বাঙালির ছবিচর্চার ইতিহাস

বাঙালির ছবিচর্চার ইতিহাস বহুদিনের এবং তা গর্বেরও, কিন্তু বাঙালী চিত্র-সমঝদারের ছবিটা বোধহয় আলাদা। হতাশায় ভরা এক আলোচনা কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত-র কলমে। ছবি দেখা নিছক কোনও নয়নসুখের বিষয় নয়। সুস্থ শরীর ও মন নিয়ে বেঁচে থাকতে গেলে মানুষ মাত্রেরই ছবি দেখার প্রয়োজন। ঠিক যেভাবে আমরা খাই, ঘুমোই, কাজ করি অথবা গান শুনি, নাটক দেখি, বেড়াতে যাই, ঠিক সেভাবেই ছবিও দেখা দরকার। দুঃখের বিষয় হল সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে চিত্রকলার দক্ষশিল্পীর অভাব না থাকলেও ছবির দর্শকের অভাব বড়ো প্রকট।

যে কারণে আমাদের চারপাশে আর্টগ্যালারি নেই, চিত্র-প্রদর্শনী নেই। যদি বা কায়ক্লেশে প্রদর্শনী হয়ও তাতে দর্শকের অনুপস্থিতি মনখারাপ করে দেয়। ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েরা ইদানিং ছবি আঁকা শিখছে, পাড়ার অলিতেগলিতে অসংখ্য আঁকার স্কুল, সিলেবাসে ড্রয়িং এখন রীতিমতো একটা সাবজেক্ট। তা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ ছবি সম্পর্কে অচেতন হয়ে দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন। যিনি যেখানেই বাস করুন না কেন, তিনি সেখানকার কোনও ভালো চিত্রশিল্পীর নাম জানেন না।

যদি বা জানেন তো তাঁর আঁকা ছবি যে তিনি দেখেননি একথা হলফ করে বলা যায়। এসব দেখেশুনে আমরা যারা ছবি ভালোবাসি তাদের মনে একটা নৈরাশ্যের ভাব জাগে। অথচ বাঙালির চিত্রচর্চার ধারাটি তো কম প্রাচীন নয়। বাঙালি শিল্পীদের ছবি আঁকার পরম্পরা বহুদিনের পুরোনো। পালযুগের পুঁথিচিত্রগুলি দেখলে আজও আমাদের চমক লাগে। তার মানে অন্তত এক হাজার বছরের বেশি সময়কাল ধরে আমরা রং-রেখার জাদুতে অভ্যস্ত ও আমোদিত।

বাঙালির চিত্রশিল্পের ইতিহাস যেমন বৈচিত্র্যপূর্ণ, তেমনই উৎকৃষ্ট। বাংলার এ ভূখণ্ডে জন্ম নিয়েছেন একশোরও বেশি সংখ্যক আন্তর্জাতিক মানের চিত্রশিল্পী। সারা পৃথিবীর নামীদামি সংগ্রহশালায় বাঙালির আঁকা ছবি যত্ন ও মর্যাদার সঙ্গে রক্ষিত। পাল যুগের অজ্ঞাত পরিচয় শিল্পী থেকে শুরু করে হাল আমলের গণেশ পাইন পর্যন্ত সবাই বিশ্বের দরবারে অত্যন্ত সম্মানিত। তবু সাধারণ বাঙালি কিছুতেই ছবির দিকে তাকাবেন না, চিত্রকলার জন্য গর্ববোধ করবেন না। এ এক আশ্চর্য দুর্বোধ্য পরিস্থিতি।

তবে একেবারে গ্রামীণ যাঁরা, তাঁদের ক্ষেত্রে কিন্তু এই সমস্যাটা অনেক কম। তাঁরা হাল আমলের বিশ্বচিত্রকলার খবর না রাখলেও ছবি সম্পর্কে তাঁদের আড়ষ্টতা শহরের মানুষের মতো ততটা প্রকট নয়। তার কারণ গ্রামের মানুষেরা তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে শিল্পকে মিশিয়ে নিয়েছেন। এবিষয়ে তাঁদের ঐতিহ্য সুদীর্ঘকালের। শাড়ির পাড়ের নকশা বোনাই হোক অথবা ঘরের মেঝেতে খড়িমাটির আলপনা — সবকিছুতেই চিত্রকলার প্রকাশকে গ্রামের মানুষ অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেন। শহুরে শিক্ষিতজনের জীবনে ছবি বলে কিছু নেই। ইদানিং স্কুলগুলোতে ড্রয়িং-সিলেবাসের নামে যে জিনিসটি গেলানো হয় সেটি হল, খাবার খেতে না শিখিয়ে রান্না করা শেখানো।



পরিণামে ছেলেমেয়েরা কয়েকটা বছর ধরে কোনও রকমে আম-কলা-লেবু ও মার্কামারা কতকগুলো সিনারি (ল্যান্ডস্কেপ) আঁকতে শিখে বাবা-মা ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উদ্ধার করে দেয়। আর মনের ভেতরে চিত্রকলা সম্পর্কে সীমাহীন অবজ্ঞা ও বিরক্তি পোষণ করে উঁচু ক্লাশের দিকে এগিয়ে যায়। অথচ জোর করে ছবি আঁকা না শিখিয়ে তাদের সবাইকে যদি ছবির ইতিহাস, শিল্পীদের গল্প বলার পাশাপাশি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছবিগুলি দেখানো যেত তাহলে সবদিক থেকেই অনেক ভালো ফল হত।

সেই সুযোগে অভিভাবক-অভিভাবিকারাও জেনে নিতে পারতেন ছবির মধ্যে লুকিয়ে থাকা আনন্দজগতের কথা। এইভাবে চিত্রচর্চার সুফল কতটা ফলতে পারে তার উদাহরণ হিসেবে ছোট্ট একটা গল্প বলি। খুব উন্নত কোনও দেশের কথা নয়, নেদারল্যান্ডের কথা। সেখানকার আমস্টারডাম এয়ারপোর্ট থেকে এক বাঙালি ভদ্রলোক যাবেন হোটেলে। মাত্র একদিনের জন্যই তাঁর যাওয়া, পরদিনই তাঁকে চলে যেতে হবে অন্যত্র। ট্যাক্সিতে উঠেছেন তিনি। যিনি গাড়ি চালাচ্ছেন তিনি একটু মিশুকে প্রকৃতির।

ভিনদেশি লোক প্রথমবার তাদের শহরে এসেছে দেখে তিনি খুব উৎসাহের সঙ্গে যাত্রীটিকে ভাঙাভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন — ‘মশায় তো এই প্রথম এলেন আমস্টারডামে, তা ভ্যানগঘের মিউজিয়ামটা দেখতে যাবেন তো? আর কোথাও না যান এইটা কিন্তু মিস্ করবেন না।’ পরে জানা গেল এই ট্যাক্সি ড্রাইভারটি কিন্তু কস্মিনকালেও ছবি আঁকা শেখেনি অথবা তাঁর বাড়িতেও কোনও শিল্পী-সদস্য নেই। তবু তিনি তাঁর দেশের মহান শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের জন্য গর্বিত।

এখন কথা হল, কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে কোনও ডাচ্ ভদ্রলোক একদিনের জন্য বেড়াতে এলে আমাদের কোনও বাঙালি ট্যাক্সিচালক কি তাকে বলবেন — ‘মশায় তো প্রথম এলেন কলকাতায়। তা আপনি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ছবিগুলো আগামীকাল দেখতে যাবেন তো?’ ট্যাক্সিচালক তো দূরের কথা, কলকাতা তথা বাংলার কটা মানুষ জানেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ভেতরের চিত্রশালার খবর? কজন বাঙালি গর্বিত এদেশের চিত্রশিল্পীদের জন্য? আমরা জানি আমাদের কোনও আদমসুমারিতেই ধরা পড়বে না সেই সংখ্যাটির কথা।
Next Post Previous Post
1 Comments
  • Leif Hagen
    Leif Hagen ২১ মে, ২০১১ এ ৬:০৩ PM

    Namaste! Congratulations to her! You have had many important women leaders in India!

Add Comment
comment url