ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ

কলকাতার হুগলি নদীর পূর্বতীরে বিখ্যাত দুর্গ ফোর্ট উইলিয়াম। প্রাচ্যে ব্রিটিশরাজের সামরিক শক্তির সবচেয়ে বড় নিদর্শন এটি। ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় উইলিয়ামের নামানুসরে দুর্গটির নাম রাখা হয় ফোর্ট উইলিয়াম। বাস্তবে দু'টি ফোর্ট উইলিয়ামের ইতিহাস জানা যায় একটি পুরনো, অন্যটি নতুন। পুরনো দুর্গটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সূচনাকালের সৃষ্টি। ১৬৯৬ সালে বাংলার নবাবদের অনুমতি নিয়ে এর নির্মাণ কাজ শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। দুর্গ প্রাচীরের দক্ষিণ-পূর্বাংশ এবং তসংলগ্ন দেয়াল নির্মাণের কাজ শুরু করেন স্যার চার্লস আইয়ার। তার উত্তরসূরি জন বিয়ার্ড ১৭০১ সালে উত্তর-পূর্বাংশের দুর্গ প্রাচীর সংযোজন করেন। ১৭০২ সালে তিনি দুর্গের মধ্যভাগে ফ্যাক্টরি বা গভর্নমেন্ট হাউস তৈরি করেন।

১৭০২ সালের ৬ অক্টোবর প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ পতাকা উত্তোলন করা হয় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে। এর মাধ্যমে সূচিত হয়েছিল ব্রিটিশ রাজের প্রাক প্রস্তুতি। যা ধীরে ধীরে গ্রাস করেছে বাংলা থেকে শুরু করে সমস্ত ভারতবর্ষকে। ১৭০৬ সালে দুর্গ নির্মাণের কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়। অতঃপর ইংল্যান্ডের রাজার সম্মানে দুর্গটির নামকরণ করা হয় ফোর্ট উইলিয়াম। এটি নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসাকে পাকাপোক্ত করা। তাদের মূল বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল এই দুর্গ। নিরাপত্তা বিধানের জন্য দুর্গটি তৈরি হলেও শুরু থেকেই এর কাঠামোটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ।

১৭১৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স এই মন্তব্য করেন যে, ভবনসমূহের সুউচ্চ শৃঙ্গের কারণে নদীতীর থেকে দুর্গটিকে জমকালো দেখালেও প্রকৃত অর্থে এটি শক্তিশালী নয়। ১৭৫৬ সালে ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর রজার ড্রেক যখন নওয়াব সিরাজউদ্দৌলাকে কলকাতা আক্রমণে প্ররোচিত করেন, তখনই দুর্গের কার্যকারিতার পরীক্ষা হয়ে যায়। নওয়াব কলকাতা দখল করে দুর্গে প্রবেশ করেন এবং ১৭৫৬ সালের ১৯ জুন গভর্নর ড্রেক এবং তার সৈন্য-সামন্তকে দুর্গ ত্যাগে বাধ্য করেন। এখান থেকেই পুরনো ফোর্টের ধ্বংসের শুরু।



পলাশী-উত্তর যুগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার রাজনীতিতে ভাগ্য নিয়ন্তারূপে আবির্ভূত হয়। পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোম্পানি তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তির প্রকাশ ঘটাতে পারে এমন একটি দুর্গের প্রয়োজন অনুভব করে। প্রথমদিকে পুরনো দুর্গটিকেই নতুন করে নির্মাণ ও এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে জোরদার করার কথা ভাবে কোম্পানি। কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার জেনারেল বেনজামিন রবিন্স এবং তার মৃত্যুর পর কর্নেল ফোডারিক স্কট এ নবায়ন প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন। কিন্তু পলাশী বিপ্লব সবকিছুকে পাল্টে দেয়। ইংরেজদের বণিকসুলভ ভিক্ষাবৃত্তির দিন তখন নেই।

ক্লাইভ সুপারিশ করেন বর্তমান অবস্থানে একটি নতুন দুর্গ নির্মাণ করা হোক। তদনুযায়ী ফোর্ট সেন্ট ডেভিডের প্রকৌশলী জন ব্রহিয়ের নির্মাণকাজ তদারকি করতে কলকাতায় আসেন। ১৭৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কোম্পানির বাংলা কর্তৃপক্ষ ব্রহিয়েরকে সম্ভাব্য ব্যয়ের হিসাব দাখিল করতে বলেন। ব্রহিয়ের হিসাব করে দেখেন, দুর্গ নির্মাণে ব্যয় হবে ২১ থেকে ২২ লাখ টাকা। ১৭৮০ সাল নাগাদ দুর্গের অধিকাংশ কাজ শেষ হয়। ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় দুর্গটি ব্যবহারোপযোগী হয়ে ওঠে। অবশ্য নতুন নতুন প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে আরো অনেক কাজে হাত দিতে হয়।

প্রায় এক শতাব্দী পর ১৮৬০-এর দশকে দুর্গের দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণকাজে হাত দেওয়া হয় এবং তা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ অবধি চলতে থাকে। আধুনিক দুর্গ নির্মাণের স্বীকৃত নীতিমালার সঙ্গে সংগতি রেখেই ফোর্ট উইলিয়াম নির্মিত হয়। এটি একটি অষ্টভুজাকৃতি দুর্গ। এর পাঁচদিকে স্থলভাগের দিক এবং তিন দিক নদীর দিকে প্রসারিত। জলকপাটের সাহায্যে নদী থেকে আনা জল পরিপূর্ণ একটি পরিখা দুর্গটিকে ঘিরে আছে। দুর্গে প্রবেশের জন্য সাতটি প্রবেশদ্বার ছিল। গোড়ার দিকে নির্মিত ব্যারাকগুলো ছিল একতলাবিশিষ্ট।

সেন্ট পিটারকে উৎসর্গ করা একটি গির্জা ছিল দুর্গের অভ্যন্তরে। শেষের দিকে দুর্গে ব্যবস্থা করা হয় পর্যাপ্ত পানীয়জলের সরবরাহ এবং চিকিৎসা সুবিধা। দুর্গের নির্মাণ কাজ যখন সম্পন্ন হয়, তখন পূর্ব ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সর্বোচ্চ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ফলে নবনির্মিত ফোর্ট উইলিয়াম সক্রিয় দুর্গের ভূমিকা পালন করতে পারেনি। বস্তুতপক্ষে ফোর্ট উইলিয়াম কখনও অবরোধের মুখোমুখি হয়নি; ফোর্ট উইলিয়ামের প্রাচীর শীর্ষ থেকে কোনো কামান বা বন্দুক শত্রুর উদ্দেশ্যে গোলাবর্ষণ করেনি। ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের গুরুগম্ভীর দর্শনীয় নিদর্শন হিসেবেই ফোর্ট উইলিয়াম আজো দাঁড়িয়ে আছে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url