শুভ মহা ষষ্ঠী - দেবীবোধন দিয়ে শুরু দুর্গোৎসব
আমরা সারা বছর ব্যাকুল অপেক্ষায় বসে থাকি কখন, শহরের মাটির পুতুলের গ্রাম-কুমারটুলি, পটুয়াপাড়ার সেই পছন্দ করা মাটির মূর্তিরা আমাদের পাড়ার প্যান্ডেলে আসবে।
ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু, ক্ষীরোদসাগরের তীরে মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মান করেছিলেন, বাঙালি পন্ডিত ভবদেব ভট্টও বিধান দিয়েছিলেন মাটির দুর্গামূর্তির পুজোর। আবার দেবী মৃন্ময়ীর স্বপ্নাদেশেই তো বাংলার প্রাচীন দুর্গাপুজো, বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের মল্লরাজবংশের কুলদেবীকে গঙ্গামাটি দিয়ে নির্মাণ করা হয়।
দেবী মহাস্নানে ব্যবহার করেন বৃষশৃঙ্গমৃত্তিকা, গজদন্তমৃত্তিকা, নদীতীরের, রাজদ্বারের, চৌমাথার, বেশ্যাদ্বারের মাটি, সর্বতীর্থের ভূমি। মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যায় দেবী দুর্গার অকালবোধনে আমরা চাষাবাদের উর্বর জমিই যেন গায়ে দি।
মেটে রঙের খাদির উপর কাঁথা কাজের শাড়ি পরে, শিশিরভেজা সোঁদামাটির গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠি। বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটির গনেশ গলায় ঝুলিয়ে আমরা গনেশজননীর উদ্দেশে বলে উঠি- জাগো যোগমায়া, জাগো মৃন্ময়ী, চিন্ময়ী রূপে তুমি জাগো...
নবরাত্রি ও দূর্গা পূজা উৎসব আমরা পর পর পালন করে থাকি| দুর্গাপূজা নবরাত্রির ষষ্ঠ দিনে শুরু হয় এবং এই দিনটিকে দুর্গা ষষ্ঠী বা মহাষষ্ঠী বলা হয়| এই দিনে দেবী দুর্গা কৈলাশের যাত্রা শেষ করে মর্তে আগমন করেন| ষষ্ঠী পূজার কিছু আকর্ষণীয় ধর্মীয় আচার রয়েছে|অনেক নারী দুর্গা ষষ্ঠীর দিনে একটি বিশেষ পূজা করে থাকেন|
ষষ্ঠী হল কোনো চান্দ্র মাসের ষষ্ঠ দিন|এই দিন বংশধরদের কল্যাণে কামনায় নিবেদিত করা হয়|মায়েরা দুর্গা পূজার সময় তাদের সন্তানদের জন্য ষষ্ঠী পুজো করে থাকেন| যদিও ষষ্ঠী প্রতি মাসে একবার আসে, তবুও কোনো কোনো ষষ্ঠী বেশ গুরুত্বপূর্ণ| উদাহরণস্বরূপ, নীল ষষ্ঠীর দিনে সন্তানের কল্যাণের জন্য শিব ঠাকুর কে পুজো করা হয়ে থাকে| জামাই ষষ্ঠী জামাতার কল্যাণে নিবেদিত|
একইভাবে,দূর্গা ষষ্ঠী মায়েদের কাছে একটি বিশেষ দিন যেদিন তারা সন্তানের কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করে থাকেন| দেবী দুর্গাকে যেহেতু মহাবিশ্বের মাতা বলে ধারণা করা হয়, তাই দূর্গা ষষ্ঠী মায়েদের জন্য একটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে|এই দিনে, মায়েরা উপোষ করেন বা নির্দিষ্ট সীমিত খাবার খেয়ে থাকেন| তারা 'অঞ্জলি' দিয়ে থাকেন এবং তাদের সন্তানের সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করে থাকেন|
দিন শুরু হয় দেবীর মুখ উন্মোচন করে|তারপর দুর্গাপূজার বোধন প্রক্রিয়া শুরু হয়|এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে দুর্গাপূজা পূর্ণ আড়ম্বর ও জাঁকজমকের সঙ্গে শুরু হয়| মহিলারা যাদের সন্তান আছে উপোষ করে থাকেন এবং পরে নতুন শাড়ী পরে 'অঞ্জলি' দিয়ে থাকেন|এই বিশেষ দিনে আমিষ খাদ্য ও চাল খাওয়া থেকে তারা বিরত থাকেন।
দেবী দুর্গা শ্বশুরবাড়ি কৈলাস থেকে কন্যারূপে মর্ত্যলোকে আসছেন বাপের বাড়ি বেড়াতে। সঙ্গে আসছেন জ্ঞানের প্রতীক দেবী সরস্বতী; ধন, ঐশ্বর্যের প্রতীক দেবী লক্ষ্মী, সিদ্ধিদাতা গণেশ এবং বলবীর্য ও পৌরুষের প্রতীক কার্তিক। এঁরা মায়ের চার সন্তান। দেবী মেনকার তাই ফুরসত ফেলার সময় নেই। বছর বাদে মেয়ে আসছেন বাপের বাড়ি, মেয়েকে বরণ করতে তাই তাঁর এত আয়োজন।
ওদিকে দেবী দুর্গাকে বরণ করতে ভক্তরাও সমানভাবে উদগ্রীব। তাদের আয়োজনও কম নয়। ঘরের বউ-ঝিরা কেউ খই-গুড়ে পাক দিচ্ছেন, কেউ বানাচ্ছেন নারিকেলের নাড়ু, মুড়ির মোয়া। স্কুল বন্ধ। পূজার ছুটি। নতুন জামা-কাপড়। ছোটদের আনন্দ আরো বেশি। ওদিকে পালমশায় ব্যস্ত প্রতিমা গড়া নিয়ে। মায়ের চোখে সন্তানের জন্য স্নেহ, মুখে মমতাময়ী হাসি_এসব ফুটিয়ে তোলা তো আর চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। পুরোহিত ব্যস্ত পূজার আয়োজন নিয়ে। মেনকার মতো সব দিকেই তাঁর দৃষ্টি। কারণ তিনি যে দুর্গতিনাশিনী, জগজ্জননী।
দশমীর মাধ্যমে দেবী পিতৃগৃহ থেকে কৈলাসে ফিরে যাবেন স্বামী শিবের কাছে। বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই সত্যকে অবলম্বন করেই গড়ে উঠেছে শারদীয় দুর্গোৎসব।
কবি কৃত্তিবাস পনেরো শতকের মাঝামাঝি তদানীন্তন গৌরেশ্বর রাজা গণেশের অনুরোধে বাংলা-রামায়ণ রচনা করেন। সেখানে শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক দুর্গাপূজার কথা উল্লেখ রয়েছে। পিতা দশরথের কথা রক্ষায় শ্রীরামচন্দ্র স্ত্রী সীতা এবং অনুগত ছোট ভাই লক্ষ্মণকে নিয়ে বনবাসের উদ্দেশে পঞ্চবটী বনে এলে রাবণ সীতাকে হরণ করে অশোক বনে আটকে রাখে। শ্রীরামচন্দ্র স্বয়ং অবতার হয়েও রাবণকে বধ করে সীতা উদ্ধারে দেবী দুর্গার পূজা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব আয়োজন সম্পন্ন করে পূজা করতে বসে রামচন্দ্র অঞ্জলি দেওয়ার সময় ১০৮টি নীলপদ্মের জায়গায় ১০৭টি নীলপদ্ম পান। অথচ ওই একটি নীলপদ্ম না হলে যে পূজা সম্পূর্ণ হবে না! এখন উপায়? তখন রামচন্দ্র ধনুর্বাণ দিয়ে নিজের চোখ উৎপাটনে উদ্যত হন। যাতে হারিয়ে যাওয়া সেই একটি নীলপদ্মের বদলে চোখ দিয়ে মায়ের পূজায় অঞ্জলি দেওয়া যায়।
কারণ রামের আরেক নাম ছিল পদ্মলোচন। রামচন্দ্রের ভক্তি দেখে দেবী দুর্গা অভিভূত হন। তিনি তখন সহাস্যে স্বরূপে আবির্ভূত হয়ে রামচন্দ্রকে চোখ উৎপাটনে বাধা দিয়ে সেই নীলপদ্মটি ফিরিয়ে দেন। কেননা ভক্তের ভক্তি পরীক্ষা করতে ওই নীলপদ্মটি ছলনা করে মা নিজেই লুকিয়ে রেখেছিলেন। দেবী দুর্গার আশীর্বাদে রামচন্দ্র পরবর্তী সময়ে রাবণকে পরাজিত করে সীতাকে উদ্ধার করেন। এর পর থেকেই শরৎকালে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে।
আদিতে বসন্তকালেই দুর্গাপূজা হতো। পুরাণ অনুসারে সত্য যুগে রাজা সুরথ রাজ্যচ্যুত হয়ে বনে আশ্রয় নেন। এই মহাসংকট থেকে উদ্ধার পেতে সত্যদ্রষ্টা মেধস মুনি রাজা সুরথকে দুর্গাপূজার পরামর্শ দেন। তখন তিনি ভক্তি সহকারে দুর্গাপূজার উদ্যোগ নেন। এ পূজা বসন্তে হয় বলে একে বাসন্তী পূজা বলা হয়।
পূজা যে সময়ই হোক না কেন উদ্দেশ্য কিন্তু এক। সনাতন ধর্মের প্রাচীন আর্য ঋষিরা সর্বশক্তিমান পরমেশ্বরের প্রতীক হিসেবে দেবী দুর্গার প্রসন্নতা ও আশীর্বাদ লাভের জন্য আরাধনা করতেন। এ যুগেও সনাতন ধর্মাবলম্বী ভক্তরা হৃদয়ের অর্ঘ্য সাজিয়ে আনন্দময়ী দুর্গার অর্চনা করেন। কারণ তিনি সর্বশক্তির আধার। মাতৃরূপে তিনি সর্বজীবে বিরাজ করে জীবের দুর্গতি নাশ করেন বলেই তাঁর নাম দুর্গা। শত্রু নাশে এ কারণেই তাঁর ১০ হাতে ৯ অথবা ১০ রকম অস্ত্র শোভা পায়। ডান হাতে ত্রিশূল, খৰ ও চক্র। বাম হাতে শঙ্খ, ঢাল, কুঠার, ঘণ্টা।
এর প্রতীকী তাৎপর্য আছে বৈকি! সত্য প্রতিষ্ঠা, ভক্তের দুর্দশা লাঘবে শত্রুকে তিনি ছাড় দিতে রাজি নন। সব শক্তি একত্রিত করে তিনি সমূলে শত্রু নাশ করতে চান। দুর্গাপূজা এক অর্থে তাই মহাশক্তির প্রতীকী রূপও বটে। পৃথিবীতে অন্যায়-অত্যাচারী, পাপিষ্ঠদের রুখে দিয়ে শোষকের হাত থেকে শোষিতদের উদ্ধার করতে, সত্যকে স্বরূপে প্রতিষ্ঠা করতে আজ এই মহাশক্তির আরাধনা বড় বেশি প্রয়োজন।
ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু, ক্ষীরোদসাগরের তীরে মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মান করেছিলেন, বাঙালি পন্ডিত ভবদেব ভট্টও বিধান দিয়েছিলেন মাটির দুর্গামূর্তির পুজোর। আবার দেবী মৃন্ময়ীর স্বপ্নাদেশেই তো বাংলার প্রাচীন দুর্গাপুজো, বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের মল্লরাজবংশের কুলদেবীকে গঙ্গামাটি দিয়ে নির্মাণ করা হয়।
দেবী মহাস্নানে ব্যবহার করেন বৃষশৃঙ্গমৃত্তিকা, গজদন্তমৃত্তিকা, নদীতীরের, রাজদ্বারের, চৌমাথার, বেশ্যাদ্বারের মাটি, সর্বতীর্থের ভূমি। মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যায় দেবী দুর্গার অকালবোধনে আমরা চাষাবাদের উর্বর জমিই যেন গায়ে দি।
মেটে রঙের খাদির উপর কাঁথা কাজের শাড়ি পরে, শিশিরভেজা সোঁদামাটির গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠি। বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটির গনেশ গলায় ঝুলিয়ে আমরা গনেশজননীর উদ্দেশে বলে উঠি- জাগো যোগমায়া, জাগো মৃন্ময়ী, চিন্ময়ী রূপে তুমি জাগো...
নবরাত্রি ও দূর্গা পূজা উৎসব আমরা পর পর পালন করে থাকি| দুর্গাপূজা নবরাত্রির ষষ্ঠ দিনে শুরু হয় এবং এই দিনটিকে দুর্গা ষষ্ঠী বা মহাষষ্ঠী বলা হয়| এই দিনে দেবী দুর্গা কৈলাশের যাত্রা শেষ করে মর্তে আগমন করেন| ষষ্ঠী পূজার কিছু আকর্ষণীয় ধর্মীয় আচার রয়েছে|অনেক নারী দুর্গা ষষ্ঠীর দিনে একটি বিশেষ পূজা করে থাকেন|
ষষ্ঠী হল কোনো চান্দ্র মাসের ষষ্ঠ দিন|এই দিন বংশধরদের কল্যাণে কামনায় নিবেদিত করা হয়|মায়েরা দুর্গা পূজার সময় তাদের সন্তানদের জন্য ষষ্ঠী পুজো করে থাকেন| যদিও ষষ্ঠী প্রতি মাসে একবার আসে, তবুও কোনো কোনো ষষ্ঠী বেশ গুরুত্বপূর্ণ| উদাহরণস্বরূপ, নীল ষষ্ঠীর দিনে সন্তানের কল্যাণের জন্য শিব ঠাকুর কে পুজো করা হয়ে থাকে| জামাই ষষ্ঠী জামাতার কল্যাণে নিবেদিত|
একইভাবে,দূর্গা ষষ্ঠী মায়েদের কাছে একটি বিশেষ দিন যেদিন তারা সন্তানের কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করে থাকেন| দেবী দুর্গাকে যেহেতু মহাবিশ্বের মাতা বলে ধারণা করা হয়, তাই দূর্গা ষষ্ঠী মায়েদের জন্য একটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে|এই দিনে, মায়েরা উপোষ করেন বা নির্দিষ্ট সীমিত খাবার খেয়ে থাকেন| তারা 'অঞ্জলি' দিয়ে থাকেন এবং তাদের সন্তানের সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করে থাকেন|
দিন শুরু হয় দেবীর মুখ উন্মোচন করে|তারপর দুর্গাপূজার বোধন প্রক্রিয়া শুরু হয়|এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে দুর্গাপূজা পূর্ণ আড়ম্বর ও জাঁকজমকের সঙ্গে শুরু হয়| মহিলারা যাদের সন্তান আছে উপোষ করে থাকেন এবং পরে নতুন শাড়ী পরে 'অঞ্জলি' দিয়ে থাকেন|এই বিশেষ দিনে আমিষ খাদ্য ও চাল খাওয়া থেকে তারা বিরত থাকেন।
দেবী দুর্গা শ্বশুরবাড়ি কৈলাস থেকে কন্যারূপে মর্ত্যলোকে আসছেন বাপের বাড়ি বেড়াতে। সঙ্গে আসছেন জ্ঞানের প্রতীক দেবী সরস্বতী; ধন, ঐশ্বর্যের প্রতীক দেবী লক্ষ্মী, সিদ্ধিদাতা গণেশ এবং বলবীর্য ও পৌরুষের প্রতীক কার্তিক। এঁরা মায়ের চার সন্তান। দেবী মেনকার তাই ফুরসত ফেলার সময় নেই। বছর বাদে মেয়ে আসছেন বাপের বাড়ি, মেয়েকে বরণ করতে তাই তাঁর এত আয়োজন।
ওদিকে দেবী দুর্গাকে বরণ করতে ভক্তরাও সমানভাবে উদগ্রীব। তাদের আয়োজনও কম নয়। ঘরের বউ-ঝিরা কেউ খই-গুড়ে পাক দিচ্ছেন, কেউ বানাচ্ছেন নারিকেলের নাড়ু, মুড়ির মোয়া। স্কুল বন্ধ। পূজার ছুটি। নতুন জামা-কাপড়। ছোটদের আনন্দ আরো বেশি। ওদিকে পালমশায় ব্যস্ত প্রতিমা গড়া নিয়ে। মায়ের চোখে সন্তানের জন্য স্নেহ, মুখে মমতাময়ী হাসি_এসব ফুটিয়ে তোলা তো আর চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। পুরোহিত ব্যস্ত পূজার আয়োজন নিয়ে। মেনকার মতো সব দিকেই তাঁর দৃষ্টি। কারণ তিনি যে দুর্গতিনাশিনী, জগজ্জননী।
দশমীর মাধ্যমে দেবী পিতৃগৃহ থেকে কৈলাসে ফিরে যাবেন স্বামী শিবের কাছে। বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই সত্যকে অবলম্বন করেই গড়ে উঠেছে শারদীয় দুর্গোৎসব।
কবি কৃত্তিবাস পনেরো শতকের মাঝামাঝি তদানীন্তন গৌরেশ্বর রাজা গণেশের অনুরোধে বাংলা-রামায়ণ রচনা করেন। সেখানে শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক দুর্গাপূজার কথা উল্লেখ রয়েছে। পিতা দশরথের কথা রক্ষায় শ্রীরামচন্দ্র স্ত্রী সীতা এবং অনুগত ছোট ভাই লক্ষ্মণকে নিয়ে বনবাসের উদ্দেশে পঞ্চবটী বনে এলে রাবণ সীতাকে হরণ করে অশোক বনে আটকে রাখে। শ্রীরামচন্দ্র স্বয়ং অবতার হয়েও রাবণকে বধ করে সীতা উদ্ধারে দেবী দুর্গার পূজা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব আয়োজন সম্পন্ন করে পূজা করতে বসে রামচন্দ্র অঞ্জলি দেওয়ার সময় ১০৮টি নীলপদ্মের জায়গায় ১০৭টি নীলপদ্ম পান। অথচ ওই একটি নীলপদ্ম না হলে যে পূজা সম্পূর্ণ হবে না! এখন উপায়? তখন রামচন্দ্র ধনুর্বাণ দিয়ে নিজের চোখ উৎপাটনে উদ্যত হন। যাতে হারিয়ে যাওয়া সেই একটি নীলপদ্মের বদলে চোখ দিয়ে মায়ের পূজায় অঞ্জলি দেওয়া যায়।
কারণ রামের আরেক নাম ছিল পদ্মলোচন। রামচন্দ্রের ভক্তি দেখে দেবী দুর্গা অভিভূত হন। তিনি তখন সহাস্যে স্বরূপে আবির্ভূত হয়ে রামচন্দ্রকে চোখ উৎপাটনে বাধা দিয়ে সেই নীলপদ্মটি ফিরিয়ে দেন। কেননা ভক্তের ভক্তি পরীক্ষা করতে ওই নীলপদ্মটি ছলনা করে মা নিজেই লুকিয়ে রেখেছিলেন। দেবী দুর্গার আশীর্বাদে রামচন্দ্র পরবর্তী সময়ে রাবণকে পরাজিত করে সীতাকে উদ্ধার করেন। এর পর থেকেই শরৎকালে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে।
আদিতে বসন্তকালেই দুর্গাপূজা হতো। পুরাণ অনুসারে সত্য যুগে রাজা সুরথ রাজ্যচ্যুত হয়ে বনে আশ্রয় নেন। এই মহাসংকট থেকে উদ্ধার পেতে সত্যদ্রষ্টা মেধস মুনি রাজা সুরথকে দুর্গাপূজার পরামর্শ দেন। তখন তিনি ভক্তি সহকারে দুর্গাপূজার উদ্যোগ নেন। এ পূজা বসন্তে হয় বলে একে বাসন্তী পূজা বলা হয়।
পূজা যে সময়ই হোক না কেন উদ্দেশ্য কিন্তু এক। সনাতন ধর্মের প্রাচীন আর্য ঋষিরা সর্বশক্তিমান পরমেশ্বরের প্রতীক হিসেবে দেবী দুর্গার প্রসন্নতা ও আশীর্বাদ লাভের জন্য আরাধনা করতেন। এ যুগেও সনাতন ধর্মাবলম্বী ভক্তরা হৃদয়ের অর্ঘ্য সাজিয়ে আনন্দময়ী দুর্গার অর্চনা করেন। কারণ তিনি সর্বশক্তির আধার। মাতৃরূপে তিনি সর্বজীবে বিরাজ করে জীবের দুর্গতি নাশ করেন বলেই তাঁর নাম দুর্গা। শত্রু নাশে এ কারণেই তাঁর ১০ হাতে ৯ অথবা ১০ রকম অস্ত্র শোভা পায়। ডান হাতে ত্রিশূল, খৰ ও চক্র। বাম হাতে শঙ্খ, ঢাল, কুঠার, ঘণ্টা।
এর প্রতীকী তাৎপর্য আছে বৈকি! সত্য প্রতিষ্ঠা, ভক্তের দুর্দশা লাঘবে শত্রুকে তিনি ছাড় দিতে রাজি নন। সব শক্তি একত্রিত করে তিনি সমূলে শত্রু নাশ করতে চান। দুর্গাপূজা এক অর্থে তাই মহাশক্তির প্রতীকী রূপও বটে। পৃথিবীতে অন্যায়-অত্যাচারী, পাপিষ্ঠদের রুখে দিয়ে শোষকের হাত থেকে শোষিতদের উদ্ধার করতে, সত্যকে স্বরূপে প্রতিষ্ঠা করতে আজ এই মহাশক্তির আরাধনা বড় বেশি প্রয়োজন।