ছেলেবেলার পুজো
ছেলেবেলার পুজোর একটা অদ্ভুত গন্ধ থাকত। ওই যে সলিল চৌধুরির ওই গানটা…‘আয়রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে’। সেটা তখন পেতাম। কিন্তু এখন আর পাই না। এখন ব্যপারটা অনেকটা উত্সবের মতো। গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। বছরের চারটে দিন তো একটা উত্সব হবেই, ব্যাপারটা অনেকটা এমন।
এখনকার জেনারেশন এ সব তো পায়ই না। কই আমার বন্ধুদের তো শুনি না মহালয়ার ভোরে ছেলেমেয়েদের জোর করে ঘুম থেকে তুলে মহালয়া শোনাচ্ছে। কোথাও সেই সংস্কৃতিটা হয়তো হারিয়ে যাচ্ছে। আমার পুজো চিরকালই পাড়াময়।
আমাদের ছোটবেলায় দুর্গাপুজো বাংলা রচনার বর্ণনা অনুযায়ী আসত। নদীর ওপারে কাশফুলের মাথা দোলানো আর সুনীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, শিশির সিক্ত শিউলিফুল আর সোনালী রোদের ম্যাজিক। পুজোর আগে আগে তেড়েফুঁড়ে জ্বর আসত। সত্যডাক্তার দেখে যেতেন, দুটাকা ভিজিট ছিল। দাগকাটা শিশিতে মিক্সচার। এক ডোজে অনেকটা মিক্সচার হত। ছোট্ট একটা কাঁচের গ্লাসে ঢেলে দিত মা, ঢক করে গিলে নিতাম। অনেক জ্বরের মধ্যে হঠাৎ জল পড়ার শব্দে চোখ খুলে দেখতাম হ্যারিকেনের আলোয় কতগুলি উৎকণ্ঠিত মুখ।
মা মাথা ধুয়ে দিচ্ছে, টুকুনদা থার্মোমিটারে জ্বর দেখছে।, কপালে জলপটি। হঠাৎ একদিন দর দর করে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ত। মাথার কাছের খোলা জানলা দিয়ে দেখতাম চারিদিকে পুজো পুজো ভাব। মা মেশিনে জামা সেলাই করছে। হিসাব করতাম কটা জামা হবে পুজোয়। বড়দা কাগজের বাক্সে করে কলকাতা থেকে হালফ্যাশনের ফ্রক নিয়ে আসবে, জুতো কেনা হবে। রিকশা করে ঠাকুর দেখতে যাবো রাজবাড়ী, রায়পাড়া, জয়ন্তী সংঘ।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের বাড়ী অর্থাৎ রাজবাড়িতে পুজোর কোন আড়ম্বরই চোখে পড়ত না। দেবীমূর্তির বিশেষত্ব ছিল ঘোড়া সিংহ আর সবুজ রঙের অসুর। রাজা নাকি স্বপ্নে এই মূর্তিই পেয়েছিলেন। রাজবাড়ির পুজো বলতে চোখে ভাসে বিশাল ঠাকুর দালানের এক কোণে মা রাজ রাজেশ্বরী। বিশাল ঠাকুর দালানে অসংখ্য পায়রার বাসা। কিন্তু ঠাকুর তৈরী হত গঙ্গামাটি দিয়ে। বেয়ারারা অতিকষ্টে বহন করতো সেই প্রতিমা। রাজবাড়ির ঠাকুর বিসর্জন না হলে আর কোন ঠাকুর বিসর্জন হতে পারতো না।
ভাসান হত জলঙ্গী নদীতে। ভাসানের ঘাটে ধূমায়িত কুপির আলোয় নানরকম রসনা তৃপ্তিকর খাদ্য বিক্রী হত। লেবুর রস দেওয়া ছোলাসেদ্ধর স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। কদমতলায় আমাদের দোতলার বারান্দা থেকে ঠাকুরভাসানের শোভাযাত্রা দেখা যেত। মনে হত ১১ হাত মা কালীর মূর্তি হাত বাড়িয়ে ছোঁওয়া যাবে। বেহারাদের কাঁধে মা, কার্বাইডের বাতি জ্বেলে শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাওয়া হত, তার সঙ্গে ছেলেছোকরার উদ্দাম নাচ, মাইকে বাজত গীতা দত্তের গান….কাঁচের চুড়ির ছটা….এদিক ওদিক কিছু ধূমায়িত মশাল ……বাজির শব্দ।
পুজোর সময় দেবসাহিত্য কুটীর কাঠমলাটের পূজাবার্ষিকী বের করত- বেণুবীণা, উদয়াচল- কি সুন্দর সুন্দর নাম। বিধায়ক ভট্টাচার্যের অমরেশ, শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প আর শৈল চক্রবর্তীর ছবি,সুধীন্দ্রনাথ রাহার বিদেশী গল্পের ভাবানুবাদ, আশাপূর্ণা দেবীর অপূর্ব ছোটগল্প থাকত এইসব বইগুলিতে। আমাদের কিছুই ছিল না, তবুও এখন মনে হয় যেন অনেক কিছুই ছিল।
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন আমাদের চিলেকোঠার ছোট্ট ঠাকুরঘরে লক্ষ্মীপুজো হত। পেতলের গামলায় মা সিন্নি মাখতো। বাদকুল্লা থেকে পুরুতমশাই আসতেন। সকাল থেকে সাজ সাজ রব। দিদি কতরকম আলপনা দিত, শঙ্খলতা, খুন্তিলতা পদ্মলতা। মা লক্ষ্মীর জোড়া পায়ের চিহ্ন। পাশের বাঙাল বাড়িতে বাঁ পা, ডান পা, করে মা লক্ষ্মীর পায়ের চিহ্ন আঁকা হত। ওরা আমাদের ঠেস দিত-“তোদের ঠাকুর কি জোড় পায়ে লাফাতে লাফাতে ঘরে ঢুকবে”? আমরা এসব তুচ্ছ কথায় কান দিতাম না। মার কালিপড়া খইভাজা হাঁড়ি, বেড়ি সব তোলা থাকত।
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন মা নিজের হাতে খই ভাজত, মুড়কি নাড়ু তৈরী করত। আমাদের কাজ ছিল খই থেকে ধান বাছা। টুকুনদা দা দিয়ে তালের ফোঁপর কাটত। মোটা কালো খালি-গা ঠাকুরমশাই আসতেন বাদকুল্লা থেকে। আমরা ওর নাম দিয়েছিলাম হ্যাড্ডা-ব্যাড্ডা-দড়াম-দড়াম। কারণ উনি এসেই বাথরুমে ঢুকে যেতেন আর তারপর নানা রহস্যজনক গোলাগুলির মত শব্দ ভেসে আসত।
ভাইফোঁটার সকালে মা ডাকত-‘ওরে ওঠ, শিশির শুকিয়ে যাবে, দুব্বো তুলতে হবে’।
একটুকরো ছেঁড়া কাপড় আর ছোট্ট একটা পিতলের গেলাস নিয়ে মাঠে চলে যেতাম। ঘাসের ওপর কাপড়ের টুকরোটা বিছিয়ে দিলে সেটা শিশিরের জলে ভিজে যেত। তারপর ভেজা কাপড় নিংড়িয়ে শিশিরের জল গ্লাসে ধরতে হত। তারপর স্নান করে কাচা জামা পরে সেই শিশিরের জল দিয়ে চন্দন বেটে ঝকঝকে করে মাজা পিতলের থালার এক পাশে রেখে দিতে হত, আরো থাকত বাটা হলুদ, ছোট বাটিতে সুগন্ধি কেয়োকার্পিন তেল, চিরুণি, দই, চন্দন, ধান-দুব্বো আর একগোছা পান-সুপুরি। চার ভাইয়ের জন্য চারটে লাল ভেলভেটের আসন।
পেটে প্রচণ্ড খিদে, মায়ের আলুদমের পাগল করা সুগন্ধ। মা লুচি ভাজতে ভাজতে শাঁক বাজাচ্ছে। প্রথমে মাথায় তেল দিয়ে চিরুণী দিয়ে চুল আঁচড়ানো তারপর মন্ত্র বলে কপালে দই-চন্দনের ফোঁটা দিয়ে হাতে পানসুপুরি দিয়ে দাদাদের পায়ে প্রণাম। ছোটদা বলত “দেখিস বাবা, যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটার বদলে উঠলো কাঁটা বলিস না।।বড়দা তখন আমার হাতে দিত ভাইফোঁটার উপহার- বুদ্ধদেব গুহ-র লেখা জঙ্গল মহল, কিরীটি অমনিবাস।
এখনো আছে বড়দার হাতে লেখা “নান্নুমাঈকে ভাইফোঁটায় –বড়দা”- ব্যোমকেশ প্রথম খণ্ড,কিন্তু বড়দা নেই।
লুচি খেয়ে আমরা চরতে বেরোতাম, হাঁটতে হাঁটতে মোমিন পার্ক। মায়ের একটা আগুন রঙের নকল সিল্কের শাড়ি ছিল। আমি ভাইফোঁটার দিন ওটা পরে ফোঁটা দিতাম। পার্কের সবুজ ঘাসে আমি আর দিদি বসে আছি, দিদির মেয়ে পরীর মত প্রজাপতির পিছনে ছোটাছুটি করছে, ছেলে মাটির বেহালা থেকে সুর বার করার চেষ্টা করছে। দাদার বন্ধুর মন্তব্য-এখানে কি সিনেমার শুটিং হচ্ছে ।
এখন মনে হয় মা যেন দশভুজা ছিল। খুন্তি, চাকি-বেলুন, হাতা-বেড়ি জাঁতা ইত্যাদি ছাড়াও কাঁচি, সূচ সুতো-অনর্গল সেলাই কলের ঘরঘর-উলকাঁটা, সোয়েটারের বগলের ঘর ফেলা- গায়ে ফেলে মাপ নেওয়া, এমনকি লেস বোনা পর্যন্ত।
জগদ্ধাত্রী পুজোও কৃষ্ণনগরে খুব ধূমধাম করে হতো, এখন অবশ্য আরো জাঁকজমক হয়। আমাদের সময়ে বিসর্জনের সকালে ঘট বিসর্জন আর লরী করে ট্যাবলো- এসব কিছু ছিল না। কিন্তু মনে পড়ে আধা অন্ধকারে ধূমায়িত মশাল নিয়ে রে রে কে একদল লোক ছুটছে। বাহকদের কাঁধে মা চলেছেন দুলতে দুলতে, কে আগে যাবে তাই নিয়ে রেষারেষি হত আর মাঝে মাঝে এক আধটা লাশ পড়ে যেত।
সরস্বতী পুজো মানেই শাড়ি পরে স্কুলে যাওয়া। মায়ের শাড়ি ছাড়া গতি নেই কিন্তু দুঃখের বিষয় মার ভালো শাড়ি একেবারেই ছিল না । একবার সরস্বতী পুজোর দিন মার একটা পুরনো বিষ্ণুপুরী সিল্কের পরে বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি, ওখান থেকে স্কুলে যাবো, একটু যেতে না যেতেই বিশ্বাসঘাতকতা করে শাড়ি গেল খুলে।
মা শাড়িটা ফ্রকের ওপরই একটা গিঁট বেঁধে পরিয়ে দিয়েছিল। যাইহোক বন্ধুর বাড়িটা কাছে ছিল এই যা রক্ষে। সরস্বতী পুজোর আগে থেকেই আমাদের স্কুলে প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়ে যেত। ব্যাচ ব্যাচ করে আমাদের হলঘরে নিয়ে যাওয়া হত।সেখানে একদল ঝুরিতে ঘষে নতুন আলুর খোসা ছাড়াতো, আরেক দল কড়াইশুঁটির খোলা ছাড়াতো- খিচুড়ি-বাঁধাকপির তরকারি-আলুভাজা-চাটনি-রসগোল্লা-পান্তুয়া। ক্লাস ইলেভেনে আমাদের ওপর পুজোর ভার ছিল। পুজো খুব ভালো হয়েছিল তাই হেডমিস্ট্রেস আমাদের আলাদা করে মিষ্টি খাইয়েছিলেন।
সাজানো খুব ভালো হতো, মেয়েরা কাগজের মালা, খইএর মালা গাঁথতো, দিদিমনিরা দেখিয়ে দিতেন, ম্যাম নয়। একবার নাটক হল ‘বিন্দুর ছেলে’। আমি হয়েছিলাম এলোকেশী। ফার্স্ট গার্ল লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে কপালে লাল আবিরের টিপ আর সিঁথিতে লাল আবির দিয়ে বড় বৌ অন্নপূর্ণা হয়েছিল। অমূল্যকে নিয়ে যখন যাদব আর অন্নপূর্ণা বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে তখন বড়বৌ-র অভিনয় ফাটাফাটি হয়েছিল।
আমি এক বন্ধুর বাড়ি থেকে আনা পুরনো ঢাকাই শাড়ি-সিঁদুর বা লাল আবিরে গিন্নি হয়েছিলাম। তারপর যখন একটু ঘোমটা টানলাম আর আঁচলে বাঁধা চাবির গোছা পিছনে ছুঁড়ে ডায়ালগ বলতে শুরু করলাম তখন অডিয়েন্সে হাসির ছোঁয়া লাগল। এরপর থেকে আমি একজন পাকাপাকি মহিলা ভিলেনে পরিণত হলাম। টিচার্স ডে র জন্য রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’র নাট্যরূপ দিল ফার্স্ট গার্ল অপরাজিতা আর আমাকে অফার করল ফটিকের মামীর রোল! ভাবা যায়!
আমাদের কাছে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো ছিল বিরাট এক উৎসবের দিন। ছোটদার ভাষায় বড় লক্ষ্মীপুজো। আধখানা কদমাতেই আমরা খুশী ছিলাম। গুড়ের বাতাসা পেলে নিজেদের ধন্য মনে করতাম। কারণ উৎসবটা তো ছিল আমাদের মনে। আমাদের ঘুঁটেওয়ালি মেহেরুন্নিসা যেমন নাচতো-“আজ আমার লাচন উঠিছে”- শুধু একমুঠো গরম ভাত পেলে।
এখনকার জেনারেশন এ সব তো পায়ই না। কই আমার বন্ধুদের তো শুনি না মহালয়ার ভোরে ছেলেমেয়েদের জোর করে ঘুম থেকে তুলে মহালয়া শোনাচ্ছে। কোথাও সেই সংস্কৃতিটা হয়তো হারিয়ে যাচ্ছে। আমার পুজো চিরকালই পাড়াময়।
আমাদের ছোটবেলায় দুর্গাপুজো বাংলা রচনার বর্ণনা অনুযায়ী আসত। নদীর ওপারে কাশফুলের মাথা দোলানো আর সুনীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, শিশির সিক্ত শিউলিফুল আর সোনালী রোদের ম্যাজিক। পুজোর আগে আগে তেড়েফুঁড়ে জ্বর আসত। সত্যডাক্তার দেখে যেতেন, দুটাকা ভিজিট ছিল। দাগকাটা শিশিতে মিক্সচার। এক ডোজে অনেকটা মিক্সচার হত। ছোট্ট একটা কাঁচের গ্লাসে ঢেলে দিত মা, ঢক করে গিলে নিতাম। অনেক জ্বরের মধ্যে হঠাৎ জল পড়ার শব্দে চোখ খুলে দেখতাম হ্যারিকেনের আলোয় কতগুলি উৎকণ্ঠিত মুখ।
মা মাথা ধুয়ে দিচ্ছে, টুকুনদা থার্মোমিটারে জ্বর দেখছে।, কপালে জলপটি। হঠাৎ একদিন দর দর করে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ত। মাথার কাছের খোলা জানলা দিয়ে দেখতাম চারিদিকে পুজো পুজো ভাব। মা মেশিনে জামা সেলাই করছে। হিসাব করতাম কটা জামা হবে পুজোয়। বড়দা কাগজের বাক্সে করে কলকাতা থেকে হালফ্যাশনের ফ্রক নিয়ে আসবে, জুতো কেনা হবে। রিকশা করে ঠাকুর দেখতে যাবো রাজবাড়ী, রায়পাড়া, জয়ন্তী সংঘ।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের বাড়ী অর্থাৎ রাজবাড়িতে পুজোর কোন আড়ম্বরই চোখে পড়ত না। দেবীমূর্তির বিশেষত্ব ছিল ঘোড়া সিংহ আর সবুজ রঙের অসুর। রাজা নাকি স্বপ্নে এই মূর্তিই পেয়েছিলেন। রাজবাড়ির পুজো বলতে চোখে ভাসে বিশাল ঠাকুর দালানের এক কোণে মা রাজ রাজেশ্বরী। বিশাল ঠাকুর দালানে অসংখ্য পায়রার বাসা। কিন্তু ঠাকুর তৈরী হত গঙ্গামাটি দিয়ে। বেয়ারারা অতিকষ্টে বহন করতো সেই প্রতিমা। রাজবাড়ির ঠাকুর বিসর্জন না হলে আর কোন ঠাকুর বিসর্জন হতে পারতো না।
ভাসান হত জলঙ্গী নদীতে। ভাসানের ঘাটে ধূমায়িত কুপির আলোয় নানরকম রসনা তৃপ্তিকর খাদ্য বিক্রী হত। লেবুর রস দেওয়া ছোলাসেদ্ধর স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। কদমতলায় আমাদের দোতলার বারান্দা থেকে ঠাকুরভাসানের শোভাযাত্রা দেখা যেত। মনে হত ১১ হাত মা কালীর মূর্তি হাত বাড়িয়ে ছোঁওয়া যাবে। বেহারাদের কাঁধে মা, কার্বাইডের বাতি জ্বেলে শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাওয়া হত, তার সঙ্গে ছেলেছোকরার উদ্দাম নাচ, মাইকে বাজত গীতা দত্তের গান….কাঁচের চুড়ির ছটা….এদিক ওদিক কিছু ধূমায়িত মশাল ……বাজির শব্দ।
পুজোর সময় দেবসাহিত্য কুটীর কাঠমলাটের পূজাবার্ষিকী বের করত- বেণুবীণা, উদয়াচল- কি সুন্দর সুন্দর নাম। বিধায়ক ভট্টাচার্যের অমরেশ, শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প আর শৈল চক্রবর্তীর ছবি,সুধীন্দ্রনাথ রাহার বিদেশী গল্পের ভাবানুবাদ, আশাপূর্ণা দেবীর অপূর্ব ছোটগল্প থাকত এইসব বইগুলিতে। আমাদের কিছুই ছিল না, তবুও এখন মনে হয় যেন অনেক কিছুই ছিল।
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন আমাদের চিলেকোঠার ছোট্ট ঠাকুরঘরে লক্ষ্মীপুজো হত। পেতলের গামলায় মা সিন্নি মাখতো। বাদকুল্লা থেকে পুরুতমশাই আসতেন। সকাল থেকে সাজ সাজ রব। দিদি কতরকম আলপনা দিত, শঙ্খলতা, খুন্তিলতা পদ্মলতা। মা লক্ষ্মীর জোড়া পায়ের চিহ্ন। পাশের বাঙাল বাড়িতে বাঁ পা, ডান পা, করে মা লক্ষ্মীর পায়ের চিহ্ন আঁকা হত। ওরা আমাদের ঠেস দিত-“তোদের ঠাকুর কি জোড় পায়ে লাফাতে লাফাতে ঘরে ঢুকবে”? আমরা এসব তুচ্ছ কথায় কান দিতাম না। মার কালিপড়া খইভাজা হাঁড়ি, বেড়ি সব তোলা থাকত।
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন মা নিজের হাতে খই ভাজত, মুড়কি নাড়ু তৈরী করত। আমাদের কাজ ছিল খই থেকে ধান বাছা। টুকুনদা দা দিয়ে তালের ফোঁপর কাটত। মোটা কালো খালি-গা ঠাকুরমশাই আসতেন বাদকুল্লা থেকে। আমরা ওর নাম দিয়েছিলাম হ্যাড্ডা-ব্যাড্ডা-দড়াম-দড়াম। কারণ উনি এসেই বাথরুমে ঢুকে যেতেন আর তারপর নানা রহস্যজনক গোলাগুলির মত শব্দ ভেসে আসত।
ভাইফোঁটার সকালে মা ডাকত-‘ওরে ওঠ, শিশির শুকিয়ে যাবে, দুব্বো তুলতে হবে’।
একটুকরো ছেঁড়া কাপড় আর ছোট্ট একটা পিতলের গেলাস নিয়ে মাঠে চলে যেতাম। ঘাসের ওপর কাপড়ের টুকরোটা বিছিয়ে দিলে সেটা শিশিরের জলে ভিজে যেত। তারপর ভেজা কাপড় নিংড়িয়ে শিশিরের জল গ্লাসে ধরতে হত। তারপর স্নান করে কাচা জামা পরে সেই শিশিরের জল দিয়ে চন্দন বেটে ঝকঝকে করে মাজা পিতলের থালার এক পাশে রেখে দিতে হত, আরো থাকত বাটা হলুদ, ছোট বাটিতে সুগন্ধি কেয়োকার্পিন তেল, চিরুণি, দই, চন্দন, ধান-দুব্বো আর একগোছা পান-সুপুরি। চার ভাইয়ের জন্য চারটে লাল ভেলভেটের আসন।
পেটে প্রচণ্ড খিদে, মায়ের আলুদমের পাগল করা সুগন্ধ। মা লুচি ভাজতে ভাজতে শাঁক বাজাচ্ছে। প্রথমে মাথায় তেল দিয়ে চিরুণী দিয়ে চুল আঁচড়ানো তারপর মন্ত্র বলে কপালে দই-চন্দনের ফোঁটা দিয়ে হাতে পানসুপুরি দিয়ে দাদাদের পায়ে প্রণাম। ছোটদা বলত “দেখিস বাবা, যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটার বদলে উঠলো কাঁটা বলিস না।।বড়দা তখন আমার হাতে দিত ভাইফোঁটার উপহার- বুদ্ধদেব গুহ-র লেখা জঙ্গল মহল, কিরীটি অমনিবাস।
এখনো আছে বড়দার হাতে লেখা “নান্নুমাঈকে ভাইফোঁটায় –বড়দা”- ব্যোমকেশ প্রথম খণ্ড,কিন্তু বড়দা নেই।
লুচি খেয়ে আমরা চরতে বেরোতাম, হাঁটতে হাঁটতে মোমিন পার্ক। মায়ের একটা আগুন রঙের নকল সিল্কের শাড়ি ছিল। আমি ভাইফোঁটার দিন ওটা পরে ফোঁটা দিতাম। পার্কের সবুজ ঘাসে আমি আর দিদি বসে আছি, দিদির মেয়ে পরীর মত প্রজাপতির পিছনে ছোটাছুটি করছে, ছেলে মাটির বেহালা থেকে সুর বার করার চেষ্টা করছে। দাদার বন্ধুর মন্তব্য-এখানে কি সিনেমার শুটিং হচ্ছে ।
এখন মনে হয় মা যেন দশভুজা ছিল। খুন্তি, চাকি-বেলুন, হাতা-বেড়ি জাঁতা ইত্যাদি ছাড়াও কাঁচি, সূচ সুতো-অনর্গল সেলাই কলের ঘরঘর-উলকাঁটা, সোয়েটারের বগলের ঘর ফেলা- গায়ে ফেলে মাপ নেওয়া, এমনকি লেস বোনা পর্যন্ত।
জগদ্ধাত্রী পুজোও কৃষ্ণনগরে খুব ধূমধাম করে হতো, এখন অবশ্য আরো জাঁকজমক হয়। আমাদের সময়ে বিসর্জনের সকালে ঘট বিসর্জন আর লরী করে ট্যাবলো- এসব কিছু ছিল না। কিন্তু মনে পড়ে আধা অন্ধকারে ধূমায়িত মশাল নিয়ে রে রে কে একদল লোক ছুটছে। বাহকদের কাঁধে মা চলেছেন দুলতে দুলতে, কে আগে যাবে তাই নিয়ে রেষারেষি হত আর মাঝে মাঝে এক আধটা লাশ পড়ে যেত।
সরস্বতী পুজো মানেই শাড়ি পরে স্কুলে যাওয়া। মায়ের শাড়ি ছাড়া গতি নেই কিন্তু দুঃখের বিষয় মার ভালো শাড়ি একেবারেই ছিল না । একবার সরস্বতী পুজোর দিন মার একটা পুরনো বিষ্ণুপুরী সিল্কের পরে বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি, ওখান থেকে স্কুলে যাবো, একটু যেতে না যেতেই বিশ্বাসঘাতকতা করে শাড়ি গেল খুলে।
মা শাড়িটা ফ্রকের ওপরই একটা গিঁট বেঁধে পরিয়ে দিয়েছিল। যাইহোক বন্ধুর বাড়িটা কাছে ছিল এই যা রক্ষে। সরস্বতী পুজোর আগে থেকেই আমাদের স্কুলে প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়ে যেত। ব্যাচ ব্যাচ করে আমাদের হলঘরে নিয়ে যাওয়া হত।সেখানে একদল ঝুরিতে ঘষে নতুন আলুর খোসা ছাড়াতো, আরেক দল কড়াইশুঁটির খোলা ছাড়াতো- খিচুড়ি-বাঁধাকপির তরকারি-আলুভাজা-চাটনি-রসগোল্লা-পান্তুয়া। ক্লাস ইলেভেনে আমাদের ওপর পুজোর ভার ছিল। পুজো খুব ভালো হয়েছিল তাই হেডমিস্ট্রেস আমাদের আলাদা করে মিষ্টি খাইয়েছিলেন।
সাজানো খুব ভালো হতো, মেয়েরা কাগজের মালা, খইএর মালা গাঁথতো, দিদিমনিরা দেখিয়ে দিতেন, ম্যাম নয়। একবার নাটক হল ‘বিন্দুর ছেলে’। আমি হয়েছিলাম এলোকেশী। ফার্স্ট গার্ল লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে কপালে লাল আবিরের টিপ আর সিঁথিতে লাল আবির দিয়ে বড় বৌ অন্নপূর্ণা হয়েছিল। অমূল্যকে নিয়ে যখন যাদব আর অন্নপূর্ণা বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে তখন বড়বৌ-র অভিনয় ফাটাফাটি হয়েছিল।
আমি এক বন্ধুর বাড়ি থেকে আনা পুরনো ঢাকাই শাড়ি-সিঁদুর বা লাল আবিরে গিন্নি হয়েছিলাম। তারপর যখন একটু ঘোমটা টানলাম আর আঁচলে বাঁধা চাবির গোছা পিছনে ছুঁড়ে ডায়ালগ বলতে শুরু করলাম তখন অডিয়েন্সে হাসির ছোঁয়া লাগল। এরপর থেকে আমি একজন পাকাপাকি মহিলা ভিলেনে পরিণত হলাম। টিচার্স ডে র জন্য রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’র নাট্যরূপ দিল ফার্স্ট গার্ল অপরাজিতা আর আমাকে অফার করল ফটিকের মামীর রোল! ভাবা যায়!
আমাদের কাছে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো ছিল বিরাট এক উৎসবের দিন। ছোটদার ভাষায় বড় লক্ষ্মীপুজো। আধখানা কদমাতেই আমরা খুশী ছিলাম। গুড়ের বাতাসা পেলে নিজেদের ধন্য মনে করতাম। কারণ উৎসবটা তো ছিল আমাদের মনে। আমাদের ঘুঁটেওয়ালি মেহেরুন্নিসা যেমন নাচতো-“আজ আমার লাচন উঠিছে”- শুধু একমুঠো গরম ভাত পেলে।