প্রাচ্যাত নাটকের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ
সমস্ত শিল্পকলার এই ইতিহাস আছে । সভ্যতার আদি অংশের সঙ্গে যেসব শিল্পকলার ইতিহাস জড়িত তার মধ্যে নাটক একটি । ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় গ্রীস, ভারতবর্ষ ও রোমের নাট্য- ঐতিহ্য সবচেয়ে প্রাচীন । এদের মধ্যে গ্রীস ও ভারতবর্ষের নাট্য মঞ্চের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় যে, প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ধর্মের প্রয়োজনে নাটকের সৃষ্টি । ভারতীয় নাট্যমঞ্চঃ ভারতবর্ষ বহু প্রাচীন সভ্যতার লীলাক্ষেত্র ।
খ্রীস্টপুব ১৫০০ থেকে ২০০ শতক অবধি এই দীর্ঘ সময় ইতিহাসের পাতায় অত্যন্ত ঐশযমন্ডিত বৈদিক সভ্যতার যুগ বলে চিহ্নিত । ভারতীয় নাট্যমঞ্চের আদি ইতিহাস আলোচনা করলে জানা যায় যে, শিব বা মহাদেবই হলেন সে দেশের নাট্যকলার জন্মদাতা । বিশ্বের স্রষ্টা ব্রম্ব্রা নাট্যকলা শেখেন মহাদেবের কাছ থেকে এবং তারপর তিনি গন্ধববেদ বা নাট্যবেদ রচনা করেন ।
এটিই বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন নাট্যশাস্ত্র । দেবতারা যখন অসুরদের সঙ্গে যুব্ধে জয়লাভ করলেন তখন ব্রম্রা দেবরাজ ইন্দ্রের সন্ত্রষ্টি বিধানের জন্য প্রথম ভারতীয় হিন্দু নাটক ‘সমুদ্র মন্থর’ রচনা করেন । ভারতবর্ষে প্রাক-বিভক্ত সমাজের অবসান ঘটিয়ে যখন দাস সমাজ পক্ষ বিস্তার করেছিল তখনই এই নাটকের সূত্রপাত । আবার আমরা দেখতে পাই, মহাদেবের সঙ্গে পাবর্তীর বিবাহ উপলক্ষে দ্বিতীয় হিন্দু নাটক ‘ত্রিপুরাধা’ যখন মঞ্চস্থ হয় তখন মহাদেব নিজেও সেই নাটকের একজন দর্শক ছিলেন ।
কিন্তু নাটকটিতে কোন নৃত্য সংযোজিত হয়নি বলে তিনি সন্তষ্ট হতে পারেননি এবং তাঁর আদেশে তাঁরই শিষ্য তান্ডু সেই নাটকে একটি নৃত্য পরিবেশন করেন । তান্ডুর নামানুসারে সেই নৃত্য তান্ডব নৃত্য নামে পরিচিত হয় । এদিকে ভারতীয় নাটকে লাস্য-নৃত্যের প্রবর্তন করেন স্বয়ং পাবর্তী এবং তাঁর কাছ থেকে সবর্প্রথম উক্ত নাচ শেখেন রাজা বানের কন্যা উষা । তারপর এই নৃত গোপীবালাদের মাধ্যমে সৌরাষ্ট্রের মহিলাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে । ভারতীয় নাটকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময় হল সামন্ত যুগ । এই যুগের উজ্জলতম নক্ষত্র হলেন মহাকবি কালিদাস ।
কালিদাসের বহু অগ্রবর্তী হলেন দক্ষিণাতের অধিবাসী সংকৃত নাট্যকার ভান । ইনি দশটি নাটক লিখেছিলেন । কিন্তু খ্যাতি ও সাফল্য লাভ করেছিলেন কালিদাস । সংকৃত নাটকের এই যুগটি খ্রীস্টীয় প্রথম থেকে তৃতীয় শতকের মধ্যেই হওয়া সম্ভব । কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ নাটক বিশ্ববিশুত । তাঁর অপর দুটি নাটক ‘বিক্রমবর্শী’ ও ‘মালবিকাগ্নি মিত্র’ ।
কালিদাসের পরবর্তী লেখকদের মধ্যে রাজা শুদকের ‘মুচ্ছকটিক’ নাটকটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । গ্রীক নাটকঃ গ্রীক নাটকের সূত্রপাত সরাসরি কোন দেবতার হাতে ঘটেছে এমন কথা সেই দেশের নাট্য ইতিহাসে নেই । তবে এদেরও একজন নাট্য দেবতা ছিলেন । তিনি হলেন এপোলোর সন্তান ডাইওনিসাস (Dionysus) । অথচ প্রথম গ্রীক নাটকের রচয়িতা একজন মানুষ – নাট্যকার এসকাইলাস (Aeschylus) ।
পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই প্রথম নাট্যকার । তৎকালে ডাইওনিসাসের সন্মানার্থে বা সন্তুষ্টির জন্যে এক ধরনের সমবেত-সংগীত গাওয়া হতো । এই সমবেত সংগীতের মধ্যে দেবতাদের গুনগান করা হত । কালক্রমে শোক্রে বর্নিত কোন বিশষ চরিত্রের রূপ দেয়ার প্রয়োজন অনুভূত হয় এবং খ্রীস্টপূব ছয় শতকে থেসপিস (Thespis) সেই উপাসনা সংগীতে একটি অভিনেতার চরিত্র জুড়ে দেন; তবে এই চরিত্রটিতে মূক অভিনয় করতে হত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চরিত্রের মুখোশ পরে।
এই ঐতিহ্য অনুসরন করেই অসকাইলাস তাঁর প্রথম ‘The Suppliants’ রচনা করেন খ্রীস্টপূব ৪৯০ শতকে এবং এই নিয়মের মধ্যে কিছু পরিবর্তন ঘটান । এই নাটকে তিনি দুটি অভিনেতার ব্যবস্থা করেন এবং তাদের মুখে কিছু ভাষা জুড়ে দেন । এমনিভাবে এক কালের উপাসনা সংগীত ধীরে ধীরে নাটকে পরিনত হয় । গোড়াতে আজকের অর্থে মঞ্চ বলে কিছুই ছিল না । আসকাইলাস নাটক করতেন পাহাড়ের উঁচু জায়গায় কোন রকমে একটু ব্যবস্থা করে নিয়ে । দর্শকবৃন্দ নিচে বসে উন্মুক্ত মাঠে বসে সে অভিনয় দেখত ।
নাট্যকার নাটক লিখে নিজেদের দলবল নিয়ে তা তৈরী করতেন এবং সেটা মঞ্চস্থ করবার ব্যায়ভার বহন করতেন সমাজের ধনী সম্প্রদায় । তখনকার দিনে নাট্যকারই ছিলেন মূল ব্যক্তি এবং তাকে গিরেই নাট্যসম্প্রদায় গড়ে উঠতো । নাট্য সম্প্রদায়ের এই উৎসাহের দরুনই উন্মুক্ত পাকা মঞ্চ গড়ে উঠতে থাকে ধীরে ধীরে । আসকাইলাসের পর যিনি গ্রীক নাটকে আবির্ভূত হন তিনি হলেন নাট্য ইতিহাসের অবিস্মনীয় ব্যাক্তি সোফেক্লেস (Sophocles) । তাঁর হাতেই নাট্যকলার বিভিন্নমুখী অগ্রগতি ঘটে । তিনি প্রথম Trilogy প্রথা তুলে দিয়ে সেটার পরিবর্তে পৃথক পৃথক বিষয়ের ওপর তিনটি নাটক মঞ্চথ করার নিয়ম চালো করেন । ধীরে ধীরে নাটকে সংলাপের পরিমান বৃব্ধি পায় ।
থেসপিস থেকে আরম্ভ করে সোফোক্লেস পযর্ন্ত নাটকগুলোতে একটানাভাবেই রূপকথার গল্প, রাজ-রাজড়ার কাহিনী এবং তদুপরি দেবতার প্রার্দুভাব লক্ষ্য করা যায় । সাধারন মানুষের জীবন আচার এই নাটকগুলোতে প্রবেশাধিকার পায়নি । কিন্তু সোফোক্লেসের চাইতে দশ বছরের কনিষ্ঠ ইউরিপিডেস জীবনকে দেখতে আরম্ভ করেছিলেন অন্য দৃষ্টিতে । নাটকে তিনি বাস্তব ও সাধারন মানুষের মধ্যে নিয়ে এসে সেটার মাধ্যমে জীবনদর্শন তুলে ধরবার জন্যে আগ্রহান্বিত হয়ে ওঠেন ।
গল্পের সন্ধানে তিনিও রূপকথার দারস্থ হয়েছেন বটে কিন্তু রূপকথার রাজরানী আর ভগবানকে বাদ দিয়ে সব চরিত্রকে সাধারন মাটির মানুষে পরিনত করলেন । তিনিই প্রথম রূপকথা –উপকথার অবাস্তব দেশ থেকে নাটককে মাটির ধরনীতে সাধারন মানুষের কাছে হাজির করে দেন । এজন্যেই নাট্যজগতে বাস্তববাদের পথপ্রদর্শক হলেন ইউরিপিডেস । তাঁর পথ ধরেই খ্রীস্টপূব ৪২৫ শতকে এরিস্টোফ্যানিস রচনা করেন ‘The Acharnians’ ।
যেটি একটি যুব্ধবিরোধী নাটক । এতে নাট্যকার রাজনীতির প্রতি কটাক্ষ করেছেন । তাছাড়া তাঁর নাটকের মধ্যে ধনী- দরিদ্রের সমস্যাও দেখা দেয় প্রবল করে । তাঁর প্রতিটি নাটকই প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করে । এরিস্টোফ্যানিস এর মৃত্যুর পর এথেন্সের রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটে এবং বুর্জোয়া সভ্যতার সূচনা হতে থাকে । মানুষের চিন্তার মধ্য থেকে সকল দেবতাই বিদায় নিতে বাধ্য হয় একমাত্র প্লুটাস (Plutus) টিকে থাকে । বনিক মনভাব প্রবল হয়ে ওঠে এবং অর্থোপাজর্নটা বড় হয়ে দেখা দেয় । এই সময় সারা গ্রীস জুড়ে ব্যাপক মঞ্চ-তৎপরতা দেখা দেয় । পুরানো নাট্যশালার সংস্কার করা হয়, অর্ধবৃত্তাকারে নতুন মঞ্চশালা তৈরী হয়, মঞ্চসজ্জায় বিস্তর পরিবর্তন ঘটে এবং মঞ্চ দ্রুতগতিতে বাস্তবতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে । এই যুগের উল্লেখযোগ্য নাট্যকার মেনানডার (Menander) ।
তাঁর কোন কোন নাটক আজকের দিনের নাটকের তুলনায়ও বেশী আধুনিক । খ্রীস্টপূব দুই শতাব্দী পযর্ন্ত গ্রীক নাটকের এই বিস্তৃতি এবং এখানেই গ্রীক মঞ্চের সমাপ্তি ঘটে । রোমান নাটকঃ গ্রীক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গড়ে উঠে রোমান সাহিত্য ও মঞ্চ । কিন্তু রোমানদের নাটকের মধ্যে বহির্মুখীন দৃষ্টিভঙ্গিটাই প্রবল । গ্রীকদের প্রত্যক্ষ প্রভাবেই রোমের নাট্যশালা গড়ে ওঠে এবং সৃষ্টি হয় ল্যাটিন নাটকের । কর্ডোভার অধিবাসী সেনেকা হলেন রোমান মঞ্চের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাট্যকার । তিনিই প্রথম নাট্যকার যিনি নাটককে পাঁচ অংকে ভাগ করেন ।
তাছাড়া সমবেত সংগীত কমিয়ে তা একেবারে নামে মাত্র রাখেন এবং প্রস্তাবনা অংশকে নাটকীয় ঘটনায় পরিনত করেন । গ্রীক আমলে নাট্যশালাগুলো তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল – Auditorium, Orchestra এবং Stage । কিন্তু রোমানগণ চতুর্দিকে দেয়ালবেষ্টিত একটি পেক্ষাগৃহের মধ্যে উপরোক্ত তিনটি ভাগকে একত্রে সন্নিবেশ করেন । মঞ্চসজ্জার জাঁকজমক বৃব্ধি পায় এবং মঞ্চের সম্মুক্ষভাগে একটি পর্দা প্রথা চালু হয় । রোমান যুগে উপরোক্ত অগ্রগতি ব্যাতীত মঞ্চের ক্ষেত্রে আর বিশেষ কোন অগ্রগতি ঘটেনি ।
খ্রীস্টীয় পঞ্চাশ শতকে বারবারদের হাতে রোমান সম্রাজ্যের পতন ঘটে । তাঁরপর থেকে দীর্ঘকালের জন্যে ইউরোপের ভূখন্ডে কয়েক শতাব্দীকে রোমান নাট্যমঞ্চের অন্ধকার যুগ বলা চলে । কারন গথ, ভ্যানডাল এদের মধ্যে কোন জাতিরই নাট্যকলার প্রতি অনুকূল মনভাব ছিলনা । এ সময় সমস্ত ইউরোপে খ্রীস্ট্রীয় মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে এবং এক নতুন নৈতিকতার উদ্ভব হয় । ফলে ধর্মীয় নাটকের সূচনা হয় সকল ক্ষেত্রে । এসব নাটক Liturgical Drama বলে পরিচিত ছিল । দশম শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পযন্ত এই নাটক চলে ।
কিন্তু নাটকের অগ্রগতির ক্ষেত্রে এই ধরনের নাটকের কোন অবদান নেই । তাই রোমান যুগের অবসানের পর পাশ্চাত্য মঞ্চ আর এগোতে পারেনি বাস্তব অর্থে । প্যালেস্টাইন নাটকঃ প্যালেস্টাইনের অধিবাসী হিব্রুগন একটি অত্যন্ত প্রাচীন জাতি । সমস্ত প্রাচ্য ভূমিতে হিব্রু জাতির বাসভূমি প্যালেস্টাইনই হলো দ্বিতীয় জায়গা যেখানে প্রাচীন যুগেও নাট্য-সাহ্যিতের অস্তিত আমরা খুঁজে পাই । তবে প্যালেস্টাইনে কোথাও নাট্যাভিনয় হত কিংবা নাট্যমঞ্চের অস্তিত ছিল এমন প্রমান পাওয়া যায় না ।
“The book of Job” একমাত্র নাট্যগ্রন্থ হিব্রুজাতির । যব (খ্রীঃ পূঃ ৩৫০) গ্রীক ট্র্যাজেটির আঙ্গিকে এই নাটকটি রচনা করেছিলেন । ভাল মন্দের ভেদাভেদকে কেন্দ্র করেই এই দার্শনিক নাটকটি রচিত । তাই গ্রীক নাটকের প্রভাব এখানে অত্যন্ত স্পষ্ট । চৈনিক নাটকঃ খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বিশেষ বিশেষ ধর্মানুষ্ঠানে সমবেত নাচ গান এবং নীরব অঙ্গভঙ্গি জুড়ে দেয়া হতো ।
এই ধর্মানুষ্ঠানই কালক্রমে পরিবর্তন পরিমার্জিত হয়ে অবশেষে ধর্মীয় নাটকে রূপান্তরিত হয় । এর পর প্রায় একাদশ শতক পযন্ত চৈনিক নাট্য ইতিহাসের পাতা প্রায় শূন্য । একাদশ শতকে তাতারদের মধ্যে মঞ্চাভিনয়ের প্রমান পাওয়া যায় । অবশেষে ত্রয়োদশ শতকে মোঘল শাসনামলে চীনে একটি নাটক মঞ্চস্থ হয় । সেই সময় কয়েকটি ব্যবসায় প্রতিষ্টান নাট্য প্রযোজনা শুরু করে ।
যদিও মঞ্চায়নের আয়োজন ও উপকরন খুবই সামান্য ছিল । কিন্তু নাটকের পাত্র-পাত্রীগন খুবই ব্যয়বহুল ও জাঁকজমক পোষাক ব্যবহার করত । মঞ্চসজ্জার অভাবে বাস্তবতার পরিবেশে যে ঘাটতি হত তা পূরন করতে হত অভিনেতাদের অভিনয়ের মাধ্যমে । তৎকালে চীনে নাটককে ‘মিলিটারী’ও’সিভিল’ দুটি শ্রেনীতে ভাগ করা হত । মিলিটারী শ্রেনী বিভাগের মধ্যে ঐতিহাসিক ঘটনা বা চরিত্র সংযোজিত হত এবং যুব্ধ, মারামারি, খুনোখুনির দৃশ্য সংযোজিত হত স্বাভাবিকভাবেই । সিভিল নাটকের বিষয়বস্তু ছিল সাধারন মানুষের জীবনকথা, বিশেষ করে পারিবারিক জীবন । মধ্যযুগের চৈনিক নাট্যকারদের মধ্যে ওয়াং শিহক বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য । তাঁর তেরটি নাটক আজও টিকে আছে ।
নবজাগরন পর্ব
পঞ্চাদশ শতকে সমগ্র ইউরোপের সাহিত্য শিল্পের জগতে এক নবপ্রান স্পন্দন দেখা দেয়- পূনর্জাগরনের সাড়া পরে যায় যা সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক পন্ডিতগন রেনেসাঁ বলে আখ্যায়িত করেছেন । সাহিত্য, রাজনীতি সকল ক্ষেত্রে নবতর দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষ ঘটে । ইতালীয়ান নাটকঃ এই সময় ইতালীয় নাটকে মঞ্চের দ্বিবিধ উন্নতি সাধিত হয় । ক্লাসিকাল মঞ্চের রীতিতেই অভ্যন্তরে মঞ্চ গড়া হয় এবং Three dimensional effect বা ত্রিমাত্রিক দৃশ্যসজ্জার মাধ্যমে ব্যাপ্তি ও গভীরতা আনায়ন করার চেষ্টা করা হয় । তাছাড়া দর্শকবৃন্দের বসবার জায়গা থেকে পাঁচ ফুট উঁচুতে মঞ্চ স্থাপন করা হয় ।
মঞ্চ পুনর্গঠন ও সাজসজ্জার ব্যাপারে প্রায় অর্ধ শতাব্দী কাল ধরে ইতালীয় মঞ্চাধ্যক্ষগন নানা প্রকার পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান এবং সেটার সাফল্যজনক পরিসমাপ্তি ঘটে ১৫৮৪ খ্রীস্টাব্দে Teatro Olimpico নাট্যমঞ্চে । সেই সময়ে নাটকের এত অগ্রগতির সত্তেও এরিস্টটলের লেখা Rule of the three unites ইতালীয় নাট্যজগতের অগ্রগতিকে রোধ করে দেয় । ফরাসী নাটকঃ এই সময় ফ্রান্সে কিছু পেশাদার মঞ্চ গড়ে ওঠে । জনসাধারনের মধ্যে নাট্য তৎপরতা বেড়ে যায় ।
এই যুগে বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য নাট্যকার আলেকজেন্ডার হার্ডি(Alexander Hardy) প্রায় ছয়শত নাটক রচনা করেন । রোমান্টিসিজম এই সময়ের নাটকের মূল চরিত্র । স্পেনীয় নাটকঃ স্পেনীয় মঞ্চ যখন প্রায় প্রাগৈতিহাসিক পযায়ে বিরাজমান তখন সে দেশে মঞ্চ আন্দোলনের গোড়াপত্তন ঘটে । তারপর মাত্র আর্ধশতাব্দীর মধ্যে এক অত্যন্ত গৌরবময় ঐতিহ্য গড়ে তোলে স্পেনের মঞ্চ । এই ঐতিহ্যের সবশেষ স্থপতি লোপ দ্য ভেগা (Lope De Vega) । তিনি প্রায় সতেরশ নাটক রচনা করেন যার চারশ নাটকের অস্থিত আছে আজো । এমন অধিক সংখক নাটক পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোন নাট্যকার করেননি ।
ভেগা বৃহত্তর জনসাধারনের জন্যে নাটক লেখার অনড় ব্রত নিয়ে কাযর্ক্ষেত্রে অবর্তীন হন । দর্শক যা আশা করবে এবং তাদের জন্য যা পরিবেশন করা প্রয়োজন সেটাই ছিল নাট্য রচনাকালে তার বিবেচ্য বিষয় । সবল, সাবলীল, গতিময় ভাষায় লোপ দ্য ভেগা তাঁর Fuenta Ovejuna নাটকে শ্রেনী সংঘাতের যে চরম চিত্র অঙ্কন করেছেন তা রেঁনেসা যুগের যে কোন নাটকে প্রায় দুর্লভ ।
ইংল্যান্ডীয় নাটকঃ স্পেনীয় নাটক যখন এমনিভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথের শাসনামল । রানী এলিজাবেথ মঞ্চাভিনয় খুব পছন্দ করতেন । রানীর এই নাট্যপ্রিয়তা একধিকে যেমন নাট্যকার ও শিল্পীদের উৎসাহিত করেছে অন্যদিকে নাট্য আন্দোলনকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করেছে ।
এলিজাবেথের সময় নাট্যকারের সংখ্যা ছিল অনেক । এদের মধ্যে বিস্ময়কর ক্ষমতার অধিকারী ক্রিস্টোফার মার্লো সবার্গ্রে স্মরনীয় । ইংল্যান্ডে বিপ্লবাত্নক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ছিলেন মার্লো । মার্লো ১৫৮৮ সালে Dr. Faustus নামে একটি নাটক রচনা করেন যা পরবর্তীতে শেক্সপীয়রের সমস্ত ট্রাজেডি নাটকের মূল উৎস ও অনুপ্রেরনা হিসেবে কাজ করে । তাঁর অন্যান লেখার মধ্যে The Jew of Malta বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । কিন্তু অকালেই মার্লোর জীবনে নাটকের যবনিকা নেমে আসে । ১৫৯৩ সালে তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হন । এরপর শুরু হয় শেক্সপীয়রের যুগ ।
শেক্সপীয়রের অতুলনীয় নাট্যপ্রতিভা নিয়ে গত দুই শতাব্দীকাল সমগ্র পৃথিবীতে এতো বেশী আলোচনা হয়েছে যে অন্য কোন নাট্যকারের রচনা নিয়ে তা হয়নি । শেক্সপীয়রের যাত্রা শুরু হয় মার্লোর আদর্শে । তাছাড়া গ্রীন ও টমাস কীডের প্রভাবও ছিল তাঁর মধ্যে । দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বনাট্যমঞ্চে যে বিবর্তন সংঘটিত হচ্ছিল সেটার এক বড় অধ্যায়ের সাফল্যজনক পরিনতি ঘটেছে শেক্সপীয়রে । তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে – কিং লিয়ার, লেডী ম্যাকবেথ, অ্যান্টনিও এবং ক্লিয়োপেট্টা, রোমিও জুলিয়েট, জুলিয়া সিজার অন্যতম ।
অবশেষে উনবিংশ শতকের প্রথমভাগে মঞ্চ তার মধ্যযুগীয় সম্পর্ক চুকিয়ে বাস্তববাদী আধুনিক জগতে প্রবেশ করে । ১৮৩০ থেকে ১৮৭০ খ্রীস্টাব্দ পযর্ন্ত নাট্যজগতে এক নতুন যুগের সূচনা হয় । এই সময়ের মধ্যে নাটক রচনা থেকে আরম্ভ করে প্রযোজনা, পরিচালনা, অভিনয়, মঞ্চসজ্জা, আলোকসম্পাত প্রভৃতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং নতুন নতুন পব্ধতি আবিষ্কৃত হয় ।
১৮২০ খ্রীস্টাব্দে গ্যাসলাইট ব্যবহিত হতে অরম্ভ হয় মঞ্চে । এতোকাল অবধি মোমবাতি বা ল্যাম্প জাতীয় তেমন কিছু জালিয়ে মঞ্চ আলোকিত করা হত । গ্যাস লাইট চালু হওয়ার পর থেকে আলোক নিয়ন্ত্রন অনেকাংশে সহজ হয়ে আসে । তার ফলে দর্শকদের মধ্য থেকে অভিনেতাগনকে আলাদা করে নেয়া সম্ভব হয় । এই পৃথকীকরন সম্ভব হওয়ার জন্যই মঞ্চের সম্মুখে পর্দার ব্যবহার এক নতুন মাত্রা পায় । পর্দা দশর্ক ও অভিনেতাদের মধ্যে সীমারেখা হয়ে দাঁড়ায় । ধীরে ধীরে অলোকসম্পাত কারায়ত্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চসজ্জার নানা পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে ।
নবনাট্য পর্ব
বাস্তবাদী নবনাট্য আন্দোলনের শুভ উব্দোধন হয় ১৮৫০ সালে প্রথম গদ্য নাটক হেনরিক ইবসেনের ‘Catilina’র মাধ্যমে । এর অর্ধ শতক পর বাস্তবাদী নাটকের এক প্রবল জোয়াড় বয়ে যায়, যার অবগাহন করেছিলেন ইবসন ছাড়াও স্ট্রীগুবার্গ, চেখভ, সিংগে, পিরানডেলো, হপ্তমান এবং বানার্ড শ-র মতো রথী-মহারথী ।
ইতিহাসে ইবসনকে নবনাট্য আন্দোলনের দিশারী হিসেবে উল্লেখ্য করা হয় । যদিও তাঁরও আগে জার্মান নাট্যকার ফেডরিক হেব্বেল ও ফরাসী লেখক এমিল জোলা বাস্তববাদী নাটকের সূচনা করেছিলেন । সমাজের নিম্নমধ্যবিত্তের জীবন কথা, তাদের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, নৈতিকতার প্রতি আকর্ষন এবং ব্যাক্তির ও সমাজের সঙ্গাত এ সবই হেব্বেল আমদানী করেছিলেন তার নাটকে ।
অপরদিকে জোলা সমাজের বস্তুতান্তিক নগ্নবাস্তবতাকে ফটোগ্রাফিক সততায় নাটকের মাধ্যমে মঞ্চে তুলে আনেন । তবু ইবসনই নবনাট্য আন্দোলনের জনক । কারন তিনি এই নাট্যরীতির সবার্পেক্ষা শক্তিশালী প্রবক্তা এবং কর্মী । মনীষী বার্নাড শ’র মতে “ইবসনে যদি নাটক রচনা না করতেন তাহলে ইউরোপীয় নাট্যমঞ্চে নবযুগের সূচনা হতো না কোনদিন ।”
ইবসেন নাট্যকার হিসেবে আন্তপ্রকাশের বহু আগে থেকেই মঞ্চের সাথে জড়িয়ে পরেন । তার নাট্যকর্মকে চার ভাগে ভাগ করা চলে । Catilina থেকে আরম্ভ করে The Pretender (১৮৬৩) পযর্ন্ত নাট্যকার ইবসেনের শিক্ষা নবিসিকাল ধরে নেয়া যেতে পারে । তাঁর প্রথম দিকের নাটকের মধ্যে The Pretender অন্যতম যাতে সিম্বলিক ট্রাজেডি প্রকাশ পায় খুব সুন্দরভাবে ।
তবে এ সময়ের মধ্যে প্রকাশিত কোন নাটকই উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করতে পারেনি । যদিও দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগে তিনি পরিপূর্ণ, পরিপক্ক, সফল এবং যুগসৃষ্টা নাট্যকার হিসেবে প্রতিভাত । ইবসেনের দ্বিতীয় ধাপের নাটকগুলো হল Brand, Peer Gynt, Emperor and Galilean । তৃতীয় ধাপের নাটকগুলো হল The League of Youth, Pillars of Society, A Doll’s House, An Enemy of the People, The Wild Duck, Ghost, Hedda Gabler ইত্যাদি । অপরদিকে তাঁর চতুর্থ ভাগের লেখা নাটক তাঁর স্বজনী শক্তির ক্রমস্তিমিত হওয়ার স্বাক্ষর ।চতুর্থ ধাপের নাটকগুলো হল The Master Builder, Little Eyolf, John Gabriel Borkman, When we Dead Awakened ইত্যাদি নাটক ।
নবনাট্য আন্দোলনের দিশারী হেনরিক ইবসেন একথা সত্য; কিন্তু নাট্য ইতিহাসের এই অধ্যায়ে তিনি একক চতিত্র নন । নুট হামসন(The Game of life, 1894), জোনাস লী (The Merry Wives, 1894), আলেকজান্দার কিল্যাগু (The Couples, 1886; The Professor, 1888), গানার হিবার্গ (The Balcony, 1894; The Love’s Tragedy, 1904) এঁরা সকলই বাস্তববাদী নাট্য-আন্দোলনের প্রবক্তা ও কর্মী । এছাড়া আরেকজন উল্লেখযোগ্য ও সাথে সাথে বিতর্কীত চরিত্র হলেন স্ট্রীন্ডবার্গ । দীর্ঘ চল্লিশ বছরে তিনি ষাটটি নাটক, ত্রিশটির অধিক উপন্যাস রচনা করেন ।
তাছাড়া আন্তচরিত্র, রাজনীতি এবং ইতিহাসও তাঁর রচনার অন্তরভুক্ত । তাঁর বিচিত্র ও বিস্তৃত লেখার পরিধিই প্রমান করে যে তিনি একজন শক্তিধর সষ্ট্রা ছিলেন । নারীর প্রতি বৈরীভাব, অপ্রতিরোধ্য মানসিক উত্তেজনা, তীব্র আঘাত ও তীক্ষ্ণ সংলাপপূর্ণ নাটকীয় পরিস্থিতি তাঁর নাটকের মূল উপজীব্য । তাঁর কাযর্ক্রম অনুসরণ করলে দেখা যাবে, ধাপে ধাপে নতুন লক্ষ্য দ্বারা পরিচালিত হয়ে তিনি নব নব নাট্যরীতির প্রবর্তন করতে চেষ্টা করেছেন, যা নাট্য-আন্দোলনকে বেগবান করতে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে ।
স্ট্রীন্ডবার্গ এর পর নবনাট্য আন্দোলনের আরেকজন মহারথী হলেন জেরহার্ত হপ্তমান । হপ্তমান নাটক রচনা করতে গিয়ে জীবনের সবচেয়ে বিক্ষুব্ধ দিক, অপরাধের নির্মম ছবি, আদিম কামনা-বাসনা, বিকৃত এবং সমাজের নিন্মস্তরের মানুষের জীবন-কথা নাটকের উপাদান হিসেবে বাছাই করতে আরম্ভ করেন । কারন, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, দৈনন্দিন জীবনের অতি সাধারণ ঘটনাগুলোই এমন ঘাত-প্রতিঘাত সৃষ্টি করতে সক্ষম যেগুলো থেকে স্বাভাবিকভাবেই নাটক গড়ে ওঠে ।
তাই তিনি নাটকের পাত্র-পাত্রী নিবার্চন করলেন সাধারন মানুষের মধ্য থেকে যারা নিজেদের সাধারণ অবস্থার পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে আসতে চায় বৃহত্তর জীবনের আঙ্গিনায়। মঞ্চকে তিনি টেনে নিয়ে এলেন একেবারে জীবন-হাটের মাঝখানে । ১৮৮৯ সালে হপ্তমানের প্রথম নাটক Before Dawn (সূযর্দয়ের আগে) এক অতি সম্ভাবনার প্রভাতের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আন্তপ্রকাশ করে । ১৮৯০ সালে প্রকাশিত হয় পারিবারিক বির্পযয়কে কেন্দ্র করে হপ্তমানের দ্বিতীয় নাটক ‘Festival of Peace’ । এটিও বিশেষ সুখ্যাতি লাভ করে । হপ্তমান চল্লিশটিরও অধিক নাটক রচনা করেছেন । এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল Drayman Herschel, Rose Bernd, Gabriel Schilling’s Flight, The Weaver, Colleague Crampton, The Beaver Coat ইত্যাদি ।
ভাবসমৃব্ধ নাট্যপর্ব
ইবসেন-স্ট্রীগুবার্গ-হপ্তমান যে প্রগিতিবাদী নাট্যধারার সূচনা করেছিলেন তা ইউরোপীয় ভূখন্ডের প্রায় সবর্ত্রই কম-বেশী মঞ্চকে প্রভাবিত করেছিল । ফরাসী দেশে এ প্রভাব দেখা দেয় একটু ভিন্নরূপে যা Play of Ideas-বলে পরিচিত । এই Play of Ideas এর ক্ষেত্রে প্রধান উল্লেখযোগ্য নাট্যকার পোর্টোরিচ । ‘দি লাক অব ফ্যাস্কয়জ’ (১৮৮৯) ‘এ লাভিং ওয়াইফ’ (১৮৯১) ‘দা ওল্ড ম্যান’(১৯১১) প্রভৃতি তাঁর বিশিষ্ট রচনা । এ ধারার আরেকজন উল্লেখযোগ্য নাট্যকার হলেন মাউরিস ডোনে । তাঁর প্রথম সার্থক নাটক ‘লাভার’ (১৮৯৬) । তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে ‘দি একিং হার্ট’ (১৮৯৭), ‘দি ইমানসিপেটেড ইয়াম্যান’ (১৮৯৮), ‘দি আদার ডঞ্জার’ (১৯০২) নাটকগুলোতে তিনি মানব-হৃদয়য়ের কামনা-বাসনা, আবেগ-উচ্ছাসের অত্যন্ত সংবেদনশীল, শালীন ও উদারমনা প্রতিবেদক । Play of Ideas এর নাটয়কার এ সময় আরও বেশ কয়েকজন ছিলেন ফ্রান্সে ।
তবে এঁদের মধ্যে বিশেষ আলোচনার দাবীদার হলেন ক্রাস্কোসিস দ্যা কুরেল । তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে‘দি ফসিলস’ (১৮৯২), ‘লাভ এমব্রায়ডার্স’ (১৮৯৩), ‘দি লায়ন্স ফিস্ট’ (১৯৯৮), ‘দি নিউ আইডল’ (১৮৯৯), ‘দি স্যাভল গার্ল’, ‘দ্যা বিষ্ট’ (১৮৯৬), ‘দি ফ্যামিলী লুনাটিক’ (১৮৯৩), ‘মারিউচ’ (১৯০৩), ‘দি গ্রান্ড ফাদার’ (১৯০৪) অন্যতম । ক্রাস্কোসিস দ্যা কুরেলের নাট্যকর্মের কলাকৌশলগত জ্ঞানের অপ্রতুলতা থাকলেও লেখক হিসেবে তাঁর নিষ্টা অনসীর্কায । ভাবসমৃব্ধ নাটকের এই পবের শেষের দিকে বাস্তব্বাদী নাট্য আন্দোলন এক অজ্ঞাত কারনে মুখ থুবরে পরে এবং শুরু হয় নতুন আরেকটি পর্ব ।
নিউ-রোমান্টিসিজম পর্ব
নাট্যকলার ক্রমবিকাশের এই ক্ষনে বাস্তব্বাদী নাট্য আন্দোলনের মূল পবের সমাপ্তি ঘটে এবং নতুন আরেকটি নাট্যরীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যা নাট্য-ইতিহাসে নিও-রোমান্টিসিজম বলে পরিচিত । ১৮৭৬ সালে মার্লামের ‘Lapres-mindi due faune’ নামক নাটকের মাধ্যমে নিও-রোমান্টিসিজমের সূচনা ঘটে । নাটককের সূচনা নিয়ে মতভেদ থাকলেও এই নাটকের মধ্য দিয়েই যে প্রতীকধর্মী কাব্যনাট্যের যাত্রা শুরু হয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই । ১৮৮৬ সালে নিও-রোমান্টিসিজম এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ফিগারোতে প্রকাশিত হয় বেশ ফলাও করে । তখন মূল ঘোষনাপত্রে বলা হয়েছিলঃ প্রতীকধর্মী কবিতা কাব্যচিন্তাকে একটি সংবেদনশীল ফর্মের আচ্ছাদনে পরিবৃত্ত করতে চায় । তবে, সেটাই মূল লক্ষ নয় ।
এই মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে বাহ্যিক বাস্তবতাকে পাশ কটিয়ে অন্তরমূলের সত্যকে প্রভাসিত করবার চেষ্টায় ব্রতী হন নিও-রোমান্টিসিজমের নাট্যকারগন । এই নাট্যরীতির প্রবক্তাদের যুক্তি হলো, সংলাপ জীবনের বাস্তব রূপ ফোটাবার জন্যে, অনুভূতির প্রতিফলন ও দর্শকের মধ্যে সেটার সঞ্চারই সংলাপের আসল লক্ষ্য । তবে সেটা বাস্তব্বাদীদের মতো বহির্মুখীন নয়- সংবেদনশীল এবং অন্তর্মুখীন হওয়ার জন্যে সবর্তোমভাবে । হৃদয়ের গভীরের আবেগ-অনুভূতির চিত্রকল্পের জন্যে গান বা কবিতার দ্বারস্থ হওয়া ইদানিং কালের প্রবনতা নয়; মানবসভ্যতার মতোই পুরোনো এই প্রবনতা এবং ভাষার জন্মলগ্নের সঙ্গে সম্পৃক্ত ।
আদিম মানুষের রহস্য-চেতনায় কাব্যের প্রথম উন্মেষ । সেজন্যই বোধ হয় আবেগ-অনুভূতি যেখানে প্রবল সেখানে ছন্দবব্ধ কাব্যকথা সকলের আগে প্রবেশপথ খুঁজে নেয় । নাটকে সংলাপের দুটি মাত্র উদ্দেশ্য থাকে – প্রথমত, নাটকটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং দ্বিতীয়ত, দর্শকচিত্তে অসসঞ্চার ও বক্তব্য কম্যুনিকেট করা । অভিনেতা ও দর্শকে মধ্যে এই যে অনুভূতি ও বক্তব্যের আদান-প্রদান সেটা গদ্য-নাটকের তুলনায় ছন্দবব্ধ কাব্য-নাটকের পক্ষে অনেক বেশী সহজ । কাব্যনাটকের প্রবক্তাদের দাবী হলো, পদ্যে লেখা সংলাপের কম্যুনিকেটিং ক্ষমতা অনেকাংশে বেশী ।
কারন, লিরিক্তার আর্ন্তবাহী সত্য হচ্ছে গতিময় আবেগময়তা । ধ্রুপদী যথার্থে এই গতিময়তা যে সংঘাতের সম্মুখীন হয়, তাতেই নাট্যরস জমে ওঠে । কিন্তু কালের প্ররিক্রমায় বিংশ শতকের প্রথম দিকে নাটকে ভিন্নতর স্বাদের আমেজ পরিবেশন করা নিও-রোমান্টিসিজম আবার পর্দার আড়ালে চলে যায় । অন্যদিকে সাময়িক প্রতিকূলতা কাটিয়ে বাস্তববাদী নাট্যধারা আবার নবতর প্রাণচাঞ্চল্যে জেগে ওঠে এবং এই দশক থেকেই নাট্য-ইতিহাসের আর একটি আধ্যায়ের সূচনা ঘটে।
আধুনিক পর্ব
ঊনবিংশ শতকের শেষ দশকে নতুন চিন্তার আভাস নিয়ে কিছু কিছু নাটক মঞ্চস্থ হয় যেখানে একটু একটু করে আধুনিক নাটকের পদধ্বনি শোনা যেতে আরম্ভ করে । এই প্রতিধ্বনি তুলে যাঁরা আগমন করেছিলেন তাঁদের অগ্রপথিক হলেন বিশ্বখ্যাত মনীষী জর্জ বার্নার্ড শ’ । ১৮৯২ সালে তিনি নাট্যকার হিসেবে আন্তপ্রকাশ করেন । বার্নার্ড শ’ এর নাটকে মূল লক্ষ্য হল Creative Evolution বা সৃষ্টিমূলক বিবর্তন । এই লক্ষ্য সমনে রেখেই ১৯০১ সালে রূপকথার গল্প ‘ডন জুয়ান’ অবলম্বনে নাটক রচনা আরম্ভ করেন এবং এর বিশ বছর পর আবার ঐ একই উদ্দেশ্যে ‘গাডেন অব ইডেন’ অবলম্বনে অবিস্মরনীয় নাটক ‘Back to Methuselah’ রচনা করেন ।
‘Would Drama’ গ্রন্থে এলারডাইস নিকল এক জায়গায় বার্নার্ড শ’ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন- “এই যুগটা খুব সম্ভব, নাট্য-ইতিহাসের শুধু একজনের যুগ- তিনি জর্জ বার্নার্ড শ ।” নাটকের মধ্যে উদ্দেশমূলক হাসির প্রবকর্তাও ছিলেন এই বার্নার্ড শ’ । মাইকেল মধুসুদন দত্ত, লুডউইগ থমার, এডঅয়ার্ড কার্লুইস , গিলবার্ট এবং সুলিভান এরা সবাই হাস্যরসসমৃব্ধ ও ব্যাঙ্গান্তক নাটক রচনা করেন । কিন্তু শ’ এর সঙ্গে কারুরই তুলনা চলে না । কারণ, মুখ্যত সমস্যাপ্রধান সিরিয়াস নাটকে অমন উদ্দেশ্যপূর্ণ দম-ফাটানো হাসির ফোয়ারা তিনি ছাড়া আর কেউ সৃষ্টি করতে পারেন নি ।
এজন্যে যে প্রজ্ঞা, যে বিদ্যাবুব্ধি, যে সমাজ সচেতনতা, যে বিপ্লবী মনোভাব ও রসজ্ঞানের প্রয়োজন তা একমাত্র বার্নার্ড শ’ এরই ছিল । অনেকের মতে, বার্নার্ড শ’ মূলত তাঁর বিশেষ সামাজিক মতবাদ প্রচার করার জন্যে নাট্য-মাধ্যম বেছে নিয়েছিলেন । তিনি যতোখানি নাট্যকার তার চেয়ে অনেকাংশে বেশী মতবাদ প্রচারক ছিলেন । তিনি একটির পর একটি নাটক লিখে সামাজিক দোষ-ত্রুটির প্রতি শুধু অঙ্গুলিনিদের্শ করেই ক্ষান্ত হননি বরং প্রতিকারের নিদের্শও দিয়েছেন । বার্নার্ড শ’ এর পরও কালের বিবর্তনের সাথে সাথে সময়ের প্রয়োজনে আধুনিক নাট্যধারার এই ক্রমবিকাশ চলতে থাকে সমান তালে ।
বিবর্তনের এই ধারায় দুটি বিশ্বযুব্ধের মধ্যবর্তী সময়ের নাট্য তৎপরতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । এই সময়ের মধ্যে আধুনিক নাট্য-আন্দোলনের বলিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তপ্রকাশ ঘটে । এই সময় পাশ্চাত্যের আধুনিক নাট্যধারার প্রভাব পড়তে আরম্ভ করে প্রাচ্যের মঞ্চের ওপর । দুটি নাট্যধারা এ সময় কাজ করছিল । একটি হল ইবসেনীয় প্রথার সামাজিক সমস্যাকে মুখ্য করে নাটক রচনা আরেকটি হলো মানব-হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করে ব্যাক্তিচরিত্র অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে রূপান্তর করা ।
এই সময় রাশিয়ার অভ্যুদয় ঘটে এবং সামাজিক দায়দায়িত্ব সম্বন্ধে অন্য সব শিল্প-মাধ্যমের মতো নাটকও পূর্ণ সচিতন হয়ে ওঠে । ফলে সমাজতান্তিক রাশিয়ায়র নাটক ও চলচ্চিত্র কিছুটা প্রচারধর্মী রূপ নিতে বাধ্য হয় । প্রথম বিশ্বযুব্ধের সময় মার্কিন মুলুকে নাট্য-তৎপরতা শুরু হয় । হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জর্জ পি বেকার কিছু উৎসাহী লেখকদের নিয়ে নাট্য-আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন । এদিকে থেরেস হেলবার্ন, রবার্ট এডমন্ড জোন্স, লরেন্স লাঞ্জনার, ফিলিপ ময়েলার ও লী সিম্পসন প্রমুখের আপ্রান প্রচেষ্টার প্রথম সাফল্য হিসেবে ওয়াশিংটনে স্কোয়ার প্লেয়ার্স নামক প্রতিষ্ঠানের জন্ম ১৯১৫ সালে ।
এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য ছিলেন স্বনামখ্যাত নাট্যকার ইউজেন ও নীল । এই সময় আর্থার হপকিনস ‘Theater Art Monthly’ প্রতিষ্টা করেন । এদিকে ইউজেন ও নীল কয়েকটি একস্কিকার সস্কালন বের করেন এবং ১৯১৪ সালে এবং ১৯২০ সালে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান Emperor Jones প্রকাশিত হয় । এই বছরই ইউজেন ও নীলের নেতৃতে একদল তরুণ নাট্যকারের আবির্ভাব ঘটে যাঁরা নিউইয়র্কের রঙ্গমঞ্চে রীতিমতো ঝড় সৃষ্টি করেন ।
১৯২৩ থেকে মাত্র তিন বছরের মধ্যে ইউজেন ও নীলের All God’s children got wings, Desire under Elms, The Fountain, এলমার রাইসের The Adding Machine, ফিলিপ বেবীর The Youngest, Ina Garden, ম্যাক্সওয়েল এন্ডারসনের What Price Glory, The Buccaneer, পল গ্রীনের Scuffle town outlaws, The No Count Boy এই রকম একের পর এক নাটক হুমড়ি খেয়ে পড়ে । এ যেন বোতলে আবব্ধ দৈত্যের মতো আমেরিকান সুপ্ত নাট্য-প্রতিভা হঠাৎ মুক্ত হয়ে প্রবল জোয়াড়ের মত বেরিয়ে আসে ।
বাংলা যাত্রাভিনয়
এদেশে যাত্রার সূচনা দেবপূজা উপলক্ষে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গার উদ্দেশ্যে যাত্রা বা গমনকে কেন্দ্র করে । এই যাত্রা অর্থাৎ যাওয়ার সময় নৃত্য-গীতের প্রয়োজন হত । নৃত্যগীত সম্বলিত এই যে যাওয়া অর্থাৎ যাত্রা সেটাকে তখন বলা হতো নাটগীত বা গীতনাট । দেবপূজা সংক্রান্ত উপরোক্ত যাত্রার মুহূর্ত থেকেই সমস্ত চলার পথে এ নৃত্য-গীত চলতো এবং গন্তব্যস্থলে পৌচ্ছুবার পরও নৃত্যগীত ও অভিনয় জাতীয় কিছু অঙ্গভঙ্গির সাহায্যে দেবলীলার মহিমাকীর্তন করা হতো সমবেত উৎসুক জনতার সামনে । আমাদের লোকনাট্য যাত্রাভিনয়ের আদি-পর্ব এটাই ।
আবার আমরা দেখতে পাই প্রাচীন গ্রীসে নানা ধর্ম-কর্ম, সামাজিক ক্রিয়া-অনুষ্ঠান ইত্যাদির মধ্যে নৃত্যের ছিল এক বিশেষ ভূমিকা । কালক্রমে এই নৃত্যের সঙ্গে সংযোজিত হলো গান এবং পরবর্তী সময়ে ঠাঁই করে নিলো আবৃত্তির ফর্মে কথা বলা । অবশেষে যখন এই নৃত্য, গীত ও কথা একত্র হয়ে একটি গল্প বলতে চাইলো দশর্ক-শ্রোতার কাছে তখন সেটাই হয়ে গেল লোকনাট্য । সমাজ-বিবর্তনের প্ররিক্রমায় এক সময় নগর-রাজ্য এবং নগর-সভ্যতা গড়ে ওঠে । তারপর এই নগর সভ্যতার দাবি মেটাতে গিয়ে লোকনাট্য এক সময় নগরের প্রেক্ষাগৃহের অভ্যন্তরে তিনদিকে ঘেরা মঞ্চের ওপর আটকা পড়ে গেল এবং সেটার নতুন নাম হল ‘নাটক’ ।
কিন্তু তাই বলে ইউরোপ থেকে আমাদের দেশে মঞ্চাভিনয়ের উদ্ভব ঘটেছে এমন কথা বলা যাবে না । কারন খ্রীস্টের জন্মের আগেও ভারতীয় উপমহাদেশে মঞ্চাভিনয়ের প্রচলন ছিল এমন প্রমাণ নাট্যশাত্রে পাওয়া যায় । এই প্রসঙ্গে ড. অজিত কুমার ঘোষ ‘বাংলা ভাষার অবিধান গ্রন্থে বলেছেন ‘প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত মঞ্চাভিনয় বোধ হয় সবর্প্রথম পূর্ণ পরিণতরূপে দেখা গিয়েছিল ভারতে ।’
তাছাড়া নাট্যশাত্রের পুঙ্খনিপুঙ্খ বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, দু হাজার বছর আগে পুর্ণবিকশিত শিল্পরসোত্তীর্ণ নাটোকের যেমন জন্ম হয়েছিল তেমনি অতি সুক্ষ আঙ্গিকবহুল প্রয়োগকলা-নৈপুণ্যেরও প্রবর্তন হয়েছিল । ইউরোপে প্রেক্ষাগৃহে নাট্যভিনয়ের সূচনা হয়েছিল অনেক পরে- খ্রীষ্টীয় সপ্তাদশ শতকের গোড়া থেকে । এদিকে প্রাচীন ভারতে যখন মঞ্চাভিনয়ের প্রচলন ছিল তখনও লোকনাট্য একটি নতুন ধারা হিসেবে প্রচলিত ছিল । ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় প্রাচীনকালে মঞ্চনাটক কেবল বিদব্ধমন্ডলী ও রাজরাজড়াদের মধ্যে সীমাবব্ধ ছিল ।
তা ছাড়া সংস্কৃত ভাষায় রচিত সেসব অতি উচুঁপযায়ের নাটকের কোন আবেদনই ছিলনা গনমানুষের কাছে । অপরদিকে লোকনাট্য বেঁচে রয় গনমানুষের অন্তরে । কিন্তু যুগে যুগে লোকনাট্যের সাঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পী কলাকুশলীদের জীবিকার প্রশ্নটা বহুকাল থেকেই সম্পৃক্ত । অতএব, ব্যবসায়ের খাতিয়ে দর্শকের মনোরঞ্জনের কথাটা যাত্রার অধিকারীদের মনে রাখতে হয়েছে সকল সময় । আর তা করতে গিয়ে এক সময়ের যাত্রার মান যায় নেমে । এই নিয়ে চারদিকে সমালোচনার ঝড় ওঠে । আর সমালোচনার হাত রক্ষা পেতে এবং যাত্রাশিল্পকে বাঁচানোর লক্ষ্যে যাত্রাদলের অধিকারীগন এর উন্নয়ন প্রচেষ্টায় মনোনিবেশ করেন । ফলে উনিশ শতকের প্রথম দিকে নতুন যাত্রার প্রচলন হয় ।
তারপর থেকে যাত্রা অনেক পথ অতিক্রম করেছে এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই যাত্রার মধ্যে আরো অনেক পরিবর্তন এসেছে । যাত্রা যতদিন গ্রামাঞ্চলে থিয়েটারের পাশাপাশি চলেছে ততোদিন পযর্ন্ত যাত্রা তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে । কিন্তু যখন থেকে যাত্রার অধিকারীদের নজর পড়লো শহরের নাট্যমঞ্চের প্রতি তখন থেকে যাত্রার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হতে আরম্ভ করে এবং যাত্রা তার মূল-ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয় ।
কারন তিনদিকে ঘেরা মঞ্চের সম্মুখভাগে দাঁড়িয়ে অভিনয় করার ফলে দর্শকদের সঙ্গে অভিনেতা এবং দশর্কের মধ্যে যে নিবিড় যোগাযোগ তা ব্যাহত হতে থাকে । যদিও আধুনিক কালে যাত্রা খোলা মঞ্চেই হয় । তবু নানা করনে যাত্রা তার মৌলিকতা হারিয়েছে । বর্তমানে যাত্রা প্রযোজকরা আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধাই গ্রহন করছেন তাদের নাটকে । ফলে যাত্রা এখন আর গ্রামের অবহেলিত শিল্প নয় । কালক্রমে শহর-গ্রাম সবর্ত্রই ছড়িয়ে পরেছে আমাদের ঐতিহ্যমন্ডিত এই যাত্রা ।
বাংলা নাট্যমঞ্চ ও শেক্সপীয়র
জীবন-মৃত্যুর যুগল রূপ নিয়ে আন্তপ্রকাশ করেছিলেন উইলিয়াম শেক্সপীয়র । ১৬১৬ সালের ২৩শে নবেম্বর তাঁর বায়ান্নতম জন্মদিনে তিনি পরলোকগমন করেন । কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সাড়ে তিনশত বছর পরও তিনি রয়ে গেলেন বাঙ্গালী গনমানুষের মানসপটে এক কালজয়ী স্রষ্টারূপে । বাংলা নাট্যমঞ্চে শেক্সপীয়রীয় নাটকের আবির্ভাব ঘটে ১৭৫৫ সালে কলকাতায় এলিজাবেথীয় ঢং-এ নাট্যশালা ‘দি প্লে হাউস’ স্থাপনের মাধ্যমে ।
তখন যবনিকা ব্যবহৃত হতো এবং মঞ্চের দু’পাশে শিল্পীদের আগমন নির্গমনের জন্যে উইংস ব্যবহার হত । কিন্তু তখন দৃশ্যপট অঙ্কন বা দৃশ্য-পরিবর্তনের সাথে সাথে মঞ্চ-সজ্জা পরিবর্তনের কোন ব্যবস্থা ছিল না । একই পরিবেশ ও অপরিবর্তনীয় দৃশ্যসজ্জার মধ্যেই গোটা নাটক অভিনীত হত ।
এই প্রতিবন্ধকতার পরও ‘ইনডোর স্টেজ শো’ বা ‘কাভার্ড স্টেজ শো’ এর সূচনা হয় এদেশে ‘দি প্লে হাউস’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই । এটিই শেক্সপীয়রীয় আদর্শে প্রতিষ্ঠিত বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের আধুনিক নাট্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠার প্রথম পথপ্রদর্শক । এই নাট্যমঞ্চ বছর চারেক টিকে ছিল । এরপর ১৭৭৫ সালে দ্বিতীয় নাট্যমঞ্চ ‘দি ক্যালকাটা থিয়েটার’ এবং এর কিছুদিন পর ‘দি নিউ প্লে হাউস’ ও ‘হোয়েলার প্লেস থিয়েটার’ স্থাপিত হয় । এই নাট্যশালাগুলোতে ‘হ্যামলেট’, ‘দি মার্চেন্ট অব ভেনিস’, ‘তৃতীয় রিচার্ড’, ‘চতুর্থ হেনরী’ প্রভৃতি নাটকগুলো অভিনীত হত রীতিমত ।
সে আমলের প্রখ্যাত অভিনেত্রী মিস ব্রিস্টো ১৭৮৯ সালে আরও একটি নাট্যমঞ্চ পত্তন করেছিলেন । তবে এই সকল নাট্যশালার তৎপরতার সঙ্গে বাঙালীর প্রত্যক্ষ যোগাযোগের কোন প্রমান না থাকলেও বাংলাদেশের মাটিতে শেক্সপীয়রীয় নাটকের আদি-পর্ব বলে চিহ্নিত করা হয় এই সময়টাকে । অবশেষে শিক্ষিত বাঙালীর মনোজগতে শেক্সপীয়রীয় চেতনার অনুপ্রবেশ ঘটে উনবিংশ শতকের প্রথম দশকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ।
উক্ত কলেজের এক বিদেশী ছাত্র মি. মংকটন ‘দি টেম্পেস্ট’ নাটকের বঙ্গানুবাদ করেন ১৮০৯ সালে । শেক্সপীয়রীর নাটকের বাংলাভাষায় রূপান্তর এই প্রথম । এর পর ১৮১৩ সালে স্থাপিত হয় ‘চৌরাঙ্গি থিয়েটার’ । এই সময় থেকেই বাঙ্গালী-মানসে শেক্সপীয়রীয় ভাবধারা সংক্রমিত হতে আরম্ভ করে ।
এই সংক্রমন আরও জোরদার হয় ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে । ১৮৩০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী টাউন হলে অনুষ্ঠির পুরষ্কার বিতরণী সভায় হরিহর মুখোপাধ্যায় এবং আর কিছু ছাত্র শেক্সপীয়রের বিভিন্ন লেখা থেকে আবৃত্তি করেছিলেন । পরের বছর ১৯ ফেব্রুয়ারী সেই টাউন হলেই ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ এর প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্য অভিনীত হয় এবং তাতে অংশগ্রহন করেন কৈলাশচন্দ্র দত্ত, রামগোপাল ঘোষ, তারকনাথ ঘোষ, ভুবনমোহন মিত্র, তারিনীচরণ মুখোপাধ্যায় অ হরিহর মুখোপাধ্যায় । শেক্সপীয়রীয় নাটকে বাঙালীর অংশগ্রহন এটাই প্রথম ।
১৮৩১ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রসন্নকুমার ঠাকুরের নারকেলডাঙ্গার বাগানবাড়ীতে ‘জুলিয়াস সিজার’ এর পঞ্চম অঙ্ক অভিনীত হয় । তারপর ১৮৩৪ সালের ৭ মার্চ তারিখে হিন্দু কলেজের পুরষ্কার বিতরণী উৎসবে মধুসূদন দত্ত শেক্সপীয়রীয় পাঠ অভিনয়ে অংশ নিয়েছিল । ঐ অনুষ্ঠানে ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষাল ষষ্ঠ হেনরীর ভূমিকায় এবং মধুসূদন ডিউক অব গ্রসেস্টার এর ভূমিকায় অংশগ্রহন করেন ।
এর কিছুদিন পর ১৮৩৯ সালে জন্ম হয় ‘সাঁশুলী থিয়েটার’এর । এই সময়ে এই থিয়েটারের সাফল্য সমাধিক উল্লেখযোগ্য । ‘হ্যামলেট’, ‘ওথেলো’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘রোমিও এন্ড জুলিয়েট’, ‘জুলিয়াস সিজার’, ‘দি টেমিং অব দি শ্রু’ নাটকের অভিনয় ও মঞ্চসজ্জার দক্ষতা ‘সাঁওলী থিয়েটার’ কে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয় ।
এই খ্যাতির টান এত প্রবল ছিল যে, লন্ডনের বিখ্যাত অভিনেত্রী মিসেস ডীকন ও মিস ১৮৪১ কাউলে সাঁশুলী থিয়েটারে যোগদান করে । একই বছর অস্ট্রেলিয়ার জনপ্রিয় অভিনেত্রী মারিয়া মাদেলিন টেলর সিডনী থেকে পালিয়ে আসেন এই থিয়েটারে যোগ দেয়ার জন্য । এর দু’বছর পর লন্ডনের বিখ্যাত ভানিং পরিবারের জেমস ভানিং সাঁশুলী থিয়েটারে যোগ দেন । এই থিয়েটারের সাফল্য দিনে দিনে বেড়ে চলে । কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের ঐতিহাসিক সাফল্য আসে ১৮৪৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর শেক্সপীয়রের বিখ্যাত নাটক ‘ওথেলো’মঞ্চায়নের মধ্যে দিয়ে ।
এরপর ১৮৫২ সালে জোড়াসাঁকোর প্যারীমোহন বসুর বাড়ীতে ‘জুলিয়াস সিজার’ অভিনিত হয় । কলকাতা বাঙ্গালী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রতাপ খুব দ্রুত কমে যেতে থাকে এবং বাঙ্গালীদের শেক্সপীয়রের ধারা চলতে থাকে । এরপর উনবিংশ শতকের শেষ দিকে ইবসেনের বস্তববাদী নাট্য-আন্দোলনকে স্বাগত জানাবার জন্যে শেক্সপীয়রীয় নাট্য ধারাকে পেছনে ফেলে বাংলার মঞ্চকে এগিয়ে যেতে হয়েছে ক্রমবিবর্তনের ধারা অনুসরন করে ।
আধুনিক বাংলা নাটক
আধুনিক বাংলা নাটকের শুভারম্ভের ইতিহাস বেশ চমকপ্রদ একাধিক কারনে । প্রথমত শুভারম্ভ যার হাত দিয়ে হয় তিনি বাঙ্গালী নন, একজন বিদেশী – নাম হেরাসিন লেবেডেফ । জাতিতে রাশিয়ান । অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে পৃথিবীর অনেক দেশ পরিভ্রমন করে অবশেষে কলকাতায় এসে ব্যবসায়ভিত্তিক নাট্যশালা স্থাপনের সিব্ধান্ত নেন এবং ১৭৯৫ সালে ২৫ নং তৎকালীন ডোমতলীতে (বর্তমানে এজরা স্ট্রীট) বেঙ্গলী থিয়েটার নামে একটি নাট্যশালা স্থাপন করেন লেবেডেফ । পশ্চিমা রীতিতে সজ্জিত তাঁর এই নাট্যশালায় তিনি বাংলা ভাষায় লেখা নাটক বাংলা ভাষাভাষী অভিনেত্রা-অভিনেত্রীদের দিয়েই করানোর সিব্ধান্ত নেন । কিন্তু সেই সময় একেতো বাংলা নাটক ছিল না তার উপর মেয়েদের দিয়ে নাটক মঞ্চথ করাবার কথা কেউ চিন্তা করতে পারতো না ।
রুশ হেরাসিম লেবেডেফ তা সম্ভব করেছিলেন । অবশ্য তার আগেও মঞ্চাভিনয় হয়েছিল তবে সেটা সাহেব পাড়াতে । সেই নাটক দেখবার সুযোগ সাধারন বাঙালীর ভাঙ্গে জোটেনি । কিন্তু বাঙালীর এই মর্মবেদনাও ঘুচতে শুরু করলো সাত সমুদ্র তের নদী পার করে আসা হেরাসিম লেবেডেফ এর ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ এর দারোদঘাটনের মাধ্যমে । কিন্তু এতো করেও লেবেডেফ তাঁর এই ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ বাঁচিয়ে রাখতে পারেননি । কারন সাহেব-সুবোদের নাট্যশালার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নেটিভদের প্রয়োজনে আলাদা নাট্যশালা গড়ে উঠবে এটা কিছু কিছু ইংরেজ চাননি বিশষ করে যারা নাট্যশালার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ।
অবশেষে এদের সক্রিয় বিরোধীতার মোকাবিলা করতে না পেরেই লেবেডেফ ক্ষুব্ধচিত্তে ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ এর ইতি টেনে কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে বাব্ধ হন । বাঙ্গলী থিয়েটারের অকাল মৃত্যুর পর প্রায় তিন যুগেরও বেশী সময় বাংলা নাট্যমঞ্চ গড়ে উঠেনি । এর পরের যুগটাই ‘বাবু কালচার’ নামে পরিচিত । এই সময় বাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুর ১৮৩১ সালে বেলেঘাটার অন্তর্গত শুঁড়োর বাগানবাড়ীতে হিন্দু থিয়েটারের গোড়াপত্তন করেন । হিন্দু থিয়েটারের প্রথম নাটকের ভাষা ছিল ইংরেজী যদিও বিষয়বস্তু ছিল ভারতীয় উত্তর রামচরিত । কিন্তু এই নাট্যমঞ্চও দু’বছরের বেশী টিকে থাকেনি ।
কারন সেই সময় গোটা কলকাতায় ইংরেজী জানা লোকের সংখ্যা ছিল খুবই কম । এর ঠিক পরপরই ১৮৩৩ সালে আবির্ভূত হন নবীনচন্দ্র বসু তাঁর নিজ বাড়ীতে নাট্যশালা স্থাপনের মাধ্যমে । ১৮৩৫ সালের ৬ অক্টোবর এই নাট্যশালায় ‘বিদ্যাসুন্দর’ অভিনীত হয় অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে । এই নাটকের পাত্র-পাত্রী সবাই ছিলেন বাঙ্গালী ।
অর্কেস্ট্রায় ব্যবহৃত হয়েছিল দেশী বাদ্যযন্ত্র । কয়েক বছর নাট্য-প্রযোজনা করে নবীনচন্দ্র বসু লাখ লাখ টাকা গচ্চা দিয়েছিলেন । ফলে এই নাট্যশালাও বেশী দিন টিকে থাকেনি । এভাবে ১৭৯৫ থেকে উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ প্রযর্ন্ত প্রচুর সখের নাট্যভিনয় হত । পেশাদারী নাট্যমঞ্চ তখন গড়ে উঠেনি । অবশেষে বাংলা নাট্যমঞ্চের অন্যতম নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র ১৮৬০ ‘জমিদার দর্পন’ নাটকের মাধ্যমে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেন ।
এই নাটকের মহরার সময় নাট্য-প্রতিষ্ঠানের নাম দেয়া হয় ‘The Calcutta National Theater’ পরে মতিবাবুর প্রস্তাব অনুযায়ী ‘Calcutta’ টুকু বাদ দেওয়া হয় । ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৭২ সালে এবং এই বছরই এটি প্রথম মঞ্চথ হয় । আর এরই সঙ্গে বাংলা নাটকের বন্ধ্যাদশারও অবসান হয় । এই নাটকের সাফল্য শাসকগোষ্ঠীর টনক নাড়িয়ে দেয় । কারন, ‘নীলদর্পন’তৎকালীন বিদেশী নীলকরদের জুলুম ও লুন্ঠন এবং বাংলার নীলচাষীদের নির্মম-নিষ্ঠুর বঞ্চনা অ লাঞ্ছনার দর্পনই নয় বরং সর্বকালের সর্বযুগের শোষন আর শোষিতের দর্পন । এই সময় বাবু থিয়েটারের অবসান ঘটে ।
এই সময় সৌখিন নাট্যমঞ্চগুলোর অবসান ঘটতে থাকে এবং পেশাদারী থিয়েটার গড়ে ওঠে । ন্যাশনাল থিয়েটারের সঙ্গে গোড়া থেকেই যাঁরা সম্পৃক্ত ছিলেন তাঁরা হলেন পরবর্তীকালের বাংলা নাট্যমঞ্চের দিকপাল – গিরিশচন্দ্র ঘোষ, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফী, রামমাধব কর, নন্দলাল ঘোষ, বেলবাবু, অমৃতলাল বসু, মতিলাল সুর, তিনকড়ি মুখোপাধ্যায় প্রমুক । তাঁদের মধ্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষকে আধুনিক বাংলা নাটকের জনক বলা হয় । নাট্যজগতে তাঁর আগমন অভিনেতা হিসেবে । তারপর কখনো বা নাট্যশিক্ষক, কখনো নাট্যশালার ম্যানেজার, আবার কখনো নাট্য পরিচালক ।
সব শেষে তিনি নাট্যকার । তাঁর প্রথম জীবনের নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘রাবণ বধ’, ‘সীতার বনবাস’, ‘পান্ডবের অজ্ঞাতবাস’ এবং আর কিছু পৌরানিক নাটক শুধু ব্যবসাহিক সাফল্য নয়, যথেষ্ট গৌরবও বয়ে আনে । মূলত এই সময় থেকেই শুরু হয় গিরিশ যুগ তথা বাংলা নাটকের স্বর্ণযুগ ।প্রায় আশিটি নাটক রচনা, অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা এবং পরিচালনায় মুনশিয়ানার জন্যে তিনি নাট্যসম্রাট হওয়ার গৌরব অর্জন করেন ।
গিরিশচন্দ্রের পরই যাঁদের নাম শ্রব্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয় তাঁদের মধ্যে ক্ষীরদপ্রসাদ বিদ্যাবিনদ ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সবিশেষ উল্লেখযোগ্য । বাংলা নাটকের আরেকজন প্রানপুরুষ হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । তিনি একাধারে ছিলেন নাট্যকার, প্রযোজক, পরিচালক, সুরকার এবং অভিনেতা । তাঁর নাটকগুলো বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ সম্পদ ।
বাংলা নাটকের ইতিহাস বাংলা সাহিত্যের অগ্রগতি, রাজনৈতিক বিবর্তন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক উথান-পতনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত । রপথম বিশ্বযুব্ধের পর থেকেই ইউরোপীয় আধুনিক নাট্যধারার ঢেউ একটু একটু করে ভারতীয় মঞ্চে এসে লাগতে আরম্ভ করে । ফলে নাটকের পটভূমি রাতারাতি পাল্টে গেল ।
পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক এবং সাদামাটা ঘরকন্নার পটভূমি সরিয়ে দিয়ে সেখানে প্রবেশ করলো কলকারখানা, রাজনৈতিক সমাবেশ, উত্তেজিত শ্রমিক গোষ্ঠী, মাঠ-ময়দান এবং সামাজিক আস্তানা । নায়ক-নায়িকার প্রাধান্য ক্ষুন্ন করে জনগন এসে দাঁড়ালো- তথাকথিত নাটক হয়ে গেল গণ-নাট্য । এই পর্বে সবার্গ্রে স্মরণীয় ব্যাক্তি বিজন ভট্রাচায এবং সবর্শ্রেষ্ঠ অভিনেতা শম্ভু মিত্র ।
চল্লিশ থেকে আশি এই চল্লিশ বছরের মধ্যে ভারতীয় মঞ্চ বিশেষ করে বাংলা তথা কলকাতার মঞ্চে ব্যাপক আবর্তন-বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে । এসেছে মুক্তাঙ্গন অভিনয়, এসেছে থিয়েটার ইন সার্কেল, এসেছে মুক্তমঞ্চে End Stage ও Thrust Stage । কলকাতার নাট্য-প্রযোজকরা এখন Theater কে করে দিয়েছে Total Theater- দর্শক ও নাট্য-শিল্পীদের মধ্যে আর সামান্যতম ব্যবধান রাখতেও তাঁরা রাজী নন । নাটক এখন সত্যিকার অর্থে গণ-নাট্য।
খ্রীস্টপুব ১৫০০ থেকে ২০০ শতক অবধি এই দীর্ঘ সময় ইতিহাসের পাতায় অত্যন্ত ঐশযমন্ডিত বৈদিক সভ্যতার যুগ বলে চিহ্নিত । ভারতীয় নাট্যমঞ্চের আদি ইতিহাস আলোচনা করলে জানা যায় যে, শিব বা মহাদেবই হলেন সে দেশের নাট্যকলার জন্মদাতা । বিশ্বের স্রষ্টা ব্রম্ব্রা নাট্যকলা শেখেন মহাদেবের কাছ থেকে এবং তারপর তিনি গন্ধববেদ বা নাট্যবেদ রচনা করেন ।
এটিই বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন নাট্যশাস্ত্র । দেবতারা যখন অসুরদের সঙ্গে যুব্ধে জয়লাভ করলেন তখন ব্রম্রা দেবরাজ ইন্দ্রের সন্ত্রষ্টি বিধানের জন্য প্রথম ভারতীয় হিন্দু নাটক ‘সমুদ্র মন্থর’ রচনা করেন । ভারতবর্ষে প্রাক-বিভক্ত সমাজের অবসান ঘটিয়ে যখন দাস সমাজ পক্ষ বিস্তার করেছিল তখনই এই নাটকের সূত্রপাত । আবার আমরা দেখতে পাই, মহাদেবের সঙ্গে পাবর্তীর বিবাহ উপলক্ষে দ্বিতীয় হিন্দু নাটক ‘ত্রিপুরাধা’ যখন মঞ্চস্থ হয় তখন মহাদেব নিজেও সেই নাটকের একজন দর্শক ছিলেন ।
কিন্তু নাটকটিতে কোন নৃত্য সংযোজিত হয়নি বলে তিনি সন্তষ্ট হতে পারেননি এবং তাঁর আদেশে তাঁরই শিষ্য তান্ডু সেই নাটকে একটি নৃত্য পরিবেশন করেন । তান্ডুর নামানুসারে সেই নৃত্য তান্ডব নৃত্য নামে পরিচিত হয় । এদিকে ভারতীয় নাটকে লাস্য-নৃত্যের প্রবর্তন করেন স্বয়ং পাবর্তী এবং তাঁর কাছ থেকে সবর্প্রথম উক্ত নাচ শেখেন রাজা বানের কন্যা উষা । তারপর এই নৃত গোপীবালাদের মাধ্যমে সৌরাষ্ট্রের মহিলাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে । ভারতীয় নাটকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময় হল সামন্ত যুগ । এই যুগের উজ্জলতম নক্ষত্র হলেন মহাকবি কালিদাস ।
কালিদাসের বহু অগ্রবর্তী হলেন দক্ষিণাতের অধিবাসী সংকৃত নাট্যকার ভান । ইনি দশটি নাটক লিখেছিলেন । কিন্তু খ্যাতি ও সাফল্য লাভ করেছিলেন কালিদাস । সংকৃত নাটকের এই যুগটি খ্রীস্টীয় প্রথম থেকে তৃতীয় শতকের মধ্যেই হওয়া সম্ভব । কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ নাটক বিশ্ববিশুত । তাঁর অপর দুটি নাটক ‘বিক্রমবর্শী’ ও ‘মালবিকাগ্নি মিত্র’ ।
কালিদাসের পরবর্তী লেখকদের মধ্যে রাজা শুদকের ‘মুচ্ছকটিক’ নাটকটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । গ্রীক নাটকঃ গ্রীক নাটকের সূত্রপাত সরাসরি কোন দেবতার হাতে ঘটেছে এমন কথা সেই দেশের নাট্য ইতিহাসে নেই । তবে এদেরও একজন নাট্য দেবতা ছিলেন । তিনি হলেন এপোলোর সন্তান ডাইওনিসাস (Dionysus) । অথচ প্রথম গ্রীক নাটকের রচয়িতা একজন মানুষ – নাট্যকার এসকাইলাস (Aeschylus) ।
পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই প্রথম নাট্যকার । তৎকালে ডাইওনিসাসের সন্মানার্থে বা সন্তুষ্টির জন্যে এক ধরনের সমবেত-সংগীত গাওয়া হতো । এই সমবেত সংগীতের মধ্যে দেবতাদের গুনগান করা হত । কালক্রমে শোক্রে বর্নিত কোন বিশষ চরিত্রের রূপ দেয়ার প্রয়োজন অনুভূত হয় এবং খ্রীস্টপূব ছয় শতকে থেসপিস (Thespis) সেই উপাসনা সংগীতে একটি অভিনেতার চরিত্র জুড়ে দেন; তবে এই চরিত্রটিতে মূক অভিনয় করতে হত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চরিত্রের মুখোশ পরে।
এই ঐতিহ্য অনুসরন করেই অসকাইলাস তাঁর প্রথম ‘The Suppliants’ রচনা করেন খ্রীস্টপূব ৪৯০ শতকে এবং এই নিয়মের মধ্যে কিছু পরিবর্তন ঘটান । এই নাটকে তিনি দুটি অভিনেতার ব্যবস্থা করেন এবং তাদের মুখে কিছু ভাষা জুড়ে দেন । এমনিভাবে এক কালের উপাসনা সংগীত ধীরে ধীরে নাটকে পরিনত হয় । গোড়াতে আজকের অর্থে মঞ্চ বলে কিছুই ছিল না । আসকাইলাস নাটক করতেন পাহাড়ের উঁচু জায়গায় কোন রকমে একটু ব্যবস্থা করে নিয়ে । দর্শকবৃন্দ নিচে বসে উন্মুক্ত মাঠে বসে সে অভিনয় দেখত ।
নাট্যকার নাটক লিখে নিজেদের দলবল নিয়ে তা তৈরী করতেন এবং সেটা মঞ্চস্থ করবার ব্যায়ভার বহন করতেন সমাজের ধনী সম্প্রদায় । তখনকার দিনে নাট্যকারই ছিলেন মূল ব্যক্তি এবং তাকে গিরেই নাট্যসম্প্রদায় গড়ে উঠতো । নাট্য সম্প্রদায়ের এই উৎসাহের দরুনই উন্মুক্ত পাকা মঞ্চ গড়ে উঠতে থাকে ধীরে ধীরে । আসকাইলাসের পর যিনি গ্রীক নাটকে আবির্ভূত হন তিনি হলেন নাট্য ইতিহাসের অবিস্মনীয় ব্যাক্তি সোফেক্লেস (Sophocles) । তাঁর হাতেই নাট্যকলার বিভিন্নমুখী অগ্রগতি ঘটে । তিনি প্রথম Trilogy প্রথা তুলে দিয়ে সেটার পরিবর্তে পৃথক পৃথক বিষয়ের ওপর তিনটি নাটক মঞ্চথ করার নিয়ম চালো করেন । ধীরে ধীরে নাটকে সংলাপের পরিমান বৃব্ধি পায় ।
থেসপিস থেকে আরম্ভ করে সোফোক্লেস পযর্ন্ত নাটকগুলোতে একটানাভাবেই রূপকথার গল্প, রাজ-রাজড়ার কাহিনী এবং তদুপরি দেবতার প্রার্দুভাব লক্ষ্য করা যায় । সাধারন মানুষের জীবন আচার এই নাটকগুলোতে প্রবেশাধিকার পায়নি । কিন্তু সোফোক্লেসের চাইতে দশ বছরের কনিষ্ঠ ইউরিপিডেস জীবনকে দেখতে আরম্ভ করেছিলেন অন্য দৃষ্টিতে । নাটকে তিনি বাস্তব ও সাধারন মানুষের মধ্যে নিয়ে এসে সেটার মাধ্যমে জীবনদর্শন তুলে ধরবার জন্যে আগ্রহান্বিত হয়ে ওঠেন ।
গল্পের সন্ধানে তিনিও রূপকথার দারস্থ হয়েছেন বটে কিন্তু রূপকথার রাজরানী আর ভগবানকে বাদ দিয়ে সব চরিত্রকে সাধারন মাটির মানুষে পরিনত করলেন । তিনিই প্রথম রূপকথা –উপকথার অবাস্তব দেশ থেকে নাটককে মাটির ধরনীতে সাধারন মানুষের কাছে হাজির করে দেন । এজন্যেই নাট্যজগতে বাস্তববাদের পথপ্রদর্শক হলেন ইউরিপিডেস । তাঁর পথ ধরেই খ্রীস্টপূব ৪২৫ শতকে এরিস্টোফ্যানিস রচনা করেন ‘The Acharnians’ ।
যেটি একটি যুব্ধবিরোধী নাটক । এতে নাট্যকার রাজনীতির প্রতি কটাক্ষ করেছেন । তাছাড়া তাঁর নাটকের মধ্যে ধনী- দরিদ্রের সমস্যাও দেখা দেয় প্রবল করে । তাঁর প্রতিটি নাটকই প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করে । এরিস্টোফ্যানিস এর মৃত্যুর পর এথেন্সের রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটে এবং বুর্জোয়া সভ্যতার সূচনা হতে থাকে । মানুষের চিন্তার মধ্য থেকে সকল দেবতাই বিদায় নিতে বাধ্য হয় একমাত্র প্লুটাস (Plutus) টিকে থাকে । বনিক মনভাব প্রবল হয়ে ওঠে এবং অর্থোপাজর্নটা বড় হয়ে দেখা দেয় । এই সময় সারা গ্রীস জুড়ে ব্যাপক মঞ্চ-তৎপরতা দেখা দেয় । পুরানো নাট্যশালার সংস্কার করা হয়, অর্ধবৃত্তাকারে নতুন মঞ্চশালা তৈরী হয়, মঞ্চসজ্জায় বিস্তর পরিবর্তন ঘটে এবং মঞ্চ দ্রুতগতিতে বাস্তবতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে । এই যুগের উল্লেখযোগ্য নাট্যকার মেনানডার (Menander) ।
তাঁর কোন কোন নাটক আজকের দিনের নাটকের তুলনায়ও বেশী আধুনিক । খ্রীস্টপূব দুই শতাব্দী পযর্ন্ত গ্রীক নাটকের এই বিস্তৃতি এবং এখানেই গ্রীক মঞ্চের সমাপ্তি ঘটে । রোমান নাটকঃ গ্রীক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গড়ে উঠে রোমান সাহিত্য ও মঞ্চ । কিন্তু রোমানদের নাটকের মধ্যে বহির্মুখীন দৃষ্টিভঙ্গিটাই প্রবল । গ্রীকদের প্রত্যক্ষ প্রভাবেই রোমের নাট্যশালা গড়ে ওঠে এবং সৃষ্টি হয় ল্যাটিন নাটকের । কর্ডোভার অধিবাসী সেনেকা হলেন রোমান মঞ্চের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাট্যকার । তিনিই প্রথম নাট্যকার যিনি নাটককে পাঁচ অংকে ভাগ করেন ।
তাছাড়া সমবেত সংগীত কমিয়ে তা একেবারে নামে মাত্র রাখেন এবং প্রস্তাবনা অংশকে নাটকীয় ঘটনায় পরিনত করেন । গ্রীক আমলে নাট্যশালাগুলো তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল – Auditorium, Orchestra এবং Stage । কিন্তু রোমানগণ চতুর্দিকে দেয়ালবেষ্টিত একটি পেক্ষাগৃহের মধ্যে উপরোক্ত তিনটি ভাগকে একত্রে সন্নিবেশ করেন । মঞ্চসজ্জার জাঁকজমক বৃব্ধি পায় এবং মঞ্চের সম্মুক্ষভাগে একটি পর্দা প্রথা চালু হয় । রোমান যুগে উপরোক্ত অগ্রগতি ব্যাতীত মঞ্চের ক্ষেত্রে আর বিশেষ কোন অগ্রগতি ঘটেনি ।
খ্রীস্টীয় পঞ্চাশ শতকে বারবারদের হাতে রোমান সম্রাজ্যের পতন ঘটে । তাঁরপর থেকে দীর্ঘকালের জন্যে ইউরোপের ভূখন্ডে কয়েক শতাব্দীকে রোমান নাট্যমঞ্চের অন্ধকার যুগ বলা চলে । কারন গথ, ভ্যানডাল এদের মধ্যে কোন জাতিরই নাট্যকলার প্রতি অনুকূল মনভাব ছিলনা । এ সময় সমস্ত ইউরোপে খ্রীস্ট্রীয় মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে এবং এক নতুন নৈতিকতার উদ্ভব হয় । ফলে ধর্মীয় নাটকের সূচনা হয় সকল ক্ষেত্রে । এসব নাটক Liturgical Drama বলে পরিচিত ছিল । দশম শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পযন্ত এই নাটক চলে ।
কিন্তু নাটকের অগ্রগতির ক্ষেত্রে এই ধরনের নাটকের কোন অবদান নেই । তাই রোমান যুগের অবসানের পর পাশ্চাত্য মঞ্চ আর এগোতে পারেনি বাস্তব অর্থে । প্যালেস্টাইন নাটকঃ প্যালেস্টাইনের অধিবাসী হিব্রুগন একটি অত্যন্ত প্রাচীন জাতি । সমস্ত প্রাচ্য ভূমিতে হিব্রু জাতির বাসভূমি প্যালেস্টাইনই হলো দ্বিতীয় জায়গা যেখানে প্রাচীন যুগেও নাট্য-সাহ্যিতের অস্তিত আমরা খুঁজে পাই । তবে প্যালেস্টাইনে কোথাও নাট্যাভিনয় হত কিংবা নাট্যমঞ্চের অস্তিত ছিল এমন প্রমান পাওয়া যায় না ।
“The book of Job” একমাত্র নাট্যগ্রন্থ হিব্রুজাতির । যব (খ্রীঃ পূঃ ৩৫০) গ্রীক ট্র্যাজেটির আঙ্গিকে এই নাটকটি রচনা করেছিলেন । ভাল মন্দের ভেদাভেদকে কেন্দ্র করেই এই দার্শনিক নাটকটি রচিত । তাই গ্রীক নাটকের প্রভাব এখানে অত্যন্ত স্পষ্ট । চৈনিক নাটকঃ খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বিশেষ বিশেষ ধর্মানুষ্ঠানে সমবেত নাচ গান এবং নীরব অঙ্গভঙ্গি জুড়ে দেয়া হতো ।
এই ধর্মানুষ্ঠানই কালক্রমে পরিবর্তন পরিমার্জিত হয়ে অবশেষে ধর্মীয় নাটকে রূপান্তরিত হয় । এর পর প্রায় একাদশ শতক পযন্ত চৈনিক নাট্য ইতিহাসের পাতা প্রায় শূন্য । একাদশ শতকে তাতারদের মধ্যে মঞ্চাভিনয়ের প্রমান পাওয়া যায় । অবশেষে ত্রয়োদশ শতকে মোঘল শাসনামলে চীনে একটি নাটক মঞ্চস্থ হয় । সেই সময় কয়েকটি ব্যবসায় প্রতিষ্টান নাট্য প্রযোজনা শুরু করে ।
যদিও মঞ্চায়নের আয়োজন ও উপকরন খুবই সামান্য ছিল । কিন্তু নাটকের পাত্র-পাত্রীগন খুবই ব্যয়বহুল ও জাঁকজমক পোষাক ব্যবহার করত । মঞ্চসজ্জার অভাবে বাস্তবতার পরিবেশে যে ঘাটতি হত তা পূরন করতে হত অভিনেতাদের অভিনয়ের মাধ্যমে । তৎকালে চীনে নাটককে ‘মিলিটারী’ও’সিভিল’ দুটি শ্রেনীতে ভাগ করা হত । মিলিটারী শ্রেনী বিভাগের মধ্যে ঐতিহাসিক ঘটনা বা চরিত্র সংযোজিত হত এবং যুব্ধ, মারামারি, খুনোখুনির দৃশ্য সংযোজিত হত স্বাভাবিকভাবেই । সিভিল নাটকের বিষয়বস্তু ছিল সাধারন মানুষের জীবনকথা, বিশেষ করে পারিবারিক জীবন । মধ্যযুগের চৈনিক নাট্যকারদের মধ্যে ওয়াং শিহক বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য । তাঁর তেরটি নাটক আজও টিকে আছে ।
নবজাগরন পর্ব
পঞ্চাদশ শতকে সমগ্র ইউরোপের সাহিত্য শিল্পের জগতে এক নবপ্রান স্পন্দন দেখা দেয়- পূনর্জাগরনের সাড়া পরে যায় যা সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক পন্ডিতগন রেনেসাঁ বলে আখ্যায়িত করেছেন । সাহিত্য, রাজনীতি সকল ক্ষেত্রে নবতর দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষ ঘটে । ইতালীয়ান নাটকঃ এই সময় ইতালীয় নাটকে মঞ্চের দ্বিবিধ উন্নতি সাধিত হয় । ক্লাসিকাল মঞ্চের রীতিতেই অভ্যন্তরে মঞ্চ গড়া হয় এবং Three dimensional effect বা ত্রিমাত্রিক দৃশ্যসজ্জার মাধ্যমে ব্যাপ্তি ও গভীরতা আনায়ন করার চেষ্টা করা হয় । তাছাড়া দর্শকবৃন্দের বসবার জায়গা থেকে পাঁচ ফুট উঁচুতে মঞ্চ স্থাপন করা হয় ।
মঞ্চ পুনর্গঠন ও সাজসজ্জার ব্যাপারে প্রায় অর্ধ শতাব্দী কাল ধরে ইতালীয় মঞ্চাধ্যক্ষগন নানা প্রকার পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান এবং সেটার সাফল্যজনক পরিসমাপ্তি ঘটে ১৫৮৪ খ্রীস্টাব্দে Teatro Olimpico নাট্যমঞ্চে । সেই সময়ে নাটকের এত অগ্রগতির সত্তেও এরিস্টটলের লেখা Rule of the three unites ইতালীয় নাট্যজগতের অগ্রগতিকে রোধ করে দেয় । ফরাসী নাটকঃ এই সময় ফ্রান্সে কিছু পেশাদার মঞ্চ গড়ে ওঠে । জনসাধারনের মধ্যে নাট্য তৎপরতা বেড়ে যায় ।
এই যুগে বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য নাট্যকার আলেকজেন্ডার হার্ডি(Alexander Hardy) প্রায় ছয়শত নাটক রচনা করেন । রোমান্টিসিজম এই সময়ের নাটকের মূল চরিত্র । স্পেনীয় নাটকঃ স্পেনীয় মঞ্চ যখন প্রায় প্রাগৈতিহাসিক পযায়ে বিরাজমান তখন সে দেশে মঞ্চ আন্দোলনের গোড়াপত্তন ঘটে । তারপর মাত্র আর্ধশতাব্দীর মধ্যে এক অত্যন্ত গৌরবময় ঐতিহ্য গড়ে তোলে স্পেনের মঞ্চ । এই ঐতিহ্যের সবশেষ স্থপতি লোপ দ্য ভেগা (Lope De Vega) । তিনি প্রায় সতেরশ নাটক রচনা করেন যার চারশ নাটকের অস্থিত আছে আজো । এমন অধিক সংখক নাটক পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোন নাট্যকার করেননি ।
ভেগা বৃহত্তর জনসাধারনের জন্যে নাটক লেখার অনড় ব্রত নিয়ে কাযর্ক্ষেত্রে অবর্তীন হন । দর্শক যা আশা করবে এবং তাদের জন্য যা পরিবেশন করা প্রয়োজন সেটাই ছিল নাট্য রচনাকালে তার বিবেচ্য বিষয় । সবল, সাবলীল, গতিময় ভাষায় লোপ দ্য ভেগা তাঁর Fuenta Ovejuna নাটকে শ্রেনী সংঘাতের যে চরম চিত্র অঙ্কন করেছেন তা রেঁনেসা যুগের যে কোন নাটকে প্রায় দুর্লভ ।
ইংল্যান্ডীয় নাটকঃ স্পেনীয় নাটক যখন এমনিভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথের শাসনামল । রানী এলিজাবেথ মঞ্চাভিনয় খুব পছন্দ করতেন । রানীর এই নাট্যপ্রিয়তা একধিকে যেমন নাট্যকার ও শিল্পীদের উৎসাহিত করেছে অন্যদিকে নাট্য আন্দোলনকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করেছে ।
এলিজাবেথের সময় নাট্যকারের সংখ্যা ছিল অনেক । এদের মধ্যে বিস্ময়কর ক্ষমতার অধিকারী ক্রিস্টোফার মার্লো সবার্গ্রে স্মরনীয় । ইংল্যান্ডে বিপ্লবাত্নক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ছিলেন মার্লো । মার্লো ১৫৮৮ সালে Dr. Faustus নামে একটি নাটক রচনা করেন যা পরবর্তীতে শেক্সপীয়রের সমস্ত ট্রাজেডি নাটকের মূল উৎস ও অনুপ্রেরনা হিসেবে কাজ করে । তাঁর অন্যান লেখার মধ্যে The Jew of Malta বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । কিন্তু অকালেই মার্লোর জীবনে নাটকের যবনিকা নেমে আসে । ১৫৯৩ সালে তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হন । এরপর শুরু হয় শেক্সপীয়রের যুগ ।
শেক্সপীয়রের অতুলনীয় নাট্যপ্রতিভা নিয়ে গত দুই শতাব্দীকাল সমগ্র পৃথিবীতে এতো বেশী আলোচনা হয়েছে যে অন্য কোন নাট্যকারের রচনা নিয়ে তা হয়নি । শেক্সপীয়রের যাত্রা শুরু হয় মার্লোর আদর্শে । তাছাড়া গ্রীন ও টমাস কীডের প্রভাবও ছিল তাঁর মধ্যে । দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বনাট্যমঞ্চে যে বিবর্তন সংঘটিত হচ্ছিল সেটার এক বড় অধ্যায়ের সাফল্যজনক পরিনতি ঘটেছে শেক্সপীয়রে । তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে – কিং লিয়ার, লেডী ম্যাকবেথ, অ্যান্টনিও এবং ক্লিয়োপেট্টা, রোমিও জুলিয়েট, জুলিয়া সিজার অন্যতম ।
অবশেষে উনবিংশ শতকের প্রথমভাগে মঞ্চ তার মধ্যযুগীয় সম্পর্ক চুকিয়ে বাস্তববাদী আধুনিক জগতে প্রবেশ করে । ১৮৩০ থেকে ১৮৭০ খ্রীস্টাব্দ পযর্ন্ত নাট্যজগতে এক নতুন যুগের সূচনা হয় । এই সময়ের মধ্যে নাটক রচনা থেকে আরম্ভ করে প্রযোজনা, পরিচালনা, অভিনয়, মঞ্চসজ্জা, আলোকসম্পাত প্রভৃতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং নতুন নতুন পব্ধতি আবিষ্কৃত হয় ।
১৮২০ খ্রীস্টাব্দে গ্যাসলাইট ব্যবহিত হতে অরম্ভ হয় মঞ্চে । এতোকাল অবধি মোমবাতি বা ল্যাম্প জাতীয় তেমন কিছু জালিয়ে মঞ্চ আলোকিত করা হত । গ্যাস লাইট চালু হওয়ার পর থেকে আলোক নিয়ন্ত্রন অনেকাংশে সহজ হয়ে আসে । তার ফলে দর্শকদের মধ্য থেকে অভিনেতাগনকে আলাদা করে নেয়া সম্ভব হয় । এই পৃথকীকরন সম্ভব হওয়ার জন্যই মঞ্চের সম্মুখে পর্দার ব্যবহার এক নতুন মাত্রা পায় । পর্দা দশর্ক ও অভিনেতাদের মধ্যে সীমারেখা হয়ে দাঁড়ায় । ধীরে ধীরে অলোকসম্পাত কারায়ত্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চসজ্জার নানা পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে ।
নবনাট্য পর্ব
বাস্তবাদী নবনাট্য আন্দোলনের শুভ উব্দোধন হয় ১৮৫০ সালে প্রথম গদ্য নাটক হেনরিক ইবসেনের ‘Catilina’র মাধ্যমে । এর অর্ধ শতক পর বাস্তবাদী নাটকের এক প্রবল জোয়াড় বয়ে যায়, যার অবগাহন করেছিলেন ইবসন ছাড়াও স্ট্রীগুবার্গ, চেখভ, সিংগে, পিরানডেলো, হপ্তমান এবং বানার্ড শ-র মতো রথী-মহারথী ।
ইতিহাসে ইবসনকে নবনাট্য আন্দোলনের দিশারী হিসেবে উল্লেখ্য করা হয় । যদিও তাঁরও আগে জার্মান নাট্যকার ফেডরিক হেব্বেল ও ফরাসী লেখক এমিল জোলা বাস্তববাদী নাটকের সূচনা করেছিলেন । সমাজের নিম্নমধ্যবিত্তের জীবন কথা, তাদের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, নৈতিকতার প্রতি আকর্ষন এবং ব্যাক্তির ও সমাজের সঙ্গাত এ সবই হেব্বেল আমদানী করেছিলেন তার নাটকে ।
অপরদিকে জোলা সমাজের বস্তুতান্তিক নগ্নবাস্তবতাকে ফটোগ্রাফিক সততায় নাটকের মাধ্যমে মঞ্চে তুলে আনেন । তবু ইবসনই নবনাট্য আন্দোলনের জনক । কারন তিনি এই নাট্যরীতির সবার্পেক্ষা শক্তিশালী প্রবক্তা এবং কর্মী । মনীষী বার্নাড শ’র মতে “ইবসনে যদি নাটক রচনা না করতেন তাহলে ইউরোপীয় নাট্যমঞ্চে নবযুগের সূচনা হতো না কোনদিন ।”
ইবসেন নাট্যকার হিসেবে আন্তপ্রকাশের বহু আগে থেকেই মঞ্চের সাথে জড়িয়ে পরেন । তার নাট্যকর্মকে চার ভাগে ভাগ করা চলে । Catilina থেকে আরম্ভ করে The Pretender (১৮৬৩) পযর্ন্ত নাট্যকার ইবসেনের শিক্ষা নবিসিকাল ধরে নেয়া যেতে পারে । তাঁর প্রথম দিকের নাটকের মধ্যে The Pretender অন্যতম যাতে সিম্বলিক ট্রাজেডি প্রকাশ পায় খুব সুন্দরভাবে ।
তবে এ সময়ের মধ্যে প্রকাশিত কোন নাটকই উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করতে পারেনি । যদিও দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগে তিনি পরিপূর্ণ, পরিপক্ক, সফল এবং যুগসৃষ্টা নাট্যকার হিসেবে প্রতিভাত । ইবসেনের দ্বিতীয় ধাপের নাটকগুলো হল Brand, Peer Gynt, Emperor and Galilean । তৃতীয় ধাপের নাটকগুলো হল The League of Youth, Pillars of Society, A Doll’s House, An Enemy of the People, The Wild Duck, Ghost, Hedda Gabler ইত্যাদি । অপরদিকে তাঁর চতুর্থ ভাগের লেখা নাটক তাঁর স্বজনী শক্তির ক্রমস্তিমিত হওয়ার স্বাক্ষর ।চতুর্থ ধাপের নাটকগুলো হল The Master Builder, Little Eyolf, John Gabriel Borkman, When we Dead Awakened ইত্যাদি নাটক ।
নবনাট্য আন্দোলনের দিশারী হেনরিক ইবসেন একথা সত্য; কিন্তু নাট্য ইতিহাসের এই অধ্যায়ে তিনি একক চতিত্র নন । নুট হামসন(The Game of life, 1894), জোনাস লী (The Merry Wives, 1894), আলেকজান্দার কিল্যাগু (The Couples, 1886; The Professor, 1888), গানার হিবার্গ (The Balcony, 1894; The Love’s Tragedy, 1904) এঁরা সকলই বাস্তববাদী নাট্য-আন্দোলনের প্রবক্তা ও কর্মী । এছাড়া আরেকজন উল্লেখযোগ্য ও সাথে সাথে বিতর্কীত চরিত্র হলেন স্ট্রীন্ডবার্গ । দীর্ঘ চল্লিশ বছরে তিনি ষাটটি নাটক, ত্রিশটির অধিক উপন্যাস রচনা করেন ।
তাছাড়া আন্তচরিত্র, রাজনীতি এবং ইতিহাসও তাঁর রচনার অন্তরভুক্ত । তাঁর বিচিত্র ও বিস্তৃত লেখার পরিধিই প্রমান করে যে তিনি একজন শক্তিধর সষ্ট্রা ছিলেন । নারীর প্রতি বৈরীভাব, অপ্রতিরোধ্য মানসিক উত্তেজনা, তীব্র আঘাত ও তীক্ষ্ণ সংলাপপূর্ণ নাটকীয় পরিস্থিতি তাঁর নাটকের মূল উপজীব্য । তাঁর কাযর্ক্রম অনুসরণ করলে দেখা যাবে, ধাপে ধাপে নতুন লক্ষ্য দ্বারা পরিচালিত হয়ে তিনি নব নব নাট্যরীতির প্রবর্তন করতে চেষ্টা করেছেন, যা নাট্য-আন্দোলনকে বেগবান করতে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে ।
স্ট্রীন্ডবার্গ এর পর নবনাট্য আন্দোলনের আরেকজন মহারথী হলেন জেরহার্ত হপ্তমান । হপ্তমান নাটক রচনা করতে গিয়ে জীবনের সবচেয়ে বিক্ষুব্ধ দিক, অপরাধের নির্মম ছবি, আদিম কামনা-বাসনা, বিকৃত এবং সমাজের নিন্মস্তরের মানুষের জীবন-কথা নাটকের উপাদান হিসেবে বাছাই করতে আরম্ভ করেন । কারন, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, দৈনন্দিন জীবনের অতি সাধারণ ঘটনাগুলোই এমন ঘাত-প্রতিঘাত সৃষ্টি করতে সক্ষম যেগুলো থেকে স্বাভাবিকভাবেই নাটক গড়ে ওঠে ।
তাই তিনি নাটকের পাত্র-পাত্রী নিবার্চন করলেন সাধারন মানুষের মধ্য থেকে যারা নিজেদের সাধারণ অবস্থার পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে আসতে চায় বৃহত্তর জীবনের আঙ্গিনায়। মঞ্চকে তিনি টেনে নিয়ে এলেন একেবারে জীবন-হাটের মাঝখানে । ১৮৮৯ সালে হপ্তমানের প্রথম নাটক Before Dawn (সূযর্দয়ের আগে) এক অতি সম্ভাবনার প্রভাতের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আন্তপ্রকাশ করে । ১৮৯০ সালে প্রকাশিত হয় পারিবারিক বির্পযয়কে কেন্দ্র করে হপ্তমানের দ্বিতীয় নাটক ‘Festival of Peace’ । এটিও বিশেষ সুখ্যাতি লাভ করে । হপ্তমান চল্লিশটিরও অধিক নাটক রচনা করেছেন । এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল Drayman Herschel, Rose Bernd, Gabriel Schilling’s Flight, The Weaver, Colleague Crampton, The Beaver Coat ইত্যাদি ।
ভাবসমৃব্ধ নাট্যপর্ব
ইবসেন-স্ট্রীগুবার্গ-হপ্তমান যে প্রগিতিবাদী নাট্যধারার সূচনা করেছিলেন তা ইউরোপীয় ভূখন্ডের প্রায় সবর্ত্রই কম-বেশী মঞ্চকে প্রভাবিত করেছিল । ফরাসী দেশে এ প্রভাব দেখা দেয় একটু ভিন্নরূপে যা Play of Ideas-বলে পরিচিত । এই Play of Ideas এর ক্ষেত্রে প্রধান উল্লেখযোগ্য নাট্যকার পোর্টোরিচ । ‘দি লাক অব ফ্যাস্কয়জ’ (১৮৮৯) ‘এ লাভিং ওয়াইফ’ (১৮৯১) ‘দা ওল্ড ম্যান’(১৯১১) প্রভৃতি তাঁর বিশিষ্ট রচনা । এ ধারার আরেকজন উল্লেখযোগ্য নাট্যকার হলেন মাউরিস ডোনে । তাঁর প্রথম সার্থক নাটক ‘লাভার’ (১৮৯৬) । তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে ‘দি একিং হার্ট’ (১৮৯৭), ‘দি ইমানসিপেটেড ইয়াম্যান’ (১৮৯৮), ‘দি আদার ডঞ্জার’ (১৯০২) নাটকগুলোতে তিনি মানব-হৃদয়য়ের কামনা-বাসনা, আবেগ-উচ্ছাসের অত্যন্ত সংবেদনশীল, শালীন ও উদারমনা প্রতিবেদক । Play of Ideas এর নাটয়কার এ সময় আরও বেশ কয়েকজন ছিলেন ফ্রান্সে ।
তবে এঁদের মধ্যে বিশেষ আলোচনার দাবীদার হলেন ক্রাস্কোসিস দ্যা কুরেল । তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে‘দি ফসিলস’ (১৮৯২), ‘লাভ এমব্রায়ডার্স’ (১৮৯৩), ‘দি লায়ন্স ফিস্ট’ (১৯৯৮), ‘দি নিউ আইডল’ (১৮৯৯), ‘দি স্যাভল গার্ল’, ‘দ্যা বিষ্ট’ (১৮৯৬), ‘দি ফ্যামিলী লুনাটিক’ (১৮৯৩), ‘মারিউচ’ (১৯০৩), ‘দি গ্রান্ড ফাদার’ (১৯০৪) অন্যতম । ক্রাস্কোসিস দ্যা কুরেলের নাট্যকর্মের কলাকৌশলগত জ্ঞানের অপ্রতুলতা থাকলেও লেখক হিসেবে তাঁর নিষ্টা অনসীর্কায । ভাবসমৃব্ধ নাটকের এই পবের শেষের দিকে বাস্তব্বাদী নাট্য আন্দোলন এক অজ্ঞাত কারনে মুখ থুবরে পরে এবং শুরু হয় নতুন আরেকটি পর্ব ।
নিউ-রোমান্টিসিজম পর্ব
নাট্যকলার ক্রমবিকাশের এই ক্ষনে বাস্তব্বাদী নাট্য আন্দোলনের মূল পবের সমাপ্তি ঘটে এবং নতুন আরেকটি নাট্যরীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যা নাট্য-ইতিহাসে নিও-রোমান্টিসিজম বলে পরিচিত । ১৮৭৬ সালে মার্লামের ‘Lapres-mindi due faune’ নামক নাটকের মাধ্যমে নিও-রোমান্টিসিজমের সূচনা ঘটে । নাটককের সূচনা নিয়ে মতভেদ থাকলেও এই নাটকের মধ্য দিয়েই যে প্রতীকধর্মী কাব্যনাট্যের যাত্রা শুরু হয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই । ১৮৮৬ সালে নিও-রোমান্টিসিজম এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ফিগারোতে প্রকাশিত হয় বেশ ফলাও করে । তখন মূল ঘোষনাপত্রে বলা হয়েছিলঃ প্রতীকধর্মী কবিতা কাব্যচিন্তাকে একটি সংবেদনশীল ফর্মের আচ্ছাদনে পরিবৃত্ত করতে চায় । তবে, সেটাই মূল লক্ষ নয় ।
এই মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে বাহ্যিক বাস্তবতাকে পাশ কটিয়ে অন্তরমূলের সত্যকে প্রভাসিত করবার চেষ্টায় ব্রতী হন নিও-রোমান্টিসিজমের নাট্যকারগন । এই নাট্যরীতির প্রবক্তাদের যুক্তি হলো, সংলাপ জীবনের বাস্তব রূপ ফোটাবার জন্যে, অনুভূতির প্রতিফলন ও দর্শকের মধ্যে সেটার সঞ্চারই সংলাপের আসল লক্ষ্য । তবে সেটা বাস্তব্বাদীদের মতো বহির্মুখীন নয়- সংবেদনশীল এবং অন্তর্মুখীন হওয়ার জন্যে সবর্তোমভাবে । হৃদয়ের গভীরের আবেগ-অনুভূতির চিত্রকল্পের জন্যে গান বা কবিতার দ্বারস্থ হওয়া ইদানিং কালের প্রবনতা নয়; মানবসভ্যতার মতোই পুরোনো এই প্রবনতা এবং ভাষার জন্মলগ্নের সঙ্গে সম্পৃক্ত ।
আদিম মানুষের রহস্য-চেতনায় কাব্যের প্রথম উন্মেষ । সেজন্যই বোধ হয় আবেগ-অনুভূতি যেখানে প্রবল সেখানে ছন্দবব্ধ কাব্যকথা সকলের আগে প্রবেশপথ খুঁজে নেয় । নাটকে সংলাপের দুটি মাত্র উদ্দেশ্য থাকে – প্রথমত, নাটকটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং দ্বিতীয়ত, দর্শকচিত্তে অসসঞ্চার ও বক্তব্য কম্যুনিকেট করা । অভিনেতা ও দর্শকে মধ্যে এই যে অনুভূতি ও বক্তব্যের আদান-প্রদান সেটা গদ্য-নাটকের তুলনায় ছন্দবব্ধ কাব্য-নাটকের পক্ষে অনেক বেশী সহজ । কাব্যনাটকের প্রবক্তাদের দাবী হলো, পদ্যে লেখা সংলাপের কম্যুনিকেটিং ক্ষমতা অনেকাংশে বেশী ।
কারন, লিরিক্তার আর্ন্তবাহী সত্য হচ্ছে গতিময় আবেগময়তা । ধ্রুপদী যথার্থে এই গতিময়তা যে সংঘাতের সম্মুখীন হয়, তাতেই নাট্যরস জমে ওঠে । কিন্তু কালের প্ররিক্রমায় বিংশ শতকের প্রথম দিকে নাটকে ভিন্নতর স্বাদের আমেজ পরিবেশন করা নিও-রোমান্টিসিজম আবার পর্দার আড়ালে চলে যায় । অন্যদিকে সাময়িক প্রতিকূলতা কাটিয়ে বাস্তববাদী নাট্যধারা আবার নবতর প্রাণচাঞ্চল্যে জেগে ওঠে এবং এই দশক থেকেই নাট্য-ইতিহাসের আর একটি আধ্যায়ের সূচনা ঘটে।
আধুনিক পর্ব
ঊনবিংশ শতকের শেষ দশকে নতুন চিন্তার আভাস নিয়ে কিছু কিছু নাটক মঞ্চস্থ হয় যেখানে একটু একটু করে আধুনিক নাটকের পদধ্বনি শোনা যেতে আরম্ভ করে । এই প্রতিধ্বনি তুলে যাঁরা আগমন করেছিলেন তাঁদের অগ্রপথিক হলেন বিশ্বখ্যাত মনীষী জর্জ বার্নার্ড শ’ । ১৮৯২ সালে তিনি নাট্যকার হিসেবে আন্তপ্রকাশ করেন । বার্নার্ড শ’ এর নাটকে মূল লক্ষ্য হল Creative Evolution বা সৃষ্টিমূলক বিবর্তন । এই লক্ষ্য সমনে রেখেই ১৯০১ সালে রূপকথার গল্প ‘ডন জুয়ান’ অবলম্বনে নাটক রচনা আরম্ভ করেন এবং এর বিশ বছর পর আবার ঐ একই উদ্দেশ্যে ‘গাডেন অব ইডেন’ অবলম্বনে অবিস্মরনীয় নাটক ‘Back to Methuselah’ রচনা করেন ।
‘Would Drama’ গ্রন্থে এলারডাইস নিকল এক জায়গায় বার্নার্ড শ’ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন- “এই যুগটা খুব সম্ভব, নাট্য-ইতিহাসের শুধু একজনের যুগ- তিনি জর্জ বার্নার্ড শ ।” নাটকের মধ্যে উদ্দেশমূলক হাসির প্রবকর্তাও ছিলেন এই বার্নার্ড শ’ । মাইকেল মধুসুদন দত্ত, লুডউইগ থমার, এডঅয়ার্ড কার্লুইস , গিলবার্ট এবং সুলিভান এরা সবাই হাস্যরসসমৃব্ধ ও ব্যাঙ্গান্তক নাটক রচনা করেন । কিন্তু শ’ এর সঙ্গে কারুরই তুলনা চলে না । কারণ, মুখ্যত সমস্যাপ্রধান সিরিয়াস নাটকে অমন উদ্দেশ্যপূর্ণ দম-ফাটানো হাসির ফোয়ারা তিনি ছাড়া আর কেউ সৃষ্টি করতে পারেন নি ।
এজন্যে যে প্রজ্ঞা, যে বিদ্যাবুব্ধি, যে সমাজ সচেতনতা, যে বিপ্লবী মনোভাব ও রসজ্ঞানের প্রয়োজন তা একমাত্র বার্নার্ড শ’ এরই ছিল । অনেকের মতে, বার্নার্ড শ’ মূলত তাঁর বিশেষ সামাজিক মতবাদ প্রচার করার জন্যে নাট্য-মাধ্যম বেছে নিয়েছিলেন । তিনি যতোখানি নাট্যকার তার চেয়ে অনেকাংশে বেশী মতবাদ প্রচারক ছিলেন । তিনি একটির পর একটি নাটক লিখে সামাজিক দোষ-ত্রুটির প্রতি শুধু অঙ্গুলিনিদের্শ করেই ক্ষান্ত হননি বরং প্রতিকারের নিদের্শও দিয়েছেন । বার্নার্ড শ’ এর পরও কালের বিবর্তনের সাথে সাথে সময়ের প্রয়োজনে আধুনিক নাট্যধারার এই ক্রমবিকাশ চলতে থাকে সমান তালে ।
বিবর্তনের এই ধারায় দুটি বিশ্বযুব্ধের মধ্যবর্তী সময়ের নাট্য তৎপরতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । এই সময়ের মধ্যে আধুনিক নাট্য-আন্দোলনের বলিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তপ্রকাশ ঘটে । এই সময় পাশ্চাত্যের আধুনিক নাট্যধারার প্রভাব পড়তে আরম্ভ করে প্রাচ্যের মঞ্চের ওপর । দুটি নাট্যধারা এ সময় কাজ করছিল । একটি হল ইবসেনীয় প্রথার সামাজিক সমস্যাকে মুখ্য করে নাটক রচনা আরেকটি হলো মানব-হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করে ব্যাক্তিচরিত্র অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে রূপান্তর করা ।
এই সময় রাশিয়ার অভ্যুদয় ঘটে এবং সামাজিক দায়দায়িত্ব সম্বন্ধে অন্য সব শিল্প-মাধ্যমের মতো নাটকও পূর্ণ সচিতন হয়ে ওঠে । ফলে সমাজতান্তিক রাশিয়ায়র নাটক ও চলচ্চিত্র কিছুটা প্রচারধর্মী রূপ নিতে বাধ্য হয় । প্রথম বিশ্বযুব্ধের সময় মার্কিন মুলুকে নাট্য-তৎপরতা শুরু হয় । হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জর্জ পি বেকার কিছু উৎসাহী লেখকদের নিয়ে নাট্য-আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন । এদিকে থেরেস হেলবার্ন, রবার্ট এডমন্ড জোন্স, লরেন্স লাঞ্জনার, ফিলিপ ময়েলার ও লী সিম্পসন প্রমুখের আপ্রান প্রচেষ্টার প্রথম সাফল্য হিসেবে ওয়াশিংটনে স্কোয়ার প্লেয়ার্স নামক প্রতিষ্ঠানের জন্ম ১৯১৫ সালে ।
এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য ছিলেন স্বনামখ্যাত নাট্যকার ইউজেন ও নীল । এই সময় আর্থার হপকিনস ‘Theater Art Monthly’ প্রতিষ্টা করেন । এদিকে ইউজেন ও নীল কয়েকটি একস্কিকার সস্কালন বের করেন এবং ১৯১৪ সালে এবং ১৯২০ সালে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান Emperor Jones প্রকাশিত হয় । এই বছরই ইউজেন ও নীলের নেতৃতে একদল তরুণ নাট্যকারের আবির্ভাব ঘটে যাঁরা নিউইয়র্কের রঙ্গমঞ্চে রীতিমতো ঝড় সৃষ্টি করেন ।
১৯২৩ থেকে মাত্র তিন বছরের মধ্যে ইউজেন ও নীলের All God’s children got wings, Desire under Elms, The Fountain, এলমার রাইসের The Adding Machine, ফিলিপ বেবীর The Youngest, Ina Garden, ম্যাক্সওয়েল এন্ডারসনের What Price Glory, The Buccaneer, পল গ্রীনের Scuffle town outlaws, The No Count Boy এই রকম একের পর এক নাটক হুমড়ি খেয়ে পড়ে । এ যেন বোতলে আবব্ধ দৈত্যের মতো আমেরিকান সুপ্ত নাট্য-প্রতিভা হঠাৎ মুক্ত হয়ে প্রবল জোয়াড়ের মত বেরিয়ে আসে ।
বাংলা যাত্রাভিনয়
এদেশে যাত্রার সূচনা দেবপূজা উপলক্ষে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গার উদ্দেশ্যে যাত্রা বা গমনকে কেন্দ্র করে । এই যাত্রা অর্থাৎ যাওয়ার সময় নৃত্য-গীতের প্রয়োজন হত । নৃত্যগীত সম্বলিত এই যে যাওয়া অর্থাৎ যাত্রা সেটাকে তখন বলা হতো নাটগীত বা গীতনাট । দেবপূজা সংক্রান্ত উপরোক্ত যাত্রার মুহূর্ত থেকেই সমস্ত চলার পথে এ নৃত্য-গীত চলতো এবং গন্তব্যস্থলে পৌচ্ছুবার পরও নৃত্যগীত ও অভিনয় জাতীয় কিছু অঙ্গভঙ্গির সাহায্যে দেবলীলার মহিমাকীর্তন করা হতো সমবেত উৎসুক জনতার সামনে । আমাদের লোকনাট্য যাত্রাভিনয়ের আদি-পর্ব এটাই ।
আবার আমরা দেখতে পাই প্রাচীন গ্রীসে নানা ধর্ম-কর্ম, সামাজিক ক্রিয়া-অনুষ্ঠান ইত্যাদির মধ্যে নৃত্যের ছিল এক বিশেষ ভূমিকা । কালক্রমে এই নৃত্যের সঙ্গে সংযোজিত হলো গান এবং পরবর্তী সময়ে ঠাঁই করে নিলো আবৃত্তির ফর্মে কথা বলা । অবশেষে যখন এই নৃত্য, গীত ও কথা একত্র হয়ে একটি গল্প বলতে চাইলো দশর্ক-শ্রোতার কাছে তখন সেটাই হয়ে গেল লোকনাট্য । সমাজ-বিবর্তনের প্ররিক্রমায় এক সময় নগর-রাজ্য এবং নগর-সভ্যতা গড়ে ওঠে । তারপর এই নগর সভ্যতার দাবি মেটাতে গিয়ে লোকনাট্য এক সময় নগরের প্রেক্ষাগৃহের অভ্যন্তরে তিনদিকে ঘেরা মঞ্চের ওপর আটকা পড়ে গেল এবং সেটার নতুন নাম হল ‘নাটক’ ।
কিন্তু তাই বলে ইউরোপ থেকে আমাদের দেশে মঞ্চাভিনয়ের উদ্ভব ঘটেছে এমন কথা বলা যাবে না । কারন খ্রীস্টের জন্মের আগেও ভারতীয় উপমহাদেশে মঞ্চাভিনয়ের প্রচলন ছিল এমন প্রমাণ নাট্যশাত্রে পাওয়া যায় । এই প্রসঙ্গে ড. অজিত কুমার ঘোষ ‘বাংলা ভাষার অবিধান গ্রন্থে বলেছেন ‘প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত মঞ্চাভিনয় বোধ হয় সবর্প্রথম পূর্ণ পরিণতরূপে দেখা গিয়েছিল ভারতে ।’
তাছাড়া নাট্যশাত্রের পুঙ্খনিপুঙ্খ বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, দু হাজার বছর আগে পুর্ণবিকশিত শিল্পরসোত্তীর্ণ নাটোকের যেমন জন্ম হয়েছিল তেমনি অতি সুক্ষ আঙ্গিকবহুল প্রয়োগকলা-নৈপুণ্যেরও প্রবর্তন হয়েছিল । ইউরোপে প্রেক্ষাগৃহে নাট্যভিনয়ের সূচনা হয়েছিল অনেক পরে- খ্রীষ্টীয় সপ্তাদশ শতকের গোড়া থেকে । এদিকে প্রাচীন ভারতে যখন মঞ্চাভিনয়ের প্রচলন ছিল তখনও লোকনাট্য একটি নতুন ধারা হিসেবে প্রচলিত ছিল । ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় প্রাচীনকালে মঞ্চনাটক কেবল বিদব্ধমন্ডলী ও রাজরাজড়াদের মধ্যে সীমাবব্ধ ছিল ।
তা ছাড়া সংস্কৃত ভাষায় রচিত সেসব অতি উচুঁপযায়ের নাটকের কোন আবেদনই ছিলনা গনমানুষের কাছে । অপরদিকে লোকনাট্য বেঁচে রয় গনমানুষের অন্তরে । কিন্তু যুগে যুগে লোকনাট্যের সাঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পী কলাকুশলীদের জীবিকার প্রশ্নটা বহুকাল থেকেই সম্পৃক্ত । অতএব, ব্যবসায়ের খাতিয়ে দর্শকের মনোরঞ্জনের কথাটা যাত্রার অধিকারীদের মনে রাখতে হয়েছে সকল সময় । আর তা করতে গিয়ে এক সময়ের যাত্রার মান যায় নেমে । এই নিয়ে চারদিকে সমালোচনার ঝড় ওঠে । আর সমালোচনার হাত রক্ষা পেতে এবং যাত্রাশিল্পকে বাঁচানোর লক্ষ্যে যাত্রাদলের অধিকারীগন এর উন্নয়ন প্রচেষ্টায় মনোনিবেশ করেন । ফলে উনিশ শতকের প্রথম দিকে নতুন যাত্রার প্রচলন হয় ।
তারপর থেকে যাত্রা অনেক পথ অতিক্রম করেছে এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই যাত্রার মধ্যে আরো অনেক পরিবর্তন এসেছে । যাত্রা যতদিন গ্রামাঞ্চলে থিয়েটারের পাশাপাশি চলেছে ততোদিন পযর্ন্ত যাত্রা তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে । কিন্তু যখন থেকে যাত্রার অধিকারীদের নজর পড়লো শহরের নাট্যমঞ্চের প্রতি তখন থেকে যাত্রার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হতে আরম্ভ করে এবং যাত্রা তার মূল-ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয় ।
কারন তিনদিকে ঘেরা মঞ্চের সম্মুখভাগে দাঁড়িয়ে অভিনয় করার ফলে দর্শকদের সঙ্গে অভিনেতা এবং দশর্কের মধ্যে যে নিবিড় যোগাযোগ তা ব্যাহত হতে থাকে । যদিও আধুনিক কালে যাত্রা খোলা মঞ্চেই হয় । তবু নানা করনে যাত্রা তার মৌলিকতা হারিয়েছে । বর্তমানে যাত্রা প্রযোজকরা আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধাই গ্রহন করছেন তাদের নাটকে । ফলে যাত্রা এখন আর গ্রামের অবহেলিত শিল্প নয় । কালক্রমে শহর-গ্রাম সবর্ত্রই ছড়িয়ে পরেছে আমাদের ঐতিহ্যমন্ডিত এই যাত্রা ।
বাংলা নাট্যমঞ্চ ও শেক্সপীয়র
জীবন-মৃত্যুর যুগল রূপ নিয়ে আন্তপ্রকাশ করেছিলেন উইলিয়াম শেক্সপীয়র । ১৬১৬ সালের ২৩শে নবেম্বর তাঁর বায়ান্নতম জন্মদিনে তিনি পরলোকগমন করেন । কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সাড়ে তিনশত বছর পরও তিনি রয়ে গেলেন বাঙ্গালী গনমানুষের মানসপটে এক কালজয়ী স্রষ্টারূপে । বাংলা নাট্যমঞ্চে শেক্সপীয়রীয় নাটকের আবির্ভাব ঘটে ১৭৫৫ সালে কলকাতায় এলিজাবেথীয় ঢং-এ নাট্যশালা ‘দি প্লে হাউস’ স্থাপনের মাধ্যমে ।
তখন যবনিকা ব্যবহৃত হতো এবং মঞ্চের দু’পাশে শিল্পীদের আগমন নির্গমনের জন্যে উইংস ব্যবহার হত । কিন্তু তখন দৃশ্যপট অঙ্কন বা দৃশ্য-পরিবর্তনের সাথে সাথে মঞ্চ-সজ্জা পরিবর্তনের কোন ব্যবস্থা ছিল না । একই পরিবেশ ও অপরিবর্তনীয় দৃশ্যসজ্জার মধ্যেই গোটা নাটক অভিনীত হত ।
এই প্রতিবন্ধকতার পরও ‘ইনডোর স্টেজ শো’ বা ‘কাভার্ড স্টেজ শো’ এর সূচনা হয় এদেশে ‘দি প্লে হাউস’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই । এটিই শেক্সপীয়রীয় আদর্শে প্রতিষ্ঠিত বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের আধুনিক নাট্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠার প্রথম পথপ্রদর্শক । এই নাট্যমঞ্চ বছর চারেক টিকে ছিল । এরপর ১৭৭৫ সালে দ্বিতীয় নাট্যমঞ্চ ‘দি ক্যালকাটা থিয়েটার’ এবং এর কিছুদিন পর ‘দি নিউ প্লে হাউস’ ও ‘হোয়েলার প্লেস থিয়েটার’ স্থাপিত হয় । এই নাট্যশালাগুলোতে ‘হ্যামলেট’, ‘দি মার্চেন্ট অব ভেনিস’, ‘তৃতীয় রিচার্ড’, ‘চতুর্থ হেনরী’ প্রভৃতি নাটকগুলো অভিনীত হত রীতিমত ।
সে আমলের প্রখ্যাত অভিনেত্রী মিস ব্রিস্টো ১৭৮৯ সালে আরও একটি নাট্যমঞ্চ পত্তন করেছিলেন । তবে এই সকল নাট্যশালার তৎপরতার সঙ্গে বাঙালীর প্রত্যক্ষ যোগাযোগের কোন প্রমান না থাকলেও বাংলাদেশের মাটিতে শেক্সপীয়রীয় নাটকের আদি-পর্ব বলে চিহ্নিত করা হয় এই সময়টাকে । অবশেষে শিক্ষিত বাঙালীর মনোজগতে শেক্সপীয়রীয় চেতনার অনুপ্রবেশ ঘটে উনবিংশ শতকের প্রথম দশকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ।
উক্ত কলেজের এক বিদেশী ছাত্র মি. মংকটন ‘দি টেম্পেস্ট’ নাটকের বঙ্গানুবাদ করেন ১৮০৯ সালে । শেক্সপীয়রীর নাটকের বাংলাভাষায় রূপান্তর এই প্রথম । এর পর ১৮১৩ সালে স্থাপিত হয় ‘চৌরাঙ্গি থিয়েটার’ । এই সময় থেকেই বাঙ্গালী-মানসে শেক্সপীয়রীয় ভাবধারা সংক্রমিত হতে আরম্ভ করে ।
এই সংক্রমন আরও জোরদার হয় ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে । ১৮৩০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী টাউন হলে অনুষ্ঠির পুরষ্কার বিতরণী সভায় হরিহর মুখোপাধ্যায় এবং আর কিছু ছাত্র শেক্সপীয়রের বিভিন্ন লেখা থেকে আবৃত্তি করেছিলেন । পরের বছর ১৯ ফেব্রুয়ারী সেই টাউন হলেই ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ এর প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্য অভিনীত হয় এবং তাতে অংশগ্রহন করেন কৈলাশচন্দ্র দত্ত, রামগোপাল ঘোষ, তারকনাথ ঘোষ, ভুবনমোহন মিত্র, তারিনীচরণ মুখোপাধ্যায় অ হরিহর মুখোপাধ্যায় । শেক্সপীয়রীয় নাটকে বাঙালীর অংশগ্রহন এটাই প্রথম ।
১৮৩১ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রসন্নকুমার ঠাকুরের নারকেলডাঙ্গার বাগানবাড়ীতে ‘জুলিয়াস সিজার’ এর পঞ্চম অঙ্ক অভিনীত হয় । তারপর ১৮৩৪ সালের ৭ মার্চ তারিখে হিন্দু কলেজের পুরষ্কার বিতরণী উৎসবে মধুসূদন দত্ত শেক্সপীয়রীয় পাঠ অভিনয়ে অংশ নিয়েছিল । ঐ অনুষ্ঠানে ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষাল ষষ্ঠ হেনরীর ভূমিকায় এবং মধুসূদন ডিউক অব গ্রসেস্টার এর ভূমিকায় অংশগ্রহন করেন ।
এর কিছুদিন পর ১৮৩৯ সালে জন্ম হয় ‘সাঁশুলী থিয়েটার’এর । এই সময়ে এই থিয়েটারের সাফল্য সমাধিক উল্লেখযোগ্য । ‘হ্যামলেট’, ‘ওথেলো’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘রোমিও এন্ড জুলিয়েট’, ‘জুলিয়াস সিজার’, ‘দি টেমিং অব দি শ্রু’ নাটকের অভিনয় ও মঞ্চসজ্জার দক্ষতা ‘সাঁওলী থিয়েটার’ কে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয় ।
এই খ্যাতির টান এত প্রবল ছিল যে, লন্ডনের বিখ্যাত অভিনেত্রী মিসেস ডীকন ও মিস ১৮৪১ কাউলে সাঁশুলী থিয়েটারে যোগদান করে । একই বছর অস্ট্রেলিয়ার জনপ্রিয় অভিনেত্রী মারিয়া মাদেলিন টেলর সিডনী থেকে পালিয়ে আসেন এই থিয়েটারে যোগ দেয়ার জন্য । এর দু’বছর পর লন্ডনের বিখ্যাত ভানিং পরিবারের জেমস ভানিং সাঁশুলী থিয়েটারে যোগ দেন । এই থিয়েটারের সাফল্য দিনে দিনে বেড়ে চলে । কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের ঐতিহাসিক সাফল্য আসে ১৮৪৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর শেক্সপীয়রের বিখ্যাত নাটক ‘ওথেলো’মঞ্চায়নের মধ্যে দিয়ে ।
এরপর ১৮৫২ সালে জোড়াসাঁকোর প্যারীমোহন বসুর বাড়ীতে ‘জুলিয়াস সিজার’ অভিনিত হয় । কলকাতা বাঙ্গালী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রতাপ খুব দ্রুত কমে যেতে থাকে এবং বাঙ্গালীদের শেক্সপীয়রের ধারা চলতে থাকে । এরপর উনবিংশ শতকের শেষ দিকে ইবসেনের বস্তববাদী নাট্য-আন্দোলনকে স্বাগত জানাবার জন্যে শেক্সপীয়রীয় নাট্য ধারাকে পেছনে ফেলে বাংলার মঞ্চকে এগিয়ে যেতে হয়েছে ক্রমবিবর্তনের ধারা অনুসরন করে ।
আধুনিক বাংলা নাটক
আধুনিক বাংলা নাটকের শুভারম্ভের ইতিহাস বেশ চমকপ্রদ একাধিক কারনে । প্রথমত শুভারম্ভ যার হাত দিয়ে হয় তিনি বাঙ্গালী নন, একজন বিদেশী – নাম হেরাসিন লেবেডেফ । জাতিতে রাশিয়ান । অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে পৃথিবীর অনেক দেশ পরিভ্রমন করে অবশেষে কলকাতায় এসে ব্যবসায়ভিত্তিক নাট্যশালা স্থাপনের সিব্ধান্ত নেন এবং ১৭৯৫ সালে ২৫ নং তৎকালীন ডোমতলীতে (বর্তমানে এজরা স্ট্রীট) বেঙ্গলী থিয়েটার নামে একটি নাট্যশালা স্থাপন করেন লেবেডেফ । পশ্চিমা রীতিতে সজ্জিত তাঁর এই নাট্যশালায় তিনি বাংলা ভাষায় লেখা নাটক বাংলা ভাষাভাষী অভিনেত্রা-অভিনেত্রীদের দিয়েই করানোর সিব্ধান্ত নেন । কিন্তু সেই সময় একেতো বাংলা নাটক ছিল না তার উপর মেয়েদের দিয়ে নাটক মঞ্চথ করাবার কথা কেউ চিন্তা করতে পারতো না ।
রুশ হেরাসিম লেবেডেফ তা সম্ভব করেছিলেন । অবশ্য তার আগেও মঞ্চাভিনয় হয়েছিল তবে সেটা সাহেব পাড়াতে । সেই নাটক দেখবার সুযোগ সাধারন বাঙালীর ভাঙ্গে জোটেনি । কিন্তু বাঙালীর এই মর্মবেদনাও ঘুচতে শুরু করলো সাত সমুদ্র তের নদী পার করে আসা হেরাসিম লেবেডেফ এর ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ এর দারোদঘাটনের মাধ্যমে । কিন্তু এতো করেও লেবেডেফ তাঁর এই ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ বাঁচিয়ে রাখতে পারেননি । কারন সাহেব-সুবোদের নাট্যশালার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নেটিভদের প্রয়োজনে আলাদা নাট্যশালা গড়ে উঠবে এটা কিছু কিছু ইংরেজ চাননি বিশষ করে যারা নাট্যশালার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ।
অবশেষে এদের সক্রিয় বিরোধীতার মোকাবিলা করতে না পেরেই লেবেডেফ ক্ষুব্ধচিত্তে ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ এর ইতি টেনে কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে বাব্ধ হন । বাঙ্গলী থিয়েটারের অকাল মৃত্যুর পর প্রায় তিন যুগেরও বেশী সময় বাংলা নাট্যমঞ্চ গড়ে উঠেনি । এর পরের যুগটাই ‘বাবু কালচার’ নামে পরিচিত । এই সময় বাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুর ১৮৩১ সালে বেলেঘাটার অন্তর্গত শুঁড়োর বাগানবাড়ীতে হিন্দু থিয়েটারের গোড়াপত্তন করেন । হিন্দু থিয়েটারের প্রথম নাটকের ভাষা ছিল ইংরেজী যদিও বিষয়বস্তু ছিল ভারতীয় উত্তর রামচরিত । কিন্তু এই নাট্যমঞ্চও দু’বছরের বেশী টিকে থাকেনি ।
কারন সেই সময় গোটা কলকাতায় ইংরেজী জানা লোকের সংখ্যা ছিল খুবই কম । এর ঠিক পরপরই ১৮৩৩ সালে আবির্ভূত হন নবীনচন্দ্র বসু তাঁর নিজ বাড়ীতে নাট্যশালা স্থাপনের মাধ্যমে । ১৮৩৫ সালের ৬ অক্টোবর এই নাট্যশালায় ‘বিদ্যাসুন্দর’ অভিনীত হয় অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে । এই নাটকের পাত্র-পাত্রী সবাই ছিলেন বাঙ্গালী ।
অর্কেস্ট্রায় ব্যবহৃত হয়েছিল দেশী বাদ্যযন্ত্র । কয়েক বছর নাট্য-প্রযোজনা করে নবীনচন্দ্র বসু লাখ লাখ টাকা গচ্চা দিয়েছিলেন । ফলে এই নাট্যশালাও বেশী দিন টিকে থাকেনি । এভাবে ১৭৯৫ থেকে উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ প্রযর্ন্ত প্রচুর সখের নাট্যভিনয় হত । পেশাদারী নাট্যমঞ্চ তখন গড়ে উঠেনি । অবশেষে বাংলা নাট্যমঞ্চের অন্যতম নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র ১৮৬০ ‘জমিদার দর্পন’ নাটকের মাধ্যমে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেন ।
এই নাটকের মহরার সময় নাট্য-প্রতিষ্ঠানের নাম দেয়া হয় ‘The Calcutta National Theater’ পরে মতিবাবুর প্রস্তাব অনুযায়ী ‘Calcutta’ টুকু বাদ দেওয়া হয় । ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৭২ সালে এবং এই বছরই এটি প্রথম মঞ্চথ হয় । আর এরই সঙ্গে বাংলা নাটকের বন্ধ্যাদশারও অবসান হয় । এই নাটকের সাফল্য শাসকগোষ্ঠীর টনক নাড়িয়ে দেয় । কারন, ‘নীলদর্পন’তৎকালীন বিদেশী নীলকরদের জুলুম ও লুন্ঠন এবং বাংলার নীলচাষীদের নির্মম-নিষ্ঠুর বঞ্চনা অ লাঞ্ছনার দর্পনই নয় বরং সর্বকালের সর্বযুগের শোষন আর শোষিতের দর্পন । এই সময় বাবু থিয়েটারের অবসান ঘটে ।
এই সময় সৌখিন নাট্যমঞ্চগুলোর অবসান ঘটতে থাকে এবং পেশাদারী থিয়েটার গড়ে ওঠে । ন্যাশনাল থিয়েটারের সঙ্গে গোড়া থেকেই যাঁরা সম্পৃক্ত ছিলেন তাঁরা হলেন পরবর্তীকালের বাংলা নাট্যমঞ্চের দিকপাল – গিরিশচন্দ্র ঘোষ, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফী, রামমাধব কর, নন্দলাল ঘোষ, বেলবাবু, অমৃতলাল বসু, মতিলাল সুর, তিনকড়ি মুখোপাধ্যায় প্রমুক । তাঁদের মধ্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষকে আধুনিক বাংলা নাটকের জনক বলা হয় । নাট্যজগতে তাঁর আগমন অভিনেতা হিসেবে । তারপর কখনো বা নাট্যশিক্ষক, কখনো নাট্যশালার ম্যানেজার, আবার কখনো নাট্য পরিচালক ।
সব শেষে তিনি নাট্যকার । তাঁর প্রথম জীবনের নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘রাবণ বধ’, ‘সীতার বনবাস’, ‘পান্ডবের অজ্ঞাতবাস’ এবং আর কিছু পৌরানিক নাটক শুধু ব্যবসাহিক সাফল্য নয়, যথেষ্ট গৌরবও বয়ে আনে । মূলত এই সময় থেকেই শুরু হয় গিরিশ যুগ তথা বাংলা নাটকের স্বর্ণযুগ ।প্রায় আশিটি নাটক রচনা, অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা এবং পরিচালনায় মুনশিয়ানার জন্যে তিনি নাট্যসম্রাট হওয়ার গৌরব অর্জন করেন ।
গিরিশচন্দ্রের পরই যাঁদের নাম শ্রব্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয় তাঁদের মধ্যে ক্ষীরদপ্রসাদ বিদ্যাবিনদ ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সবিশেষ উল্লেখযোগ্য । বাংলা নাটকের আরেকজন প্রানপুরুষ হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । তিনি একাধারে ছিলেন নাট্যকার, প্রযোজক, পরিচালক, সুরকার এবং অভিনেতা । তাঁর নাটকগুলো বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ সম্পদ ।
বাংলা নাটকের ইতিহাস বাংলা সাহিত্যের অগ্রগতি, রাজনৈতিক বিবর্তন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক উথান-পতনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত । রপথম বিশ্বযুব্ধের পর থেকেই ইউরোপীয় আধুনিক নাট্যধারার ঢেউ একটু একটু করে ভারতীয় মঞ্চে এসে লাগতে আরম্ভ করে । ফলে নাটকের পটভূমি রাতারাতি পাল্টে গেল ।
পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক এবং সাদামাটা ঘরকন্নার পটভূমি সরিয়ে দিয়ে সেখানে প্রবেশ করলো কলকারখানা, রাজনৈতিক সমাবেশ, উত্তেজিত শ্রমিক গোষ্ঠী, মাঠ-ময়দান এবং সামাজিক আস্তানা । নায়ক-নায়িকার প্রাধান্য ক্ষুন্ন করে জনগন এসে দাঁড়ালো- তথাকথিত নাটক হয়ে গেল গণ-নাট্য । এই পর্বে সবার্গ্রে স্মরণীয় ব্যাক্তি বিজন ভট্রাচায এবং সবর্শ্রেষ্ঠ অভিনেতা শম্ভু মিত্র ।
চল্লিশ থেকে আশি এই চল্লিশ বছরের মধ্যে ভারতীয় মঞ্চ বিশেষ করে বাংলা তথা কলকাতার মঞ্চে ব্যাপক আবর্তন-বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে । এসেছে মুক্তাঙ্গন অভিনয়, এসেছে থিয়েটার ইন সার্কেল, এসেছে মুক্তমঞ্চে End Stage ও Thrust Stage । কলকাতার নাট্য-প্রযোজকরা এখন Theater কে করে দিয়েছে Total Theater- দর্শক ও নাট্য-শিল্পীদের মধ্যে আর সামান্যতম ব্যবধান রাখতেও তাঁরা রাজী নন । নাটক এখন সত্যিকার অর্থে গণ-নাট্য।