বাংলার মিষ্টান্ন
যদি মিষ্টি খেতে মিষ্টি না হয়ে অন্য কোন স্বাদের হতো, সেক্ষেত্রে মিষ্টির নাম হতো কি? মিষ্টি একাধারে যেমন একটি স্বাদের নাম, ঠিক তেমনি মিষ্টি একটি বিশেষ মিষ্টান্ন জাতীয় খাদ্য প্রকার। চা’য়ে চিনি দিলে বলা হয় মিষ্টি চা। চিনি দিয়ে তৈরী বিস্কুটকে বলা হয় মিষ্টি বিস্কিট। শরবতে লবনের পরিবর্তে চিনি দিলে বলা হয় মিষ্টি শরবত। তাই যদি হয়, তাহলে বলুন তো, মিষ্টিতে চিনি দিলে সেটাকে কি বলা হবে? মিষ্টি চিনি?
মিষ্টি নিয়ে যতসব মিষ্টি মিষ্টি কথা না বাড়িয়ে, চলুন শুনি কিছু মিষ্টি কাহিনী। মিষ্টি হলো চিনির বা গুড়ের রসে ভেজানো ময়দার গোলা কিংবা দুধ- চিনি মিশিয়ে তৈরি বিভিন্ন আকৃতির ছানার/ময়দার টুকরো করা খাবার। বাঙ্গালির খাওয়া-দাওয়ায় মিষ্টি একটি অতি জনপ্রিয় উপকরণ। বাঙ্গালির কোন উপলক্ষ-অনুষ্ঠানই মিষ্টি ছাড়া পূর্ণতা পায় না। মিষ্টির নাম শুনলেই জিভে জল চলে আসে।
বঙ্গ দেশে মিষ্টিকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য নামী-দামী মিষ্টির দোকান। সেই আদিযুগের লাড্ডু থেকে শুরু করে সন্দেশ, কালোজাম পেরিয়ে আজ মিষ্টির প্রকারভেদ শিল্পের সমপর্যায়ে চলে গেছে। বিভিন্ন রকমের মিষ্টি, স্বাদ ও আকারে এমনকি নামকরণের ভিন্নতা নিয়ে স্বতন্ত্র সত্তায় জনপ্রিয়। মিষ্টির প্রকারভেদ বাংলার মিষ্টিকে দুভাগে ভাগ করেছেন সুকুমার সেন। প্রথম ভাগে আছে একক উপাদানে তৈরী মিষ্টি।
এ ধরণের মিষ্টিতে গুড় বা চিনির সাথে আর কিছু মিশ্রিত থাকে না। যেমন গুড় বা চিনির নাড়ু ও চাকতি, পাটালি, বাতাসা, খাজা, ছাঁচ ইত্যাদি। দ্বিতীয় ধরণের মিষ্টিকে আরো দু’ রকমে ভাগ করা চলে। গুড় বা চিনির সাথে দুগ্ধজাত কোন উপকরণ ছাড়া অন্য দ্রব্য সহযোগে তৈরীকৃত মিষ্টান্ন। যেমনঃ নারকেল, তিল এসবের নাড়ু, চিঁড়ে, মুড়ি, খৈ-এর মোয়া ইত্যাদি। দুগ্ধজাত দ্রব্যযোগে তৈরী নানান ধরণের মিষ্টি রসিক ও মিষ্টিপ্রিয় বাঙ্গালির সুপরিচিত।
চিনির সাথে ছানার সংযোগে তৈরী হয় সন্দেশ ও মন্ডা। আবার এই ছানা রসে মাখিয়ে তৈরী হয় রসগোল্লা, দুধে ডোবালে রসমালাই। বেসনের ছোট ছোট দানা ঘিয়ে ভেজে তৈরী হয় বুন্দিয়া, যা দেখতে ছোট বিন্দুর মতো। কড়া পাকে প্রস্তুতকৃত বুন্দিয়াই মতিচুর, লাড্ডুর কাঁচামাল। যশোরের জামতলার মিষ্টি এটি বাংলার বিখ্যাত মিষ্টিগুলোর মধ্যে অনন্য। এটি বাংলার প্রাচীনতম একটি মিষ্টি। তবে এটি এখন বঙ্গ দেশে সর্বত্র পাওয়া যায়।
চমচম দেখতে অনেকটা লম্বাটে আকৃতি আর শরীরে মাওয়া জড়ানো মিষ্টির নাম চমচম। হালকা আঁচে পোড় খাওয়া এই মিষ্টির রঙ গাঢ় বাদামি বা লালচে। বাহিরটা একটু শক্ত হলেও এর ভেতরটা কিন্তু একদম রসে ভরপুর। একেবারে মাত্রা মতো মিষ্টি, ঘন রস আর টাটকা ছানার গন্ধমাখা পোড়াবাড়ির এই মিষ্টির স্বাদ সত্যি অতুলনীয়। কেউ কেউ তাই মজা করে বলেন- এটি এমন জিনিস, যে না খাবে সেই পস্তাবে! স্বাতন্ত্রেও এর জুড়ি মেলে না।
এর সুনাম রয়েছে বাংলা, বিহার ছাড়িয়ে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে। গাঢ় বাদামি বা লালচে রঙের এই সুস্বাদু চমচমের উপরিভাগে চিনির গুঁড়ো আর মাওয়া জড়ানো থাকে। এর ভেতরের অংশ বিশেষ কায়দায় করা হয় ফাঁপা ও রসাল নরম। চমচম সম্পর্কে ইতিহাস ঘেঁটে যতটা জানা যায়- বৃটিশ শাসন আমলে দশরথ গৌড় নামের এক ব্যক্তি টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর তীরবর্তী পোড়াবাড়িতে এসে বসতি গড়েন।
আসাম থেকে এসে দশরথ গৌড় যমুনার সুস্বাদু মৃদু পানি ও এখানকার গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে প্রথম তৈরি করেন এক ধরনের বিশেষ মিষ্টি। লম্বাটে আকৃতির এ মিষ্টির নাম দেন তিনি চমচম। তার তৈরি চমচম এলাকার লোকজন পছন্দ করতে শুরু করে। পরে সুযোগ বুঝে সে এখানে রীতিমত মিষ্টির পশরা সাজিয়ে বসেন। নাটোরের কাঁচাগোল্লা কাঁচাগোল্লার স্বাদ রসগোল্লা, পানতোয়া, এমনকি সন্দেশকেও হার মানিয়ে দেয়।
এর রয়েছে একটি আলাদা গন্ধ যা অন্য কোন মিষ্টিতে পাওয়া যায় না। হেতু ধীরে ধীরে মিষ্টি রসিকরা এ মিষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। তখন থেকে নাটোরের দোকানদাররা নিয়মিত এ মিষ্টি বানাতে থাকে। কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কোনও কোনও দোকানে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন মণ ছানার কাঁচাগোল্লা তৈরি হতে লাগল। সে সময় ঘোষক দ্বারা প্রচার হতো কাঁচাগোল্লার কথা।
কাঁচাগোল্লা । এ নামেই পরিচিতি দেশ-বিদেশে। ১৭৫৭ সাল থেকে এই মিষ্টি ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে। ধীরে ধীরে মিষ্টিরসিকরা এই মিষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। ১৭৬০ সালে বাংলার শাসনকর্তা রানী ভবানীর রাজত্বকালে বিভিন্ন মাধ্যমে কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়াতে থাকে। কুমিল্লার রসমালাই কুমিল্লার রসমালাই কেবল বাংলাদেশে নয় পুরো উপমহাদেশেই ভোজনরসিকদের কাছে একটি পরিচিত খাবার।
দুধের রসগোল্লা বা রসমালাই অনেক জায়গাতেই তৈরি হয়। কিন্ত কোনটাই ঠিক কুমিল্লার রসমালাইয়ের মত নয়। বাংলাদেশ সরকারও বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় অতিথিদের আপ্যায়ন করেছে কুমিল্লার রসমালাই দিয়ে। আর পূজাসহ বিভিন্ন উৎসবে নিয়মিতভাবে ভারতে যাচ্ছে এসব রসমালাই। উনিশ শতকে ত্রিপুরার ঘোষ সম্প্রদায়ের হাত ধরে রস মালাইএর প্রচলন হয়। সে সময় বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে মিষ্টি সরবরাহের কাজটা মূলত তাদের হাতেই হত।
মালাইকারির প্রলেপ দেয়া রসগোল্লা তৈরি হত সে সময়। পরে দুধ জ্বাল দিয়ে তৈরি ক্ষীরের মধ্যে ডোবানো রসগোল্লার প্রচলন হয়। ধীরে ধীরে সেই ক্ষীর রসগোল্লা ছোট হয়ে আজকের রসমালাই-এ পরিণত হয়েছে। বগুড়ার দই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে দই তৈরি হয় না এমন জায়গা নেই। তবে স্বাদ আর মান বগুড়ার দইকে নিয়ে গেছে এক অনন্য অবস্থানে। এ জেলার প্রায় ১০০ দোকানে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার দই বেচাকেনা হয়।
সে হিসেবে বছরে বিক্রি প্রায় ১০০ কোটি টাকা। প্রবাসীদের আগ্রহের কারণে বগুড়ার দই পৌঁছাচ্ছে কানাডা, ফিলিপাইন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপসহ বহু দেশে। ১৯৬০-এর দশকের দিকে গৌরগোপাল পালের সরার দই তৈরি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। বগুড়ার নবাব পরিবার ও সাতানি পরিবারের কাছে দই সরবরাহ করতেন এ কারণে সে সময় তাঁর দই 'নবাববাড়ির দই' নামে পরিচিতি পায়।
তিলের খাজা এ অঞ্চলের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পাল সম্প্রদায়ের লোক এ উপাদেয় খাদ্যটি তৈরি করত। ভারত পাকিস্তান বিভক্ত হবার আগে শহরের দেশওয়ালী পাড়া এলাকার বেশ কয়েকটি পরিবার তিলের খাজা তৈরী করত। এর পর থেকেই আস্তে আস্তে তিলের খাজার প্রসার ঘটতে থাকে। তখন থেকেই ক্রমে তিলের খাজার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশে জুড়ে।
প্যারা সন্দেশ বিচিত্র সব খাবারের মধ্যে রয়েছে শত বছরের সুখ্যাতি। শুরুতে পূজা মণ্ডপের দেব-দেবীর উপাসনার উদ্দ্যেশ্যে তৈরি করা হলেও এখন এই সন্দেশ দেশের গণ্ডি পেড়িয়ে যাচ্ছে বিদেশেও। জনশ্রুতি আছে যে, নওগাঁ শহরের কালিতলার মহেন্দ্রী দাস নামে এক ব্যক্তি প্রথমে প্যারা সন্দেশ তৈরি শুরু করেন। যশোরের খেজুর রসের ভিজা পিঠা খেজুর রসের রসের ভেজা পিঠা শীতকালের একটি জনপ্রিয় পিঠা।
শীতকালে ভোরে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তার মধ্যে দুধ, চিনি বা গুড়ের সাথে চিতই পিঠা ভিজিয়ে এই পিঠা তৈরী করা হয়। এটি এখন শুধু আর যশোরে সীমাবদ্ধ নেই, সারা বাংলাদেশ জুড়েই রয়েছে এর জনপ্রিয়তা। মহাস্থানের কটকটি বাংলার প্রাচীনতম রাজধানী বলে পরিচিত বগুড়ার মহাস্থান গড় বা পুরানো নাম পুন্ডনগর বেড়াতে গেছেন বা বনভোজনে গেছেন, অথচ মহাস্তান গড়ের কটকটি দেখে খাওয়ার স্বাদ মনে জাগেনি।
দইয়ের ঐতিহ্যবাহি খাবার হিসাবে বেশ প্রসিদ্ধ লাভ করেছে ভ্রমনপিপাসুদের মাঝে। রসকদম ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম মিষ্টান্ন। খোটখাটো অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বড় ধরনের যে কোন অনুষ্ঠানে এই মিষ্টির রয়েছে ব্যাপক কদর। এমনকি দেশের বাইরেও ভারত, আমেরিকাতেও রয়েছে এর পরিচিতি। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ বিশেষ মিষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেছেন সেখানকার ময়রারা। তাঁদের নিষ্ঠা ও সৃজনশীলতায় ঐতিহ্যবাহী হয়ে উঠেছে সেসব মিষ্টি।
এর মধ্যে আছে রসগোল্লা, রাঘবসাই, মণ্ডা, আমৃতি খেজুরের নোলন গুড়ের প্যারা সন্দেশ, তিলের খাজা, পাতক্ষীরা, ক্ষীরের চমচম, রসমালাই, দই, ছানামুখি, ক্ষীর, জিলাপী, তালরসের পিঠা।
মিষ্টি নিয়ে যতসব মিষ্টি মিষ্টি কথা না বাড়িয়ে, চলুন শুনি কিছু মিষ্টি কাহিনী। মিষ্টি হলো চিনির বা গুড়ের রসে ভেজানো ময়দার গোলা কিংবা দুধ- চিনি মিশিয়ে তৈরি বিভিন্ন আকৃতির ছানার/ময়দার টুকরো করা খাবার। বাঙ্গালির খাওয়া-দাওয়ায় মিষ্টি একটি অতি জনপ্রিয় উপকরণ। বাঙ্গালির কোন উপলক্ষ-অনুষ্ঠানই মিষ্টি ছাড়া পূর্ণতা পায় না। মিষ্টির নাম শুনলেই জিভে জল চলে আসে।
বঙ্গ দেশে মিষ্টিকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য নামী-দামী মিষ্টির দোকান। সেই আদিযুগের লাড্ডু থেকে শুরু করে সন্দেশ, কালোজাম পেরিয়ে আজ মিষ্টির প্রকারভেদ শিল্পের সমপর্যায়ে চলে গেছে। বিভিন্ন রকমের মিষ্টি, স্বাদ ও আকারে এমনকি নামকরণের ভিন্নতা নিয়ে স্বতন্ত্র সত্তায় জনপ্রিয়। মিষ্টির প্রকারভেদ বাংলার মিষ্টিকে দুভাগে ভাগ করেছেন সুকুমার সেন। প্রথম ভাগে আছে একক উপাদানে তৈরী মিষ্টি।
এ ধরণের মিষ্টিতে গুড় বা চিনির সাথে আর কিছু মিশ্রিত থাকে না। যেমন গুড় বা চিনির নাড়ু ও চাকতি, পাটালি, বাতাসা, খাজা, ছাঁচ ইত্যাদি। দ্বিতীয় ধরণের মিষ্টিকে আরো দু’ রকমে ভাগ করা চলে। গুড় বা চিনির সাথে দুগ্ধজাত কোন উপকরণ ছাড়া অন্য দ্রব্য সহযোগে তৈরীকৃত মিষ্টান্ন। যেমনঃ নারকেল, তিল এসবের নাড়ু, চিঁড়ে, মুড়ি, খৈ-এর মোয়া ইত্যাদি। দুগ্ধজাত দ্রব্যযোগে তৈরী নানান ধরণের মিষ্টি রসিক ও মিষ্টিপ্রিয় বাঙ্গালির সুপরিচিত।
চিনির সাথে ছানার সংযোগে তৈরী হয় সন্দেশ ও মন্ডা। আবার এই ছানা রসে মাখিয়ে তৈরী হয় রসগোল্লা, দুধে ডোবালে রসমালাই। বেসনের ছোট ছোট দানা ঘিয়ে ভেজে তৈরী হয় বুন্দিয়া, যা দেখতে ছোট বিন্দুর মতো। কড়া পাকে প্রস্তুতকৃত বুন্দিয়াই মতিচুর, লাড্ডুর কাঁচামাল। যশোরের জামতলার মিষ্টি এটি বাংলার বিখ্যাত মিষ্টিগুলোর মধ্যে অনন্য। এটি বাংলার প্রাচীনতম একটি মিষ্টি। তবে এটি এখন বঙ্গ দেশে সর্বত্র পাওয়া যায়।
চমচম দেখতে অনেকটা লম্বাটে আকৃতি আর শরীরে মাওয়া জড়ানো মিষ্টির নাম চমচম। হালকা আঁচে পোড় খাওয়া এই মিষ্টির রঙ গাঢ় বাদামি বা লালচে। বাহিরটা একটু শক্ত হলেও এর ভেতরটা কিন্তু একদম রসে ভরপুর। একেবারে মাত্রা মতো মিষ্টি, ঘন রস আর টাটকা ছানার গন্ধমাখা পোড়াবাড়ির এই মিষ্টির স্বাদ সত্যি অতুলনীয়। কেউ কেউ তাই মজা করে বলেন- এটি এমন জিনিস, যে না খাবে সেই পস্তাবে! স্বাতন্ত্রেও এর জুড়ি মেলে না।
এর সুনাম রয়েছে বাংলা, বিহার ছাড়িয়ে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে। গাঢ় বাদামি বা লালচে রঙের এই সুস্বাদু চমচমের উপরিভাগে চিনির গুঁড়ো আর মাওয়া জড়ানো থাকে। এর ভেতরের অংশ বিশেষ কায়দায় করা হয় ফাঁপা ও রসাল নরম। চমচম সম্পর্কে ইতিহাস ঘেঁটে যতটা জানা যায়- বৃটিশ শাসন আমলে দশরথ গৌড় নামের এক ব্যক্তি টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর তীরবর্তী পোড়াবাড়িতে এসে বসতি গড়েন।
আসাম থেকে এসে দশরথ গৌড় যমুনার সুস্বাদু মৃদু পানি ও এখানকার গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে প্রথম তৈরি করেন এক ধরনের বিশেষ মিষ্টি। লম্বাটে আকৃতির এ মিষ্টির নাম দেন তিনি চমচম। তার তৈরি চমচম এলাকার লোকজন পছন্দ করতে শুরু করে। পরে সুযোগ বুঝে সে এখানে রীতিমত মিষ্টির পশরা সাজিয়ে বসেন। নাটোরের কাঁচাগোল্লা কাঁচাগোল্লার স্বাদ রসগোল্লা, পানতোয়া, এমনকি সন্দেশকেও হার মানিয়ে দেয়।
এর রয়েছে একটি আলাদা গন্ধ যা অন্য কোন মিষ্টিতে পাওয়া যায় না। হেতু ধীরে ধীরে মিষ্টি রসিকরা এ মিষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। তখন থেকে নাটোরের দোকানদাররা নিয়মিত এ মিষ্টি বানাতে থাকে। কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কোনও কোনও দোকানে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন মণ ছানার কাঁচাগোল্লা তৈরি হতে লাগল। সে সময় ঘোষক দ্বারা প্রচার হতো কাঁচাগোল্লার কথা।
কাঁচাগোল্লা । এ নামেই পরিচিতি দেশ-বিদেশে। ১৭৫৭ সাল থেকে এই মিষ্টি ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে। ধীরে ধীরে মিষ্টিরসিকরা এই মিষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। ১৭৬০ সালে বাংলার শাসনকর্তা রানী ভবানীর রাজত্বকালে বিভিন্ন মাধ্যমে কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়াতে থাকে। কুমিল্লার রসমালাই কুমিল্লার রসমালাই কেবল বাংলাদেশে নয় পুরো উপমহাদেশেই ভোজনরসিকদের কাছে একটি পরিচিত খাবার।
দুধের রসগোল্লা বা রসমালাই অনেক জায়গাতেই তৈরি হয়। কিন্ত কোনটাই ঠিক কুমিল্লার রসমালাইয়ের মত নয়। বাংলাদেশ সরকারও বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় অতিথিদের আপ্যায়ন করেছে কুমিল্লার রসমালাই দিয়ে। আর পূজাসহ বিভিন্ন উৎসবে নিয়মিতভাবে ভারতে যাচ্ছে এসব রসমালাই। উনিশ শতকে ত্রিপুরার ঘোষ সম্প্রদায়ের হাত ধরে রস মালাইএর প্রচলন হয়। সে সময় বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে মিষ্টি সরবরাহের কাজটা মূলত তাদের হাতেই হত।
মালাইকারির প্রলেপ দেয়া রসগোল্লা তৈরি হত সে সময়। পরে দুধ জ্বাল দিয়ে তৈরি ক্ষীরের মধ্যে ডোবানো রসগোল্লার প্রচলন হয়। ধীরে ধীরে সেই ক্ষীর রসগোল্লা ছোট হয়ে আজকের রসমালাই-এ পরিণত হয়েছে। বগুড়ার দই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে দই তৈরি হয় না এমন জায়গা নেই। তবে স্বাদ আর মান বগুড়ার দইকে নিয়ে গেছে এক অনন্য অবস্থানে। এ জেলার প্রায় ১০০ দোকানে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার দই বেচাকেনা হয়।
সে হিসেবে বছরে বিক্রি প্রায় ১০০ কোটি টাকা। প্রবাসীদের আগ্রহের কারণে বগুড়ার দই পৌঁছাচ্ছে কানাডা, ফিলিপাইন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপসহ বহু দেশে। ১৯৬০-এর দশকের দিকে গৌরগোপাল পালের সরার দই তৈরি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। বগুড়ার নবাব পরিবার ও সাতানি পরিবারের কাছে দই সরবরাহ করতেন এ কারণে সে সময় তাঁর দই 'নবাববাড়ির দই' নামে পরিচিতি পায়।
তিলের খাজা এ অঞ্চলের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পাল সম্প্রদায়ের লোক এ উপাদেয় খাদ্যটি তৈরি করত। ভারত পাকিস্তান বিভক্ত হবার আগে শহরের দেশওয়ালী পাড়া এলাকার বেশ কয়েকটি পরিবার তিলের খাজা তৈরী করত। এর পর থেকেই আস্তে আস্তে তিলের খাজার প্রসার ঘটতে থাকে। তখন থেকেই ক্রমে তিলের খাজার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশে জুড়ে।
প্যারা সন্দেশ বিচিত্র সব খাবারের মধ্যে রয়েছে শত বছরের সুখ্যাতি। শুরুতে পূজা মণ্ডপের দেব-দেবীর উপাসনার উদ্দ্যেশ্যে তৈরি করা হলেও এখন এই সন্দেশ দেশের গণ্ডি পেড়িয়ে যাচ্ছে বিদেশেও। জনশ্রুতি আছে যে, নওগাঁ শহরের কালিতলার মহেন্দ্রী দাস নামে এক ব্যক্তি প্রথমে প্যারা সন্দেশ তৈরি শুরু করেন। যশোরের খেজুর রসের ভিজা পিঠা খেজুর রসের রসের ভেজা পিঠা শীতকালের একটি জনপ্রিয় পিঠা।
শীতকালে ভোরে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তার মধ্যে দুধ, চিনি বা গুড়ের সাথে চিতই পিঠা ভিজিয়ে এই পিঠা তৈরী করা হয়। এটি এখন শুধু আর যশোরে সীমাবদ্ধ নেই, সারা বাংলাদেশ জুড়েই রয়েছে এর জনপ্রিয়তা। মহাস্থানের কটকটি বাংলার প্রাচীনতম রাজধানী বলে পরিচিত বগুড়ার মহাস্থান গড় বা পুরানো নাম পুন্ডনগর বেড়াতে গেছেন বা বনভোজনে গেছেন, অথচ মহাস্তান গড়ের কটকটি দেখে খাওয়ার স্বাদ মনে জাগেনি।
দইয়ের ঐতিহ্যবাহি খাবার হিসাবে বেশ প্রসিদ্ধ লাভ করেছে ভ্রমনপিপাসুদের মাঝে। রসকদম ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম মিষ্টান্ন। খোটখাটো অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বড় ধরনের যে কোন অনুষ্ঠানে এই মিষ্টির রয়েছে ব্যাপক কদর। এমনকি দেশের বাইরেও ভারত, আমেরিকাতেও রয়েছে এর পরিচিতি। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ বিশেষ মিষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেছেন সেখানকার ময়রারা। তাঁদের নিষ্ঠা ও সৃজনশীলতায় ঐতিহ্যবাহী হয়ে উঠেছে সেসব মিষ্টি।
এর মধ্যে আছে রসগোল্লা, রাঘবসাই, মণ্ডা, আমৃতি খেজুরের নোলন গুড়ের প্যারা সন্দেশ, তিলের খাজা, পাতক্ষীরা, ক্ষীরের চমচম, রসমালাই, দই, ছানামুখি, ক্ষীর, জিলাপী, তালরসের পিঠা।