কলকাতা রেস কোর্স

কলকাতা রেস কোর্স আজও প্রাসঙ্গিক। প্রথম দিনের অভিঘাতের তীব্রতা স্বাভাবিক ভাবেই আর নেই, কিন্তু উত্তেজনা অবশ্যই আছে। যদিও চল্লিশ বছর আগের সেই প্রথম দিন রেসের মাঠে গিয়েছিলেন মধ্যবিত্তের অপরাধবোধ নিয়েই। কিন্তু মাঠে গিয়ে যখন দেখলেন সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র, গায়ক দেবব্রত বিশ্বাস বসে আছেন, তখন ধারণাটা গুলিয়ে গিয়েছিল। আর সেই প্রথম দিনেই একই রকমভাবে ছুটন্ত ঘোড়ার পা পড়ে গিয়েছিল ‘ফক্স হোল’-এ। পা ভেঙে গিয়েছিল। তাকেও এই ভাবেই ক্যানভাসের ঘোরাটোপের মধ্যে নিষ্কৃতি-মৃত্যু দেওয়া হয়েছিল।

তবে ঘোড়দৌড়ের রক্ত ছলকে ওঠা উত্তেজনার মতো এই রক্তপাতও গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। পুরসভার ‘মৃত পশুবাহী’ গাড়ি যখন মাঠে ঢুকছে, তখনই লাউড স্পিকারে ঘোষণা হচ্ছে, জকি জখম হয়েছেন। তাঁর বদলি এক জকি বাকি রেসগুলো দৌড়বেন। সবাই বই উল্টে দেখতে শুরু করে দিয়েছেন, চৌহানের জন্য বেছে রাখা ঘোড়ার সঙ্গে নতুন জকির কম্বিনেশন কতটা ‘আপসেট ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠতে পারে।

কোন ঘোড়ার জন্য কোন জকি, সেটা ঠিক করেন ট্রেনার। ঘোড়া কেনার ক্ষেত্রেও ট্রেনারদের মতামতই শেষ কথা। যদিও ‘হেভিওয়েট’ মালিকরা নিজেদের নামীদামি ঘোড়ার মানানসই জকি অনেক সময় নিজেরাই পছন্দ করে নেন। রেসকোর্সে অনেক ভাল ঘোড়া আর জকি দেখেছে কলকাতা। এ ছাড়া বড় ডার্বির সময়, যখন বিপুল অঙ্কের ‘জ্যাকপট’, মালিকদের ‘স্টেকমানি’ও অনেক বেশি, তখন অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড থেকে বেশি পারিশ্রমিক দিয়ে বিখ্যাত জকিদের নিয়ে আসা হয়। বাকিরা বেশির ভাগ উত্তরপ্রদেশ কিংবা দক্ষিণ ভারতের অবাঙালি মুসলিম, রাজপুত আর মরাঠি। আগে কলকাতায় অনেক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান জকি ছিলেন, কিন্তু বাঙালি জকি প্রায় নেই। কলকাতায় বা মুম্বই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ অথবা মহীশূরের মাঠে বাঙালি জকি কখনও থাকলেও তাঁরা নাকি চিরকালই তালিকায় শেষ দিকে থেকেছেন।



রেসের মাঠের মেয়াদ ফুরোলে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে সেই সব ঘোড়ার জীবন। কিছু নেয় মাউন্টেড পুলিশ। কিছু যায় রাইডিং স্কুলে। যদিও ক্লাব মেম্বরশিপ এখনও কঠোর ভাবে আমন্ত্রণমূলক এবং মহার্ঘ। যেহেতু বেটিং হয়, ভারতের আর কোনও শহরে না হলেও কলকাতায় ১৬ বছরের নীচে কোনও প্রবেশাধিকার নেই।ক্রিকেটের মতো তথাকথিত ভদ্দরলোকের খেলায় যদি অমন তুমুল বেটিং হতে পারে, বুকিদের ইশারায় উইকেট পড়তে পারে, দাঁড়াতে পারে, তা হলে ঘোড়দৌড়ের মতো বেটিং-সর্বস্ব খেলাতে এ সব হতেই পারে!

কিন্তু রেসের মাঠে নাকি এমন অঘটন কম ঘটে। বহু লক্ষ মানুষের কোটি কোটি টাকার বাজি যে ঘোড়ার ওপর, ছক কষে তাকে হারিয়ে দেওয়াটা অত সহজ নয়। তবে ঘোড়ার মতিগতিও তো সব সময় বোঝা যায় না। যেমন, প্রায় সব রেসেই, যে ঘোড়া সম্ভাব্য বিজয়ী, তার ‘পেস সেটার’ হয়ে অন্য একটা ঘোড়া পাশাপাশি দৌড়য়। তার একমাত্র কাজ, একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত পাল্লা দিয়ে দৌড়ে ফেভারিট ঘোড়ার গতি আরও বাড়িয়ে তোলা।

কিন্তু কখনও কখনও এমনও হয়, দৌড়তে দৌড়তে তাকে জেতার নেশায় পেয়ে বসল। তখন অতি দক্ষ জকিও তার রাশ টানতে পারে না। ভবিতব্য নয়, নিজের পুরুষকারে সওয়ার হয়ে সেই ‘পেস সেটার’ নিজেই হয়ে ওঠে ‘উইনিং হর্স’। নিশ্চিত বিজয়ীকে পিছনে ফেলে পেরিয়ে যায় উইনিং পোস্ট। একবারের জন্য হলেও নিজেকে প্রমাণ করে।

ঘোড়দৌড়ের আসল মজা, তার যাবতীয় উত্তেজনা লুকিয়ে থাকে সেই মহান অনিশ্চয়তার মধ্যেই। রেসের মাঠের হাওয়ায় আরও নানা ‘খবর’ ভাসে। একেবারে শেষ মুহূর্তে জকির কাছে গোপন নির্দেশ এসেছে, রেসটা ছেড়ে দিতে হবে। কিছু লোক বিশ্বাস করে, কিছু লোক করে না। তার ওপরেই উল্টে পাল্টে যায় পাশার দান, লোকের ভাগ্য। কেউ হাসে, কেউ হাহাকার করে।

কখনও এ রকমও হয়, কোনও আপসেট হয়ে যাওয়ার পর জোরালো অভিযোগ উঠল, সেই রেস বাতিল করতে হল। জানিয়ে দেওয়া হল, বেটিং-এর টাকা ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু রেসের মাঠে আমজনতার গ্যালারির পরিচিত প্রতিক্রিয়াই হল, যারা হেরে যায়, তারা চূড়ান্ত হতাশায় হাতের টিকিট ছুড়ে উড়িয়ে দেয় হাওয়ায়। তার পর ঘোষণা করা হয় বেটিং মানি ফেরত দেওয়ার কথা, তখন সেই টিকিট কুড়িয়ে নেওয়ার ধুম পড়ে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url