কামরাঙ্গার উপকারিতা ও অপকারিতা
বাংলার প্রায় সব এলাকাতেই চোখে পড়ে পাখিদের অত্যন্ত প্রিয় কামরাঙ্গা ফলকে। এদেশের দেশি জাতের যেসব কামরাঙ্গা জন্মে তার কাঁচা ফল বেশ টক, পাকলে কিছুটা মিষ্টি হয়। ইদানিং বিদেশি এক প্রকার জাত এসেছে যা স্বাদে মিষ্টি। কামরাঙ্গার আদি বাসস্থান মালাক্কা। মাঝারি আকৃতির কামরাঙ্গার ডালপালা বেশ ঝোপালো হয় এবং শক্ত। ৩০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে থোকা থোকা হালকা গোলাপি রঙের ফুল হয়। জুন-সেপ্টেম্বর মাসে ফুল আসে এবং সেপ্টেম্বর-জানুয়ারি মাসে ফল পাঁকে। ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ আছে।
বীজের গাছে ৩-৪ বছরের মধ্যে ফুল আসে। পূর্ণবয়স্ক গাছে বছরে ৬০০-৮০০ টি ফল পাওয়া যায়। গরম ও আদ্র জলবায়ু কামরাঙ্গা চাষের উপযোগী। বালিমাটি ছাড়া যে কোন মাটিতে কামরাঙ্গা চাষ করা যেতে পারে। কলম রোপপনের মাধ্যমেও কামরাঙ্গার বংশবিস্তার করা যায়। কামরাঙ্গা চাষের জন্য তেমন সার দেয়ার প্রয়োজন হয় না। বছরে একবার সার দেয়াটাই যথেষ্ট। কামরাঙ্গার জাত সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হয়নি। তবে আমাদের দেশে টক, মিষ্টি এবং বারোমাসী এই তিন জাতের কামরাঙ্গা বেশি পরিচিত। কামরাঙ্গা কামরাঙ্গা বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ফল।
অন্যান্য ফলের চেয়ে কামরাঙ্গার দামও কম। দেশের সর্বত্র বাড়ি ঘরের আশপাশে এ ফলের দু-একটি গাছ দেখা যায়। কামরাঙ্গা ফল থেকে জ্যাম, জেলি, মোরব্বা, চাটনি ও আচার তৈরি করা হয়। কামরাঙ্গা একটি রপ্তানিযোগ্য ফল হওয়ায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এর চাষ হওয়ার বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। পুষ্টি ও ভেষজগুণ : কামরাঙ্গায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, বি ও সি রয়েছে। ভক্ষণযোগ্য ১০০ গ্রাম পাকা কামরাঙ্গায় ৮৮.৬ ভাগ জলীয় অংশ, ০.৪ গ্রাম খনিজ লবণ, ০.৭ গ্রাম অাঁশ, ০.৭৫ গ্রাম আমিষ, ৯.৫ গ্রাম শর্করা, ১১.০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১.২ মিলিগ্রাম লৌহ এবং ৫০ কিলোক্যালরি খাদ্য শক্তি রয়েছে।
কামরাঙ্গার পাকা ফল বাতনাশক, বহুমূত্র, উচ্চ রক্তচাপ ও অর্শ্বরোগের জন্য উপকারী। পাতা ও ডগার গুঁড়া সেবনে জলবসন্ত ও বক্র কৃমি নিরাময় হয়। রোপণ পদ্ধতি : সমতল ভূমিতে বর্গাকার বা আয়তকার এবং পাহাড়ি ভূমিতে কন্টুর পদ্ধতিতে চারা রোপণ করা হয়। রোপণ সময় : চারা বা কলম রোপণের উপযুক্ত সময় হলো মধ্য জ্যৈষ্ঠ থেকে মধ্য ভাদ্র মাস। তবে সেচ সুবিধা থাকলে আশ্বিন-কার্তিক মাস পর্যন্ত চারা বা কলম রোপণ করা যেতে পারে। গর্তের আকার : কামরাঙ্গার চারা রোপণের জন্য গর্ত তৈরি করতে হবে।
গর্তে সার প্রয়োগ : চারা রোপণের জন্য প্রতি গর্তে ১৫ থেকে ২০ কেজি জৈব সার, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি এবং ১০০ গ্রাম জিপসাম গর্তের মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে এবং পানি দিয়ে ১০ থেকে ১৫ দিন রেখে দিতে হবে। চারা রোপণ : গর্তের মধ্যখানে চারা বসিয়ে গোড়ার মাটি একটু উঁচু করে দিতে হবে। চারা লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে একটি শক্ত কাঠিতে বেঁধে দিতে হবে। তারপর সেচ দিতে হবে। সেচ প্রয়োগ ও পানি নিকাশ : চারা রোপণের পর এক মাস নিয়মিত সেচ প্রদান করতে হবে।
শুষ্ক মৌসুমে এবং ফল ধরার পর প্রতি ১৫ দিন পর পর অন্তত ২ থেকে ৩ বার সেচ দিলে ফল ঝরার পরিমাণ হ্রাস পায় এবং ফলন বৃদ্ধি পায়। বর্ষা মৌসুমে বাগানে পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। ফল সংগ্রহ : ফল পাকার পর গাছে বেশিদিন থাকে না; এক সপ্তাহের মধ্যেই ঝরে পড়ে। তাই সামান্য হলুদ বর্ণ ধারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই হাত দিয়ে বা জাল লাগানো কোটার সাহায্যে ফল সংগ্রহ করতে হবে। ফলন : উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ টন কামরাঙ্গার ফলন পাওয়া সম্ভব।
কামরাঙ্গার উপকারিতা
* এতে থাকে এলজিক এসিড যা খাদ্যনালির (অন্ত্রের) ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
* এর পাতা ও কচি ফলের রসে রয়েছে ট্যানিন, যা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।
* পাকা ফল রক্তক্ষরণ বন্ধ করে।
* ফল ও পাতা গরম পানিতে সিদ্ধ করে পান করলে বমি বন্ধ হয়।
* কামরাঙ্গা ত্বক মসৃণ করে।
* এর পাতা ও ডগার গুঁড়া খেলে জলবসন্ত ও বক্রকৃমি নিরাময় হয়।
* কামরাঙ্গা পুড়িয়ে ভর্তা করে খেলে ঠান্ডাজনিত (সর্দিকাশি) সমস্যা সহজেই ভালো হয়ে যায়।
* এর মূল বিষনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
* কামরাঙ্গা ভর্তা রুচি ও হজমশক্তি বাড়ায়।
* পেটের ব্যথায় কামরাঙ্গা খেলে উপকার পাওয়া যায়।
* শুকানো কামরাঙ্গা জ্বরের জন্য খুবই উপকারী।
* ২ গ্রাম পরিমাণ শুকনো কামরাঙ্গার গুঁড়া পানির সঙ্গে রোজ একবার করে খেলে অর্শ রোগে উপকার পাওয়া যায়।
* কামরাঙ্গা শীতল ও টক। তাই ঘাম, কফ ও বাতনাশক হিসেবে কাজ করে।
কামরাঙ্গা সবার জন্য নিরাপদ নয়
কামরাঙ্গা ফল বিশ্বে বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন_ স্টার ফ্রুট (তারা ফল) ক্যারামবোলা প্রভৃতি। এই ফলটির উৎপত্তি মূলত শ্রীলঙ্কায়। পরবর্তী সময়ে ভারত, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, চীনসহ ইউরোপ-আমেরিকা মহাদেশে চাষ হয় এবং এটি বিশ্বব্যাপী টক-মিষ্টি ফল হিসেবে বেশ পরিচিত। কিন্তু উচ্চ মাত্রার ভিটামিন সি সমৃদ্ধ কামরাঙ্গায় উল্লেখযোগ্য আরো রয়েছে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন বি৯ (ফোলেট) মিনারেল হিসেবে রয়েছে পটাশিয়াম ফসফরাস জিংক প্রভৃতি।
এটি এন্টি অক্সিডেন্টের ভালো উৎসই শুধু নয় এর রয়েছে এন্টি মাইক্রোবিয়াল এবং ক্যানসার বা অস্বাভাবিক কোষ অপরাসরণের ক্ষমতা। কামরাঙ্গা ফলের মধ্যে যতই গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন এবং মিনারেল থাকুক না কেন, পাকা কামরাঙ্গা জুস যতই সুস্বাদু লাগুক না কেন কামরাঙ্গার মধ্যে এমন দুইটি উপাদান রয়েছে যা মানব শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ ঘটাতে পারে এবং অতীতে বহু মানুষের কামরাঙ্গা খাবার কারণে মৃত্যু ঘটেছে এমন কি এই ফল খাবার ১ ঘণ্টা পরেই মৃত্যু ঘটার মতো ঘটনা ঘটেছে।
খাবার পর যে সব লক্ষণ বা প্রতিক্রিয়া দেখা যায় তার মধ্যে বিরামহীন হেচকি, বমি বমি ভাব, মাথা ঘুরানো, মানসিক ভারসাম্যহীনতা প্রভৃতি। চায়নার এক শহরে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদের মধ্যে ১০ জন কামরাঙ্গা খেয়ে অসুস্থতা বোধ করে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সবাই পরবর্তী সময়ে মারা যায়। এই মৃত্যু ঝুঁকি তাদের জন্য যারা বিভিন্ন কিডনি রোগে ভুগছেন।
যেমন কিডনি দুর্বল, কিছুটা নষ্ট, প্রায় কাজ করছে না অথবা পুরোটা নষ্ট অর্থাৎ ডায়ালসিস করতে হচ্ছে বা কিডনিতে পাথর রয়েছে এসব ক্ষেত্রে কামরাঙ্গা গ্রহণকারী ব্যক্তি উপরোক্ত লক্ষণসহ মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। এরমূল কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে কামরাঙ্গায় রয়েছে উচ্চমাত্রায় অক্সালিক এসিড যা দুর্বল কিডনির জন্য মারাত্মক হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে ১০০ মিলিলিটার কামরাঙ্গার জুসে ০.৫০ গ্রাম অক্সালিক এসিড রয়েছে।
সাওপলো বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে কামরাঙ্গা গ্রহণকারীদের মধ্যে ৩২ জনের মধ্যে ৩০ জনের হেচকি লক্ষণ দেখা দেয়। ৩ ভাগের ২ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে বমি হয়, মানসিক ভারসাম্যহীনতার কম লক্ষ্য করা গেছে। সুস্থ কিডনি যাদের রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে কামরাঙ্গা গ্রহণ করা যেতে পারে। কারণ তাদের ক্ষেত্রে এমন লক্ষণ দেখা যায়নি। কিন্তু ব্রাজিলিয়ান গবেষকরা গবেষণায় দেখলেন কামরাঙ্গার এমন একটি উপাদান আছে যা অন্যকোনো ফলে নেই। যা দুর্বল বা কিডনি ফেইলিয়র রোগীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর আর তা হল নিউরো টক্সিন।
গবেষকরা বলেছেন, যাদের কিডনি সঠিকভাবে কাজ করছে তাদের কিডনি এই মারাত্মক ক্ষতিকর নিউরো টক্সিনকে ছেঁকে রক্ত থেকে প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয় ফলে ব্রেনের নিউরনের ওপর এবং নার্ভাস সিস্টেমের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। সুতরাং সুস্থ ব্যক্তিদের পরিমাণ মতো কামরাঙ্গা খেতে কোনো সমস্যা নেই।
কিন্তু যাদের কিডনি দুর্বল বা অকার্যকর তাদের কিডনি এই মারাত্মক নিউরো টক্সিনকে বের করে দিতে পারে না। ফলে এটি ব্রেন এবং নার্ভাস সিস্টেমের ওপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, ফলে মাথা ঘোরা, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, কোষের শক্তি কমে যেতে থাকা, কোষের ওপর টান বা খিচুনি অনুভব করা বা খিচুনি হওয়া, অজ্ঞান হয়ে পড়া এমনকি কোমাতে চলে যাওয়া ঘটনা ঘটে। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় যে নিউরো টক্সিন কি এবং এটি আমাদের কিভাবে ক্ষতি করে কিছু জানা দরকার। কামরাঙ্গায় থাকা নিউরো টক্সিন আমাদের ব্রেনে নিউরনের কার্যক্ষমতাকে আটকে দেয়।
আমাদের ব্রেনে ৫০ বিলিয়ন নিউরন রয়েছে এবং নার্ভাস সিস্টেম, আমাদের শরীরের সমস্ত কর্মকা-, অনুভূতি, সংবাদ প্রেরণ, সাড়া দেওয়া, সংবাদ পেঁৗছানো সবই নিউরনের কাজ। কিন্তু নিউরো টক্সিন এই গুরুত্বপূর্ণ নিউরনের ওপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ড্যামেজ করে, ফলে নিউরন তার কাজ সঠিকভাবে করতে পারে না। সুতরাং দুর্বল কিডনি, নষ্ট হতে থাকা কিডনি, ক্রনিক কিডনি ডিসিস অথবা একেবারেই নষ্ট হয়ে যাওয়া কিডনি রোগী (ডায়ালাইসিস করছেন) যদি কামরাঙ্গা ভুল করে গ্রহণ করেন এটি তাদের দ্রুত মৃত্যুর কারণ ঘটাতে পারে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে একেবারেই অল্প অর্থাৎ অর্ধেক কামরাঙ্গা অথবা আট আউন্স কামরাঙ্গার সরবত বা জুস মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে এবং মৃত্যুও হতে পারে। সুতরাং কিডনি দুর্বল বা ঠিকমত কাজ করছে না এমন রোগী কামরাঙ্গা থেকে সাবধান। গর্ভবতী মায়েরা যদি কামরাঙ্গা খান তবে তা নিজের জন্য এবং গর্ভজাত শিশুর জন্য ক্ষতির কারণ ঘটতে পারে।
এ বিষয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালে শিশুদের কিডনি রোগের জন্য যে সকল শিশুরা চিকিৎসা নিতে আসে তাদের কিডনি সমস্যার কারণ হিসেবে গর্ভবস্থায় মায়েদের কামরাঙ্গা গ্রহণ করাকে অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ বলে অনেক চিকিৎক মনে করেন। তবে যাদের কিডনি সুস্থ রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে কামরাঙ্গা পরিমাণ মতো গ্রহণ করা যেতে পারে বলে বিশ্বের গবেষকরা বলেন। তবে আমি মনে করি 'প্রিভেনশন ইস বেটার দেন কিউর'। যা খেলে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে সেটা খাওয়ার দরকার কি?
ফলের কি অভাব রয়েছে! এমনিতেই বাংলাদেশে কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে ভুগছেন এমন রোগীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি বলে বাংলাদেশের কিডনি বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন এবং ভয়ঙ্কর সংবাদ হচ্ছে শতকরা ৯০% কিডনি রোগী জানেই না যে তার কিডনি রোগ রয়েছে। সুতরাং কামরাঙ্গা না খাওয়াই ভালো। ফলজ গাছ হিসেবে কামরাঙ্গা না লাগানোই ভালো। সচেতনতাই সুস্থ থাকার উপায়।
সুতরাং কামরাঙ্গার মধ্যে থাকা যে দুটি রাসায়নিক উপাদান ১. অক্সিলিক এসিড ২. নিউরো টক্সিন রয়েছে যা অন্যকোনো ফলমূল ও সবজির মধ্যে পাওয়া না গেলেও কোন কোন শাকসবজি ফলের মধ্যে অক্সালিড এসিড রয়েছে যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয় যা শরীরের জন্য নিরাপদ বা ক্ষেত্র বিশেষে প্রয়োজন রয়েছে। তবে পালং শাকে নিরাপদ পর্যায়ে অক্সালিড এসিড থাকলেও কিডনি রোগীদের বেশি না খাওয়া ভালো।
বীজের গাছে ৩-৪ বছরের মধ্যে ফুল আসে। পূর্ণবয়স্ক গাছে বছরে ৬০০-৮০০ টি ফল পাওয়া যায়। গরম ও আদ্র জলবায়ু কামরাঙ্গা চাষের উপযোগী। বালিমাটি ছাড়া যে কোন মাটিতে কামরাঙ্গা চাষ করা যেতে পারে। কলম রোপপনের মাধ্যমেও কামরাঙ্গার বংশবিস্তার করা যায়। কামরাঙ্গা চাষের জন্য তেমন সার দেয়ার প্রয়োজন হয় না। বছরে একবার সার দেয়াটাই যথেষ্ট। কামরাঙ্গার জাত সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হয়নি। তবে আমাদের দেশে টক, মিষ্টি এবং বারোমাসী এই তিন জাতের কামরাঙ্গা বেশি পরিচিত। কামরাঙ্গা কামরাঙ্গা বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ফল।
অন্যান্য ফলের চেয়ে কামরাঙ্গার দামও কম। দেশের সর্বত্র বাড়ি ঘরের আশপাশে এ ফলের দু-একটি গাছ দেখা যায়। কামরাঙ্গা ফল থেকে জ্যাম, জেলি, মোরব্বা, চাটনি ও আচার তৈরি করা হয়। কামরাঙ্গা একটি রপ্তানিযোগ্য ফল হওয়ায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এর চাষ হওয়ার বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। পুষ্টি ও ভেষজগুণ : কামরাঙ্গায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, বি ও সি রয়েছে। ভক্ষণযোগ্য ১০০ গ্রাম পাকা কামরাঙ্গায় ৮৮.৬ ভাগ জলীয় অংশ, ০.৪ গ্রাম খনিজ লবণ, ০.৭ গ্রাম অাঁশ, ০.৭৫ গ্রাম আমিষ, ৯.৫ গ্রাম শর্করা, ১১.০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১.২ মিলিগ্রাম লৌহ এবং ৫০ কিলোক্যালরি খাদ্য শক্তি রয়েছে।
কামরাঙ্গার পাকা ফল বাতনাশক, বহুমূত্র, উচ্চ রক্তচাপ ও অর্শ্বরোগের জন্য উপকারী। পাতা ও ডগার গুঁড়া সেবনে জলবসন্ত ও বক্র কৃমি নিরাময় হয়। রোপণ পদ্ধতি : সমতল ভূমিতে বর্গাকার বা আয়তকার এবং পাহাড়ি ভূমিতে কন্টুর পদ্ধতিতে চারা রোপণ করা হয়। রোপণ সময় : চারা বা কলম রোপণের উপযুক্ত সময় হলো মধ্য জ্যৈষ্ঠ থেকে মধ্য ভাদ্র মাস। তবে সেচ সুবিধা থাকলে আশ্বিন-কার্তিক মাস পর্যন্ত চারা বা কলম রোপণ করা যেতে পারে। গর্তের আকার : কামরাঙ্গার চারা রোপণের জন্য গর্ত তৈরি করতে হবে।
গর্তে সার প্রয়োগ : চারা রোপণের জন্য প্রতি গর্তে ১৫ থেকে ২০ কেজি জৈব সার, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি এবং ১০০ গ্রাম জিপসাম গর্তের মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে এবং পানি দিয়ে ১০ থেকে ১৫ দিন রেখে দিতে হবে। চারা রোপণ : গর্তের মধ্যখানে চারা বসিয়ে গোড়ার মাটি একটু উঁচু করে দিতে হবে। চারা লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে একটি শক্ত কাঠিতে বেঁধে দিতে হবে। তারপর সেচ দিতে হবে। সেচ প্রয়োগ ও পানি নিকাশ : চারা রোপণের পর এক মাস নিয়মিত সেচ প্রদান করতে হবে।
শুষ্ক মৌসুমে এবং ফল ধরার পর প্রতি ১৫ দিন পর পর অন্তত ২ থেকে ৩ বার সেচ দিলে ফল ঝরার পরিমাণ হ্রাস পায় এবং ফলন বৃদ্ধি পায়। বর্ষা মৌসুমে বাগানে পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। ফল সংগ্রহ : ফল পাকার পর গাছে বেশিদিন থাকে না; এক সপ্তাহের মধ্যেই ঝরে পড়ে। তাই সামান্য হলুদ বর্ণ ধারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই হাত দিয়ে বা জাল লাগানো কোটার সাহায্যে ফল সংগ্রহ করতে হবে। ফলন : উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ টন কামরাঙ্গার ফলন পাওয়া সম্ভব।
কামরাঙ্গার উপকারিতা
* এতে থাকে এলজিক এসিড যা খাদ্যনালির (অন্ত্রের) ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
* এর পাতা ও কচি ফলের রসে রয়েছে ট্যানিন, যা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।
* পাকা ফল রক্তক্ষরণ বন্ধ করে।
* ফল ও পাতা গরম পানিতে সিদ্ধ করে পান করলে বমি বন্ধ হয়।
* কামরাঙ্গা ত্বক মসৃণ করে।
* এর পাতা ও ডগার গুঁড়া খেলে জলবসন্ত ও বক্রকৃমি নিরাময় হয়।
* কামরাঙ্গা পুড়িয়ে ভর্তা করে খেলে ঠান্ডাজনিত (সর্দিকাশি) সমস্যা সহজেই ভালো হয়ে যায়।
* এর মূল বিষনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
* কামরাঙ্গা ভর্তা রুচি ও হজমশক্তি বাড়ায়।
* পেটের ব্যথায় কামরাঙ্গা খেলে উপকার পাওয়া যায়।
* শুকানো কামরাঙ্গা জ্বরের জন্য খুবই উপকারী।
* ২ গ্রাম পরিমাণ শুকনো কামরাঙ্গার গুঁড়া পানির সঙ্গে রোজ একবার করে খেলে অর্শ রোগে উপকার পাওয়া যায়।
* কামরাঙ্গা শীতল ও টক। তাই ঘাম, কফ ও বাতনাশক হিসেবে কাজ করে।
কামরাঙ্গা সবার জন্য নিরাপদ নয়
কামরাঙ্গা ফল বিশ্বে বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন_ স্টার ফ্রুট (তারা ফল) ক্যারামবোলা প্রভৃতি। এই ফলটির উৎপত্তি মূলত শ্রীলঙ্কায়। পরবর্তী সময়ে ভারত, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, চীনসহ ইউরোপ-আমেরিকা মহাদেশে চাষ হয় এবং এটি বিশ্বব্যাপী টক-মিষ্টি ফল হিসেবে বেশ পরিচিত। কিন্তু উচ্চ মাত্রার ভিটামিন সি সমৃদ্ধ কামরাঙ্গায় উল্লেখযোগ্য আরো রয়েছে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন বি৯ (ফোলেট) মিনারেল হিসেবে রয়েছে পটাশিয়াম ফসফরাস জিংক প্রভৃতি।
এটি এন্টি অক্সিডেন্টের ভালো উৎসই শুধু নয় এর রয়েছে এন্টি মাইক্রোবিয়াল এবং ক্যানসার বা অস্বাভাবিক কোষ অপরাসরণের ক্ষমতা। কামরাঙ্গা ফলের মধ্যে যতই গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন এবং মিনারেল থাকুক না কেন, পাকা কামরাঙ্গা জুস যতই সুস্বাদু লাগুক না কেন কামরাঙ্গার মধ্যে এমন দুইটি উপাদান রয়েছে যা মানব শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ ঘটাতে পারে এবং অতীতে বহু মানুষের কামরাঙ্গা খাবার কারণে মৃত্যু ঘটেছে এমন কি এই ফল খাবার ১ ঘণ্টা পরেই মৃত্যু ঘটার মতো ঘটনা ঘটেছে।
খাবার পর যে সব লক্ষণ বা প্রতিক্রিয়া দেখা যায় তার মধ্যে বিরামহীন হেচকি, বমি বমি ভাব, মাথা ঘুরানো, মানসিক ভারসাম্যহীনতা প্রভৃতি। চায়নার এক শহরে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদের মধ্যে ১০ জন কামরাঙ্গা খেয়ে অসুস্থতা বোধ করে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সবাই পরবর্তী সময়ে মারা যায়। এই মৃত্যু ঝুঁকি তাদের জন্য যারা বিভিন্ন কিডনি রোগে ভুগছেন।
যেমন কিডনি দুর্বল, কিছুটা নষ্ট, প্রায় কাজ করছে না অথবা পুরোটা নষ্ট অর্থাৎ ডায়ালসিস করতে হচ্ছে বা কিডনিতে পাথর রয়েছে এসব ক্ষেত্রে কামরাঙ্গা গ্রহণকারী ব্যক্তি উপরোক্ত লক্ষণসহ মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। এরমূল কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে কামরাঙ্গায় রয়েছে উচ্চমাত্রায় অক্সালিক এসিড যা দুর্বল কিডনির জন্য মারাত্মক হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে ১০০ মিলিলিটার কামরাঙ্গার জুসে ০.৫০ গ্রাম অক্সালিক এসিড রয়েছে।
সাওপলো বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে কামরাঙ্গা গ্রহণকারীদের মধ্যে ৩২ জনের মধ্যে ৩০ জনের হেচকি লক্ষণ দেখা দেয়। ৩ ভাগের ২ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে বমি হয়, মানসিক ভারসাম্যহীনতার কম লক্ষ্য করা গেছে। সুস্থ কিডনি যাদের রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে কামরাঙ্গা গ্রহণ করা যেতে পারে। কারণ তাদের ক্ষেত্রে এমন লক্ষণ দেখা যায়নি। কিন্তু ব্রাজিলিয়ান গবেষকরা গবেষণায় দেখলেন কামরাঙ্গার এমন একটি উপাদান আছে যা অন্যকোনো ফলে নেই। যা দুর্বল বা কিডনি ফেইলিয়র রোগীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর আর তা হল নিউরো টক্সিন।
গবেষকরা বলেছেন, যাদের কিডনি সঠিকভাবে কাজ করছে তাদের কিডনি এই মারাত্মক ক্ষতিকর নিউরো টক্সিনকে ছেঁকে রক্ত থেকে প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয় ফলে ব্রেনের নিউরনের ওপর এবং নার্ভাস সিস্টেমের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। সুতরাং সুস্থ ব্যক্তিদের পরিমাণ মতো কামরাঙ্গা খেতে কোনো সমস্যা নেই।
কিন্তু যাদের কিডনি দুর্বল বা অকার্যকর তাদের কিডনি এই মারাত্মক নিউরো টক্সিনকে বের করে দিতে পারে না। ফলে এটি ব্রেন এবং নার্ভাস সিস্টেমের ওপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, ফলে মাথা ঘোরা, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, কোষের শক্তি কমে যেতে থাকা, কোষের ওপর টান বা খিচুনি অনুভব করা বা খিচুনি হওয়া, অজ্ঞান হয়ে পড়া এমনকি কোমাতে চলে যাওয়া ঘটনা ঘটে। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় যে নিউরো টক্সিন কি এবং এটি আমাদের কিভাবে ক্ষতি করে কিছু জানা দরকার। কামরাঙ্গায় থাকা নিউরো টক্সিন আমাদের ব্রেনে নিউরনের কার্যক্ষমতাকে আটকে দেয়।
আমাদের ব্রেনে ৫০ বিলিয়ন নিউরন রয়েছে এবং নার্ভাস সিস্টেম, আমাদের শরীরের সমস্ত কর্মকা-, অনুভূতি, সংবাদ প্রেরণ, সাড়া দেওয়া, সংবাদ পেঁৗছানো সবই নিউরনের কাজ। কিন্তু নিউরো টক্সিন এই গুরুত্বপূর্ণ নিউরনের ওপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ড্যামেজ করে, ফলে নিউরন তার কাজ সঠিকভাবে করতে পারে না। সুতরাং দুর্বল কিডনি, নষ্ট হতে থাকা কিডনি, ক্রনিক কিডনি ডিসিস অথবা একেবারেই নষ্ট হয়ে যাওয়া কিডনি রোগী (ডায়ালাইসিস করছেন) যদি কামরাঙ্গা ভুল করে গ্রহণ করেন এটি তাদের দ্রুত মৃত্যুর কারণ ঘটাতে পারে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে একেবারেই অল্প অর্থাৎ অর্ধেক কামরাঙ্গা অথবা আট আউন্স কামরাঙ্গার সরবত বা জুস মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে এবং মৃত্যুও হতে পারে। সুতরাং কিডনি দুর্বল বা ঠিকমত কাজ করছে না এমন রোগী কামরাঙ্গা থেকে সাবধান। গর্ভবতী মায়েরা যদি কামরাঙ্গা খান তবে তা নিজের জন্য এবং গর্ভজাত শিশুর জন্য ক্ষতির কারণ ঘটতে পারে।
এ বিষয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালে শিশুদের কিডনি রোগের জন্য যে সকল শিশুরা চিকিৎসা নিতে আসে তাদের কিডনি সমস্যার কারণ হিসেবে গর্ভবস্থায় মায়েদের কামরাঙ্গা গ্রহণ করাকে অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ বলে অনেক চিকিৎক মনে করেন। তবে যাদের কিডনি সুস্থ রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে কামরাঙ্গা পরিমাণ মতো গ্রহণ করা যেতে পারে বলে বিশ্বের গবেষকরা বলেন। তবে আমি মনে করি 'প্রিভেনশন ইস বেটার দেন কিউর'। যা খেলে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে সেটা খাওয়ার দরকার কি?
ফলের কি অভাব রয়েছে! এমনিতেই বাংলাদেশে কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে ভুগছেন এমন রোগীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি বলে বাংলাদেশের কিডনি বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন এবং ভয়ঙ্কর সংবাদ হচ্ছে শতকরা ৯০% কিডনি রোগী জানেই না যে তার কিডনি রোগ রয়েছে। সুতরাং কামরাঙ্গা না খাওয়াই ভালো। ফলজ গাছ হিসেবে কামরাঙ্গা না লাগানোই ভালো। সচেতনতাই সুস্থ থাকার উপায়।
সুতরাং কামরাঙ্গার মধ্যে থাকা যে দুটি রাসায়নিক উপাদান ১. অক্সিলিক এসিড ২. নিউরো টক্সিন রয়েছে যা অন্যকোনো ফলমূল ও সবজির মধ্যে পাওয়া না গেলেও কোন কোন শাকসবজি ফলের মধ্যে অক্সালিড এসিড রয়েছে যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয় যা শরীরের জন্য নিরাপদ বা ক্ষেত্র বিশেষে প্রয়োজন রয়েছে। তবে পালং শাকে নিরাপদ পর্যায়ে অক্সালিড এসিড থাকলেও কিডনি রোগীদের বেশি না খাওয়া ভালো।