নলেন গুড়ের খেজুর পাটালি: এক টুকরো শীতের স্মৃতি
বর্তমানে শহরের বাজারে যে গুড় পাওয়া যায় তা যে একেবারে খাঁটি তা মোটেও নয়। কারন খেজুরের গুড় উতপাদনে বেশ কয়েকটি ধাপ অনুসরন করতে হিয় ।
নলেন গুড়ের খেজুর পাটালি বাঙালির শীতকালীন সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল প্রতীক। শীতকাল মানেই বাঙালি হেঁসেলে নতুন গুড়ের মিষ্টি গন্ধ, আর এই গন্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে খেজুরের পাটালি গুড়। এই পাটালি গুড় কেবল একটি খাদ্য উপাদান নয়, এটি ঐতিহ্য, নস্টালজিয়া এবং শীতের উৎসবের প্রতিচ্ছবি।
উৎস এবং সংগ্রহ পদ্ধতি
খেজুরের গুড়ের উৎস হলো প্রধানত পশ্চিমবঙ্গ (বিশেষ করে নদীয়া, বর্ধমান এবং চব্বিশ পরগণা অঞ্চল) এবং বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল। শীতের শুরুতেই 'শিউলি' বা গাছিরা খেজুর গাছ তৈরি করেন রস সংগ্রহের জন্য।
রস সংগ্রহ: প্রতিদিন সন্ধ্যায় গাছের কাটা অংশে মাটির হাঁড়ি (ভাড়) টাঙিয়ে রাখা হয় এবং ভোরবেলা সেই হাঁড়ি থেকে টাটকা রস সংগ্রহ করা হয়। এই রস অত্যন্ত মিষ্টি এবং স্বাস্থ্যকর, যা থেকেই তৈরি হয় বিখ্যাত নলেন গুড়।
গুড় তৈরি: সংগৃহীত রস বড় কড়াইয়ে জ্বাল দিয়ে ঘন করা হয়। জ্বাল দেওয়ার প্রক্রিয়ায় রসের আর্দ্রতা কমে যায় এবং এটি ধীরে ধীরে গুড়ে পরিণত হয়। এই সময়েই গুড়ের সেই অতুলনীয় 'নলেন' বা নতুন গন্ধটি বের হয়।
পাটালি গুড়ের বিশেষত্ব
"পাটালি" শব্দটি এসেছে গুড়ের নির্দিষ্ট আকার থেকে। ঘন গুড়কে যখন ছোট ছোট গোল বা আয়তাকার ছাঁচে ঢেলে জমিয়ে শক্ত করা হয়, তখন তাকে পাটালি বলা হয়। নলেন গুড়ের পাটালি তার নিচের বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্য বিখ্যাত:
অনন্য গন্ধ: নলেন গুড়ের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো এর তীব্র এবং মাদকতাময় গন্ধ। এই গন্ধ প্রাকৃতিক এবং খুব ক্ষণস্থায়ী, যা শুধুমাত্র শীতের মরসুমেই পাওয়া যায়।
স্বাদ: এর স্বাদ আখের গুড়ের চেয়ে অনেক বেশি গভীর, মিষ্টি এবং এতে ক্যারামেলের একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত থাকে।
নরম ভাব: আসল এবং ভালো মানের পাটালি গুড় কিছুটা নরম হয় এবং সহজেই ভেঙে যায় বা মুখে দিলে গলে যায়।
রন্ধনশৈলীতে ব্যবহার
বাঙালির রান্নাঘরে নলেন গুড়ের পাটালি একটি বহুমুখী উপাদান। এটি শুধু মিষ্টি খেতেই ব্যবহৃত হয় না, বরং বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী পদ তৈরিতে অপরিহার্য:
পিঠা-পুলি: শীতকালে নলেন গুড়ের পাটিসাপটা, ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা বা দুধ পুলি—সবকিছুতেই এই গুড় ব্যবহৃত হয়। গুড়ের মিষ্টি স্বাদ পিঠার স্বাদকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
মিষ্টান্ন: নলেন গুড়ের কাঁচাগোল্লা, রসগোল্লা, সন্দেশ, এবং পায়েস তৈরিতে পাটালি গুড় ব্যবহার করা হয়। কলকাতার নামী মিষ্টির দোকানগুলো এই সময়টায় নলেন গুড়ের বিশেষ মিষ্টান্ন তৈরি করে, যা অত্যন্ত জনপ্রিয়।
সরাসরি সেবন: অনেকে পাটালি গুড়ের ছোট টুকরো সরাসরি এমনিতেই খেতে ভালোবাসেন।
স্বাস্থ্য উপকারিতা
স্বাদ ছাড়াও, খেজুরের গুড়ের কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে:
প্রাকৃতিক মিষ্টি: এটি পরিশোধিত চিনির একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প।
পুষ্টিগুণ: এতে আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাশিয়ামের মতো খনিজ উপাদান থাকে।
হজম সহায়ক: ঐতিহ্যগতভাবে মনে করা হয় যে খাবার পরে সামান্য গুড় খেলে তা হজমে সহায়তা করে।
নলেন গুড়ের খেজুর পাটালি কেবল একটি মিষ্টি পণ্য নয়, এটি বাঙালির আবেগ। এর সাথে জড়িয়ে আছে শীতের ভোরে কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশে গাছিদের রস সংগ্রহের দৃশ্য, মায়ের হাতের তৈরি পিঠা আর পরিবারের সাথে উষ্ণ সময় কাটানোর স্মৃতি। যখনই এক টুকরো পাটালি মুখে দেওয়া হয়, তখন যেন বাঙালির চিরায়ত শীতের ছবিটাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এই ক্ষণস্থায়ী মৌসুমী উপাদানটি তাই বাঙালির কাছে 'শীতের সোনা' হিসেবেই গণ্য হয়।