ঞানী। গাছের প্রাণ নয়, আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু প্রমাণ করেছিলেন, উদ্ভিদ ও প্রাণী জীবনের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। এক কথায় উদ্ভিদজীবন প্রাণীজীবনের ছায়া মাত্র।
আজ ৩০ নভেম্বর। আজ এই বিখ্যাত বাঙ্গালের জন্মদিন। জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্ম ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে। সে সময় তাঁর বাবা ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ভগবান চন্দ্র বসু ছিলেন ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। এর পূর্বে তিনি ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ভগবান চন্দ্রই ছিলেন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক। পরবর্তিতে তিনি বর্ধমান ও অন্যান্য কিছু অঞ্চলের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বও পালন করেন।
ইংরেজ সরকারের অধীনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও ভগবান চন্দ্র নিজের ছেলেকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করাননি। জগদীশ চন্দ্রের প্রথম স্কুল ছিল ময়মনসিংহ জিলা স্কুল। বাংলা স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব যুক্তি ছিল। তিনি মনে করতেন ইংরেজি শেখার আগে এদেশীয় ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা আয়ত্ব করা উচিত। বাংলা স্কুলে পড়ার ব্যাপারটি জগদীশ চন্দ্রের জীবনে যেমন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে তেমনি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতেও সাহায্য করেছে।
এর প্রমাণ বাংলা ভাষায় রচিত জগদীশের বিজ্ঞান প্রবন্ধগুলো। ভাষার প্রতি বিশেষ মমত্ববোধ ছাড়াও ভগবান চন্দ্র চেয়েছিলেন তার পুত্র দেশের আপামর জনসাধারণের সাথে মিলেমিশে মানুষ হোক এবং তার মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হোক। তাঁর প্রথম জীবনে বাংলা স্কুলের অধ্যায় জগদীশ চন্দ্রের পরবর্তী জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ছাপ ফেলেছিল।
জগদীশ কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে পড়াশোনা করে ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। এই কলেজে ইউজিন ল্যাফন্ট নামক একজন খ্রিষ্টান যাজক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ওপর তাঁর আগ্রহ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরপর তিনি আইসিএস পরীক্ষায় বসার জন্য ইংল্যান্ডে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও ভগবান চন্দ্র এতে রাজী হননি কারণ তিনি চেয়েছিলেন তাঁর পুত্র একজন বিদ্বান হোন।
বাবার ইচ্ছা ও তার আগ্রহে তিনি ১৮৮০ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান পাঠের উদ্দেশ্যেই লন্ডনে যান, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে বেশিদিন এই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। তাঁর ভগ্নীপতি আনন্দমোহন বসুর আনুকূল্যে জগদীশ চন্দ্র প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্বন্ধে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে ট্রাইপস পাশ করেন। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাশ করেন।
জগদীশ চন্দ্র ১৮৮৫ সালে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে ফিরে আসার সময় বড়লাট লর্ড রিপনকে লেখা ইংরেজ অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ হেনরী ফসেট-এর একটা চিঠি নিয়ে এসেছিলেন। বড়লাট রিপনের অনুরোধে জনশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক স্যার আলফ্রেড ক্রফট জগদীশ চন্দ্রকে প্রেসিডেন্সী কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ দেন। প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যক্ষ চার্লস হেনরী টনী ঐ নিয়োগের বিরোধিতা করলেও তা মেনে নিতে বাধ্য হন। প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দিতেই তিনি বৈষম্যের শিকার হন। তাঁকে কলেজ থেকে গবেষণা করার জন্য কোন সুযোগসুবিধা দেওয়া হয়নি।
উপরন্তু তাঁকে বর্ণবৈষম্যের শিকার হতে হয়। সময় ইংরেজ অধ্যাপকদের বেতন দেওয়া হত ৩০০টাকা আর ভারতীয় অধ্যাপকদের বেতন ছিল ২০০ টাকা। যেহেতু জগদীশ চন্দ্র অস্থায়ী পদে যোগ দিয়েছিলেন, সেহেতু তাঁর বেতন ধরা হয়েছিল ১০০টাকা মাত্র। এই বৈষম্যের প্রতিবাদে জগদীশ চন্দ্র বেতন নিতে অস্বীকার করেন এবং বিনা বেতনে অধ্যাপনার দায়ীত্ব পালন করে গেছেন। অবশেষে জনশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক এবং প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যক্ষ তাদের ভুল বুঝতে পারেন এবং জগদীশ চন্দ্রকে তাঁর প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যাপনার পদে যোগদানের দিন থেকে চাকরি স্থায়ীকরণের পাশাপাশি ইংরেজ অধ্যাপকদের সমান, মাসে ৩০০টাকা হিসাবে বকেয়া বেতন এককালীন পরিশোধ করেন।
তখন থেকেই ইউরোপীয় ও ভারতীয় অধ্যাপকদের বেতনের বৈষম্য দূরীভূত হয়। ইউরোপীয় শিক্ষকদের অনেকেই মনে করতেন ভারতীয়রা বিজ্ঞান শিক্ষাদান এবং গবেষণা কাজের উপযুক্ত নয়। জগদীশ তাদের এই ধারণা ভুল প্রমাণিত করেন। তার সফলতার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর হাতে গড়ে উঠা একদল কৃতী শিক্ষার্থী যাদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, দেবেন্দ্রমোহন বসু, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞান মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার প্রথম আঠারো মাসে জগদীশ যে সকল গবেষণা কাজ সম্পন্ন করেছিলেন তা লন্ডনের রয়েল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়। এই গবেষণা পত্রগুলোর সূত্র ধরেই লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৯৬ সালের মে মাসে তাকে ডিএসসি ডিগ্রী প্রদান করে। এই গবেষণাগুলো একটু ভিন্ন আঙ্গিকে বিচার করতে হবে। প্রতিদিন নিয়মিত ৪ ঘন্টা শিক্ষকতার পর যেটুকু সময় পেতেন সেই সময়টুকুতে তিনি গবেষণার কাজ করতেন।
তার উপর প্রেসিডেন্সি কলেজে তখন তেমন উন্নতমানের কোন গবেষণাগার ছিলনা। অর্থ সংকটও ছিল প্রকট। সীমিত ব্যয়ে স্থানীয় মিস্ত্রীদেরকে শিখিয়ে পড়িয়ে তিনি পরীক্ষণের জন্য উপকরণ প্রস্তুত করতেন। তাঁর এই গবেষণা কর্মগুলোর গুরুত্ব বিবেচনা করেই ইংল্যান্ডের লিভারপুলে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এই বক্তৃতার সাফল্যের পর তিনি বহু স্থান থেকে বক্তৃতার নিমন্ত্রণ পান। এর মধ্যে ছিল রয়েল ইন্সটিটিউশন, ফ্রান্স এবং জার্মানি। সফল বক্তৃতা শেষে ১৮৯৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনি সস্ত্রীক দেশে ফিরে আসেন।
১৮৮৭ সালে ব্রাহ্ম সমাজের বিখ্যাত সংস্কারক দুর্গা মোহন দাসের কন্যা অবলা দাসের সঙ্গে জগদীশচন্দ্র বসুর বিয়ে হয়। বিয়ের আগে অবলা দাস কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে চাইলেও তাকে ভর্তি হতে দেয়া হয়নি, কারণ সেখানে তখন কলকাতা মেডিকেল কলেজে মেয়েদের পড়া নিষেধ ছিল। ১৮৮২ সালে বঙ্গ সরকারের বৃত্তি নিয়ে অবলা মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই) যান পড়াশোনার উদ্দেশ্যে।
সেখানে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অধ্যয়ন শুরু করলেও অসুস্থতার কারণে কলকাতায় ফিরে আসতে বাধ্য হন। তাঁদের বিয়ের সময় জগদীশচন্দ্র বসু আর্থ সংকটের মধ্যে ছিলেন। তার উপর প্রতিবাদী জগদীশ তখন কলেজ থেকে বেতন নিতেন না। এছাড়া জগদীশের বাবার কিছু ঋণ ছিল যার কারণে তার পরিবারকে পথে বসতে হয়। ঐ আর্থিক দুরাবস্থা থেকে অবলা ও জগদীশ অনেক কষ্টে বেরিয়ে আসেন এবং সব ঋণ পরিশোধ করতে সমর্থ হন। ঋণমুক্ত হবার পর মাত্র অল্প কিছুদিন জগদীশের বাবা-মা জীবিত ছিলেন।
প্রেসিডেন্সী কলেজে জগদীশ চন্দ্র বসুর যোগদানের প্রথম আঠারো মাসের গবেষণার মধ্যে মুখ্য বিষয় ছিল অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা। ১৮৯৫ সালে তিনি অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি এবং কোনো তার ছাড়া এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তা প্রেরণে সাফল্য পান। ১৮৮৭ সালে জার্মান বিজ্ঞানী হেনরীখ হার্ৎজ (১৮৫৭-১৮৯৪) প্রতক্ষভাবে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম প্রায় ৫ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট তরঙ্গ তৈরী করেন। এ ধরণের তরঙ্গকেই বলা হয় অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভ। আধুনিক রাডার, টেলিভিশন এবং মহাকাশ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই তরঙ্গের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মূলত এর মাধ্যমেই বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ তথ্যের আদান প্রদান ঘটে থাকে।
ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে লিভারপুলে দেওয়া তাঁর বক্তৃতার বিষয় ছিল অন ইলেকট্রিক ওয়েভ্স। মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে করা গবেষণা ও পরীক্ষণগুলোর ওপর ভিত্তি করেই তিনি বক্তৃতা করেন, যা ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদেরকে চমকে দেয়। এই বিষয়ের উপর ‘টাইম্স' সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়, এ বছর ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের সম্মিলনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বিদ্যুৎ তরঙ্গ সম্পর্কে অধ্যাপক বসুর বক্তৃতা।
১৮৯৬ সালে জগদীশ চন্দ্র বসু বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও সম্মেলনে বক্তৃতা করার জন্য ইউরোপ যান। তার বক্তৃতার বিষয় বস্তু ছিল অদৃশ্য আলোক। তার পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতা শুনে বৈজ্ঞানিক অলিভার লজ, লর্ড কেলভিন বিলেতেই অধ্যাপনা করার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানান, কিন্তু দেশ ছেড়ে তিনি বিদেশে থাকতে চাননি। তাই তিনি দেশে ফিরে আসেন।
১৮৯৮ সালের ১৯ জানুয়ারিতে তাঁর বক্তৃতার বিয় ছিল অন দ্য পোলারাইজেশন অফ ইলেকট্রিক রেইস তথা বিদ্যুৎরশ্মির সমাবর্তন। এই বক্তৃতয় তাঁর সাফল্য ছিল সবচেয়ে বেশি। বিজ্ঞানী লর্ড রয়্যাল তাঁর বক্তৃতা শুনে এবং পরীক্ষাগুলো দেখে বলেছিলেন, এমন নির্ভুল পরীক্ষা এর আগে কখনও দেখিনি! এ যেন মায়াজাল। বিজ্ঞানী জেম্স ডিউয়ার পত্রিকায় লিখেছিলেন; একজন খাঁটি বাঙালি লন্ডনে সমাগত, চমৎকৃত ইউরোপীয় বিজ্ঞানীমণ্ডলীর সামনে দাঁড়িয়ে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অত্যন্ত দুরূহ বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন - এ দৃশ্য অভিনব। এই বক্তৃতার পর তিনি ফ্রান্স এবং জার্মানিতে বক্তৃতা দেন। এ সময় বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক কর্ন তার বন্ধু হইয়ে যান এবং তিনি ফ্রান্সের বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞান সমিতি এর সদস্য মনোনীত হন।
তার পর্যায়ভিত্তিক গবেষণার ক্ষেত্র ছিল: বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ, জৈব ও অজৈব পদার্থের উত্তেজনার প্রতি সাড়া প্রদানের ক্ষমতা এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীর পেশির তুলনামূলক শারীরবৃত্ত। ১৯১৬ সালে তিনি অধ্যাপনার কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের দু’বছরের মধ্যে, ১৯১৭ সালের ৩০ নভেম্বর তিনি ‘জগদীশ চন্দ্র বসু বিজ্ঞানমন্দির’ প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি সেই বিজ্ঞানমন্দিরে গবেষণা পরিচালনা করেন।
বিজ্ঞান শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে জগদীশ চন্দ্রের সফলতার কথা সর্বজন স্বীকৃত। জগদীশ চন্দ্র যে গ্যালিলিও-নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী তার স্বীকৃতি দিয়েছিল লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকা, ১৯২৭ সালে। জগদীশ চন্দ্র বসুর প্রতিভা, তাঁর গবেষণা ও আবিস্কারের বর্ণনা এই ক্ষুদ্র পরিসরে দেওয়া সম্ভব নয়। তাঁর প্রতিভার সরল স্বীকারোক্তি পাওয়া যায় ১৯৭৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পদক বিজয়ী বৃটিশ পদার্থবিদ স্যার নেভিল ফ্রান্সিস মট এর বক্তব্যে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনায় অবস্থিত ১২ মিটার টেলিস্কোপে যে ১.৩ মিলিমিটার মাল্টিবীম রিসিভার ব্যবহার করা হচ্ছে তার মূলেও রয়েছে জগদীশ চন্দ্রের গবেষণালব্ধ ফল যা তার ১৮৯৭ সালের এক গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।
তিনি শুধু বিজ্ঞানীই ছিলেননা। তিনি বাংলা ভাষায় রচিত কল্পবিজ্ঞান কাহিনী রচয়িতাদের মধ্যে প্রথম কয়েকজনের একজন। তাঁর লেখা নিরুদ্দেশের কাহিনী (১৮৯৬), অব্যক্ত (১৯২১), পলাতক তুফান কল্পবিজ্ঞান বিষয়ের উপর রচনায় তাঁর পাণ্ডিত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আজও বিদ্যমান। তাঁর এইসব রচনা বোধিসত্ত্ব চট্টোপাধ্যায়ের হাতে ইংরেজি ভাষাতেও অনুদিত হয়েছে।
তাঁর গবেষণা উদ্ভিদবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে তোলে এবং তাঁর মাধ্যমেই ভারত উপমহাদেশে ব্যবহারিক ও গবেষণাধর্মী বিজ্ঞানের সূচনা হয়। ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স তাঁকে রেডিও বিজ্ঞানের জনক হিসাবে অভিহিত করে। ১৯১৬ সালে ইংরেজ সরকার তাঁকে নাইট উপাধি দেন। ১৯২০ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। জগদীশচন্দ্র বসুই ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি রয়াল সোসাইটির সদস্যপদ লাভ করেন।
১৯২৭ সালে নির্বাচিত হন ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি। ১৯২৮ সালে ভিয়েনার এক একাডেমি অব সাইন্সের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন লিগ অফ ন্যাশন্স কমিটি ফর ইনটেলেকচুয়াল কো-অপারেশন -এর সদস্য। তিনি ছিলেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সাইন্সেস অফ ইন্ডিয়া-এর প্রতিষ্ঠাতা ফেলো, যার বর্তমান নাম ইন্ডিইয়ান ন্যাশনাল সাইন্স একাডেমি। ১৯৩৫ সালে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি ডিগ্রী প্রদান করা হয়।
এই মহান জ্ঞানতাপস ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বরে বিহারের গিরিডিতে মৃত্যুবরণ করেন। আজ তাঁর জন্মদিনে বিজ্ঞান চিন্তা সংগঠণ ও জেসি বোস ইন্সটিটিউটের যৌথ উদ্যোগে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর পৈত্রিক ভিটা মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগরের রাঢ়িখালে আয়োজন করা হয়েছে বর্ণাঢ্য কর্মসূচীর। অনুষ্ঠানের আয়োজক কমিটির প্রধান সুখেন চন্দ্র বন্দ্যোপাধায়ের বক্তব্য থেকে জানা যায় এবারের অনুষ্ঠানে আচার্য জগদীশ-এর এক নাতনী রুণা চৌধুরীসহ পাঁচজন গুণী অংশ নিবেন এবং এবারের আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ হবে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু স্মরণে সাড়ে তিনশ' পাতার এক স্মারকগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন।
মানুষের স্মৃতিশক্তি মাপার সর্বপ্রথম যান্ত্রিক মডেল তৈরি করেছিলেন জগদীশ চন্দ্র বসু। আজ আমরা ঠিক সেই মডেল ব্যবহার না করলেও বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা যতদিন থাকবে – বেঁচে থাকবে জগদীশ বসুর কীর্তি, জাগরুক থাকবে তাঁর জীবনস্মৃতি।