দুর্গা মহা অষ্টমী পালিত হয় যে ভাবে
শারদীয় দুর্গাপূজার আজ মহাষ্টমী। মহাষ্টমীর মূল আকর্ষণ কুমারী পূজা ও সন্ধি পূজা পালন। গতকাল ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য, আনন্দ উদ্দীপনা ও জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়েছে মহাসপ্তমী। ভোরে নবপত্রিকা স্নান দিয়ে শুরু হয় শারদীয় দুর্গোৎসবের সপ্তমীর দিন। এরপর ছিল স্থাপন ও সপ্তাদি কল্পারম্ভ, ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার চক্ষুদান, চন্ডি ও মন্ত্র পাঠ, দেবীর পায়ে ভক্তদের পুস্পাঞ্জলী প্রদানসহ নানা আয়োজন।
মহাসপ্তমী শেষে শারদীয় দুর্গাপুজার সবচেয়ে আকর্ষনীয় এবং জাঁকজমকপূর্ণ দিন আজ। দেবীর সন্ধিপূজা আর কুমারী পূজার মধ্য দিয়ে পালান হবে দিনটি। কুমারী বালিকার মধ্যে শুদ্ধ নারীর রূপ চিন্তা করে তাকে দেবী জ্ঞানে পূজা করবেন ভক্তরা। শাস্ত্রে ১ থেকে ১৬ বছরের অজাতপুস্প সুলক্ষণা কুমারীকে পূজার উল্লেখ রয়েছে। ব্রাহ্মন অবিবাহিত কন্যা অথবা অন্য গোত্রের অবিবাহিত কন্যাকেও পূজা করার বিধান রয়েছে।
বাঙালির ঘরের মেয়ে উমা এসেছে বাপের বাড়িতে। তারই নাকি আবার পুজো। প্রকাণ্ড প্রতিমার সামনে বসেছে আমাদের ছোট্ট চিন্ময়ী দেবী, মহাশক্তি রূপে। গঙ্গাস্নানের পরে সে পরেছে রক্ত-লাল বেশ, চন্দন, কুমকুমে চর্চিত, পুষ্পে শোভিত, আলতা, সিন্দুরে অর্চিত সে। শুরু হয়েছে কুমারী পুজো। কুমারী রক্তবর্ণাভা শক্তিহস্তা ভয়ানকি” দেবীদুর্গা যেন রক্তজিহ্বা, রক্তচক্ষু দিয়ে রাঙিয়ে দিয়েছেন এই নিষ্পাপ শিশুকে, উদ্রেক করছেন ভয় এই রক্তাক্ত পৃথিবীতে।
কুমারীর কপালের বড় লাল টিপ সূচনা করছে জাগতিক মিলনের। গাঢ় পরিনয়ের আভা মিশেছে সিন্দুরের সঙ্গে, তারই রেশ টেনে তৈরি হয়েছে প্রতিস্তুতির রক্তিম মালা। একটা ছোট্ট মেয়ে উল-ফুলের মুকুট মাথায় পরে সূচনা করছে সৃষ্টির আর শুভ সঞ্চারের।
নবরাত্রির অষ্টম দিন বা ‘অষ্টমী’ হল দুর্গাপূজার পবিত্রতম দিন। আশ্বিন মাসের শুক্লাষ্টমী তিথির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দিনটিকে আমরা ‘দুর্গাষ্টমী’, ‘মহাষ্টমী’ বলে থাকি। আশ্বিন মাসের এই অষ্টমী তিথি হল অশুভ শক্তি বিনাশ করার জন্য শুভশক্তির আবির্ভাব তিথি। তাই দুর্গাপূজায় অষ্টমী দিনটির গুরুত্ব অসীম। সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থে তাই এই দিনটির মাহাত্ম্য সুবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে। মনে প্রশ্ন জাগে, কেন অষ্টমী দুর্গাপূজার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। তাই একে একে জেনে নেব মহাষ্টমীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে থাকা ঘটনাবলি। অষ্টমীতে অস্ত্র পূজা এই দিনে দেবী দুর্গার অস্ত্রসমূহকে দেবজ্ঞানে পূজা করা হয়। কারণ দেবতারা নানা অস্ত্র প্রদানের মাধ্যমে দেবীকে রণসাজে সাজিয়ে তুলেছিলেন এই মহাষ্টমী তিথিতেই। তাই দিনটিকে বীরাষ্টমী বলে থাকেন অনেকে। আবার ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই দিনকে বলা হয় ‘অস্ত্র পূজা’। অষ্টমীতে বিশেষ পূজা পান দেবী মহাগৌরী নবরাত্রির অষ্টম দিনে বা অষ্টমীতে পুজো করা হয় দেবী মহাগৌরীকে। পুরাণ থেকে জানা যায়, হিমালয়দুহিতা পার্বতী ছিলেন গৌরবর্ণা। কিন্তু শিবকে পতি হিসেবে পাওয়ার জন্য প্রখর রৌদ্রে তপস্যা করায় তিনি কৃষ্ণবর্ণা হয়ে গিয়েছিলেন। দেবাদিদেব মহাদেব তখন পার্বতীকে গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে দেওয়ার ফলে ফের গৌরবর্ণ ফিরে পেয়েছিলেন পার্বতী। তাই দেবী পার্বতীর এই রূপের নাম মহাগৌরী। শ্বেত বস্ত্রে সুশোভিতা দেবী মহাগৌরীর বাহন হল সাদা ষাঁড়। চতুর্ভুজা দেবীর এক হাত থাকে বরাভয় মুদ্রায়, বাকি তিন হাতে দেবী ধারণ করেন পদ্ম, ত্রিশূল ও ডম্বরু। নবরাত্রির অষ্টম রাতে দেবী মহাগৌরীর পূজা করলে সব পাপের স্খালন ঘটে। অষ্টমীতে অষ্ট-মাতৃকার আবির্ভাব দুর্গাডামর ও যোগিনীতন্ত্রে বলা বর্ণিত হয়েছে চৌষট্টি যোগিনীর কথা। এই যোগিনীরা মহাশক্তিরূপিণী মহাদেবীর অংশ। এই চৌষট্টি যোগিনী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরিচালনায় মহাশক্তিকে সাহায্য করেন। এই চৌষট্টি যোগিনীর আটজন করে একই দেহে সম্মিলিত হয়ে মহাষ্টমীর দিন আবির্ভূতা হয়েছিলেন আট জন ভয়ঙ্কর দেবী। অশুভ শক্তির বিনাশে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন দানবদলনী অষ্ট-মাতৃকা বা অষ্ট-শক্তি। এঁরা হলেন ব্ৰহ্মাণী, মাহেশ্বরী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, বরাহী, নরসিংহী, ইন্দ্রানী ও চামুণ্ডা। অশুভশক্তিকে বিনাশ করার পর যাঁরা বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন দেবীর দুর্গার অঙ্গে। তাই মহাষ্টমীর দিন পুজো করা হয় অসুরবিনাশিনী অষ্ট-মাতৃকাকেও। অষ্টমীতে কুমারী পূজা সনাতন হিন্দু দর্শন বলে, মহাবিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় নামক ত্রিবিধ শক্তি আবদ্ধ থাকে কুমারীর মধ্যে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দশম অনুবাকের ১২৫তম সূক্ত বা দেবী সূক্তে বলা হয়েছে, কুমারীর মাধ্যমেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হয়েছে বসুন্ধরার বুকে জন্ম নেওয়া সকল কুমারীই প্রকৃতিদেবীর অংশ। দেবী দুর্গা এই কুমারী রূপ ধারণ করেই অশুভ শক্তির প্রতীক কোলাসুরের বিনাশ করেছিলেন। তাই দেবী দুর্গার মধ্যে মিশে আছে তাঁর কুমারী রূপ। প্রাচীন যুগের বেদজ্ঞ ঋষিরা মর্ত্যে দেবী দুর্গার কুমারী রূপের আরাধনার প্রচলন করেছিলেন। কুমারী পূজার কুমারী হিসেবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কন্যাকেই নির্বাচন করেন দুর্গাপূজার আয়োজকেরা। কিন্তু দেবীপুরাণ, তন্ত্রসার, কুলার্ণব-তন্ত্র ও অনান্য শাস্ত্রে কুমারী পুজার ক্ষেত্রে কোন জাতি বা বর্ণভেদ করা হয়নি। যে কোনও জাত বা বর্ণের অরজঃস্বলা কুমারীকেই দেবীরূপে পূজা করা যেতে পারে। এমনকি পতিতা নারীর কন্যারও দেবী রূপে পূজিতা হতে বাধা নেই। অরজঃস্বলা বালিকাটিকে নববস্ত্র, ফুলের মালা, আলতা, সিঁদুর, তিলক ও মুকুট পরিয়ে মহাষ্টমীর দিন দেবী দুর্গা রূপে তন্ত্রমতে পূজা করা হয়। কুমারী পূজার কুমারীদের বয়স অনুসারে দেবী দুর্গার আলাদা আলাদা রূপ হিসেবে পূজা করা হয়। কুমারী পূজা করলে মহাফল লাভ করা যায়। ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের সামান্য কিছু অংশে আজও দুর্গাপূজার অঙ্গ হিসেবে কুমারী পূজা করার রীতি আছে। দুর্গা অষ্টমীতে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় পাঁচ বা সাত অবিবাহিত কন্যাকে ভোজন করানোর প্রথা আছে। বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে কুমারী কন্যাদের পা ধুইয়ে দেওয়া হয়। তাঁদের আরতি ও পূজা করা হয়। মিষ্টি, ফল ও উপহার দেওয়া হয়। মহাষ্টমীর অঞ্জলি অষ্টমীর ভোরটা যেন একেবারে অন্যরকম ভোর। খুব ভোরে উঠে, স্নান করে পরিষ্কার বা নতুন জামাকাপড় পরে, নির্দিষ্ট সময় মণ্ডপে উপস্থিত হন। অষ্টমী পুজোর শেষে শুরু হয় অঞ্জলি। বেশিরভাগ বাঙালি এই শুভক্ষণটার জন্য সারাবছর অপেক্ষা করে থাকেন। পুজোর তিনদিনই পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া গেলেও, দিনটির মাহাত্ম্যের কথা বিচার করে সবাই অষ্টমী তিথিতেই অঞ্জলি দিতে চান। এক সময় অপেক্ষার প্রহর সাঙ্গ হয়। পুরোহিত মশাই ভক্তদের মাথায় মন্ত্রপূত গঙ্গাজল ছিটিয়ে দেন। ভক্তদের হাতে ফুল ও বেলপাতা তুলে দেওয়ার পর, পুরোহিত যখন পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকেন তখন চরম নাস্তিক মানুষও ভাবাবেগে বিহ্বল হয়ে পড়েন। সনাতন ধর্ম বলে, অষ্টমীতে অঞ্জলি দিলে সর্বকর্মে সিদ্ধি লাভ হয়। সর্বপ্রকার বাধাবিঘ্ন দূর হয়। সন্তান ও অর্থ লাভ হয়। দুঃখ, শোক, রোগ দূরীভূত হয়। দারিদ্র নাশ ও শত্রু-ক্ষয় হয়। ভক্তরা গ্রহ-শান্তি লাভ করেন। অন্তরের পাশবিক কামনা বাসনা দূরীভূত হয়। এ বছর সকাল ১০টা ৫৮ মিনিট ৪১ সেকেন্ডের আগে অঞ্জলি সেরে ফেলতে হবে। কারণ এর পর সন্ধিপুজো শুরু হবে। অষ্টমীতে সন্ধিপূজার শুরু অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট এবং নবমী তিথি শুরুর প্রথম ২৪ মিনিটকে বলা হয় সন্ধিক্ষণ। এই সন্ধিক্ষণে বা ৪৮ মিনিটের মধ্যে তন্ত্রমতে করা হয় ‘সন্ধিপূজা’। তন্ত্রমতে সন্ধিপূজা করা হয় বলে স্মার্ত রঘুনন্দন তাঁর ‘দুর্গোৎসব তত্ত্ব’ গ্রন্থে সন্ধিপুজোর জন্য পৃথক সঙ্কল্পের কথা বলেছেন। তবে চান্দ্রমাস ক্যালেন্ডার অনুসারে মাহেন্দ্রক্ষণটি নির্ধারিত হয় বলে প্রতিবছরই সন্ধিক্ষণটি পরিবর্তিত হয়। সন্ধিপুজো আসলে অসুরনাশিনী দেবী দুর্গার আর এক অসুরদলনী রূপের পূজা। সেই দেবীর নাম ‘চামুণ্ডা’। পুরাণে বলে, মহাষ্টমীর দিনে দেবী চামুণ্ডা এই দিনে মা দুর্গার ললাট থেকে আবির্ভুতা হয়েছিলেন। অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে চণ্ড ও মুণ্ড নামে দুই অসুরকে নিধন করেছিলেন দেবী চামুণ্ডা। তাই অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে দেবী চামুণ্ডার পূজা করা হয়। এবছর সকাল ১০ টা ৫৮ মিনিট ৪১ সেকেন্ডে সন্ধিপুজো শুরু হবে। শেষ হবে সকাল ১১টা ৪৬ মিনিট ৪১ সেকেন্ডে। অষ্টমীতে ‘দুর্গাষ্টমী ব্রত’ পালন শাস্ত্র মতে প্রতি মাসের শুক্লাষ্টমী তিথিকে দুর্গাষ্টমী হিসাবে পালন করা হলেও, নবরাত্রির দুর্গাষ্টমীতে বিশেষ ভাবে এই ব্রত পালন করার প্রথা আছে ভারতের বিভিন্ন স্থানে। ‘দুর্গাষ্টমী ব্রত’ পালন করলে সর্বসংকট দূর হয়। ব্রতীরা খুব ভোরে উঠে স্নান সেরে নতুন পোশাক পরে ঠাকুরের আসন পরিষ্কার করে নেন। তারপর উপবাসরত অবস্থায় নৈবিদ্য সাজিয়ে এবং ধূপ ও প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবী দুর্গার উপাসনা করেন। উপরোক্ত কারণের জন্যেই দুর্গাপূজায় অষ্টমীর গুরুত্ব অসীম। তাই অষ্টমীর দিনটির আনুসঙ্গিক আচারগুলি নিষ্ঠাভরে পালন করেন বাঙালিরা। অনেক সাত্ত্বিক ভক্ত দিনটা নির্জলা উপবাসে কাটান। আবার বাংলার ঘরে ঘরে সেদিন নিরামিষ আহার বা ফলাহারের আয়োজন করা হয়। মধ্যাহ্নে ঘিয়ে ভাজা লুচি, ছোলার ডাল, বেগুনভাজা আর মিষ্টি ছাড়া অষ্টমী যেন কল্পনাতেই আনতে পারে না বাঙালি।
মহাসপ্তমী শেষে শারদীয় দুর্গাপুজার সবচেয়ে আকর্ষনীয় এবং জাঁকজমকপূর্ণ দিন আজ। দেবীর সন্ধিপূজা আর কুমারী পূজার মধ্য দিয়ে পালান হবে দিনটি। কুমারী বালিকার মধ্যে শুদ্ধ নারীর রূপ চিন্তা করে তাকে দেবী জ্ঞানে পূজা করবেন ভক্তরা। শাস্ত্রে ১ থেকে ১৬ বছরের অজাতপুস্প সুলক্ষণা কুমারীকে পূজার উল্লেখ রয়েছে। ব্রাহ্মন অবিবাহিত কন্যা অথবা অন্য গোত্রের অবিবাহিত কন্যাকেও পূজা করার বিধান রয়েছে।
বাঙালির ঘরের মেয়ে উমা এসেছে বাপের বাড়িতে। তারই নাকি আবার পুজো। প্রকাণ্ড প্রতিমার সামনে বসেছে আমাদের ছোট্ট চিন্ময়ী দেবী, মহাশক্তি রূপে। গঙ্গাস্নানের পরে সে পরেছে রক্ত-লাল বেশ, চন্দন, কুমকুমে চর্চিত, পুষ্পে শোভিত, আলতা, সিন্দুরে অর্চিত সে। শুরু হয়েছে কুমারী পুজো। কুমারী রক্তবর্ণাভা শক্তিহস্তা ভয়ানকি” দেবীদুর্গা যেন রক্তজিহ্বা, রক্তচক্ষু দিয়ে রাঙিয়ে দিয়েছেন এই নিষ্পাপ শিশুকে, উদ্রেক করছেন ভয় এই রক্তাক্ত পৃথিবীতে।
কুমারীর কপালের বড় লাল টিপ সূচনা করছে জাগতিক মিলনের। গাঢ় পরিনয়ের আভা মিশেছে সিন্দুরের সঙ্গে, তারই রেশ টেনে তৈরি হয়েছে প্রতিস্তুতির রক্তিম মালা। একটা ছোট্ট মেয়ে উল-ফুলের মুকুট মাথায় পরে সূচনা করছে সৃষ্টির আর শুভ সঞ্চারের।
নবরাত্রির অষ্টম দিন বা ‘অষ্টমী’ হল দুর্গাপূজার পবিত্রতম দিন। আশ্বিন মাসের শুক্লাষ্টমী তিথির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দিনটিকে আমরা ‘দুর্গাষ্টমী’, ‘মহাষ্টমী’ বলে থাকি। আশ্বিন মাসের এই অষ্টমী তিথি হল অশুভ শক্তি বিনাশ করার জন্য শুভশক্তির আবির্ভাব তিথি। তাই দুর্গাপূজায় অষ্টমী দিনটির গুরুত্ব অসীম। সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থে তাই এই দিনটির মাহাত্ম্য সুবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে। মনে প্রশ্ন জাগে, কেন অষ্টমী দুর্গাপূজার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। তাই একে একে জেনে নেব মহাষ্টমীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে থাকা ঘটনাবলি। অষ্টমীতে অস্ত্র পূজা এই দিনে দেবী দুর্গার অস্ত্রসমূহকে দেবজ্ঞানে পূজা করা হয়। কারণ দেবতারা নানা অস্ত্র প্রদানের মাধ্যমে দেবীকে রণসাজে সাজিয়ে তুলেছিলেন এই মহাষ্টমী তিথিতেই। তাই দিনটিকে বীরাষ্টমী বলে থাকেন অনেকে। আবার ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই দিনকে বলা হয় ‘অস্ত্র পূজা’। অষ্টমীতে বিশেষ পূজা পান দেবী মহাগৌরী নবরাত্রির অষ্টম দিনে বা অষ্টমীতে পুজো করা হয় দেবী মহাগৌরীকে। পুরাণ থেকে জানা যায়, হিমালয়দুহিতা পার্বতী ছিলেন গৌরবর্ণা। কিন্তু শিবকে পতি হিসেবে পাওয়ার জন্য প্রখর রৌদ্রে তপস্যা করায় তিনি কৃষ্ণবর্ণা হয়ে গিয়েছিলেন। দেবাদিদেব মহাদেব তখন পার্বতীকে গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে দেওয়ার ফলে ফের গৌরবর্ণ ফিরে পেয়েছিলেন পার্বতী। তাই দেবী পার্বতীর এই রূপের নাম মহাগৌরী। শ্বেত বস্ত্রে সুশোভিতা দেবী মহাগৌরীর বাহন হল সাদা ষাঁড়। চতুর্ভুজা দেবীর এক হাত থাকে বরাভয় মুদ্রায়, বাকি তিন হাতে দেবী ধারণ করেন পদ্ম, ত্রিশূল ও ডম্বরু। নবরাত্রির অষ্টম রাতে দেবী মহাগৌরীর পূজা করলে সব পাপের স্খালন ঘটে। অষ্টমীতে অষ্ট-মাতৃকার আবির্ভাব দুর্গাডামর ও যোগিনীতন্ত্রে বলা বর্ণিত হয়েছে চৌষট্টি যোগিনীর কথা। এই যোগিনীরা মহাশক্তিরূপিণী মহাদেবীর অংশ। এই চৌষট্টি যোগিনী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরিচালনায় মহাশক্তিকে সাহায্য করেন। এই চৌষট্টি যোগিনীর আটজন করে একই দেহে সম্মিলিত হয়ে মহাষ্টমীর দিন আবির্ভূতা হয়েছিলেন আট জন ভয়ঙ্কর দেবী। অশুভ শক্তির বিনাশে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন দানবদলনী অষ্ট-মাতৃকা বা অষ্ট-শক্তি। এঁরা হলেন ব্ৰহ্মাণী, মাহেশ্বরী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, বরাহী, নরসিংহী, ইন্দ্রানী ও চামুণ্ডা। অশুভশক্তিকে বিনাশ করার পর যাঁরা বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন দেবীর দুর্গার অঙ্গে। তাই মহাষ্টমীর দিন পুজো করা হয় অসুরবিনাশিনী অষ্ট-মাতৃকাকেও। অষ্টমীতে কুমারী পূজা সনাতন হিন্দু দর্শন বলে, মহাবিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় নামক ত্রিবিধ শক্তি আবদ্ধ থাকে কুমারীর মধ্যে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দশম অনুবাকের ১২৫তম সূক্ত বা দেবী সূক্তে বলা হয়েছে, কুমারীর মাধ্যমেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হয়েছে বসুন্ধরার বুকে জন্ম নেওয়া সকল কুমারীই প্রকৃতিদেবীর অংশ। দেবী দুর্গা এই কুমারী রূপ ধারণ করেই অশুভ শক্তির প্রতীক কোলাসুরের বিনাশ করেছিলেন। তাই দেবী দুর্গার মধ্যে মিশে আছে তাঁর কুমারী রূপ। প্রাচীন যুগের বেদজ্ঞ ঋষিরা মর্ত্যে দেবী দুর্গার কুমারী রূপের আরাধনার প্রচলন করেছিলেন। কুমারী পূজার কুমারী হিসেবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কন্যাকেই নির্বাচন করেন দুর্গাপূজার আয়োজকেরা। কিন্তু দেবীপুরাণ, তন্ত্রসার, কুলার্ণব-তন্ত্র ও অনান্য শাস্ত্রে কুমারী পুজার ক্ষেত্রে কোন জাতি বা বর্ণভেদ করা হয়নি। যে কোনও জাত বা বর্ণের অরজঃস্বলা কুমারীকেই দেবীরূপে পূজা করা যেতে পারে। এমনকি পতিতা নারীর কন্যারও দেবী রূপে পূজিতা হতে বাধা নেই। অরজঃস্বলা বালিকাটিকে নববস্ত্র, ফুলের মালা, আলতা, সিঁদুর, তিলক ও মুকুট পরিয়ে মহাষ্টমীর দিন দেবী দুর্গা রূপে তন্ত্রমতে পূজা করা হয়। কুমারী পূজার কুমারীদের বয়স অনুসারে দেবী দুর্গার আলাদা আলাদা রূপ হিসেবে পূজা করা হয়। কুমারী পূজা করলে মহাফল লাভ করা যায়। ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের সামান্য কিছু অংশে আজও দুর্গাপূজার অঙ্গ হিসেবে কুমারী পূজা করার রীতি আছে। দুর্গা অষ্টমীতে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় পাঁচ বা সাত অবিবাহিত কন্যাকে ভোজন করানোর প্রথা আছে। বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে কুমারী কন্যাদের পা ধুইয়ে দেওয়া হয়। তাঁদের আরতি ও পূজা করা হয়। মিষ্টি, ফল ও উপহার দেওয়া হয়। মহাষ্টমীর অঞ্জলি অষ্টমীর ভোরটা যেন একেবারে অন্যরকম ভোর। খুব ভোরে উঠে, স্নান করে পরিষ্কার বা নতুন জামাকাপড় পরে, নির্দিষ্ট সময় মণ্ডপে উপস্থিত হন। অষ্টমী পুজোর শেষে শুরু হয় অঞ্জলি। বেশিরভাগ বাঙালি এই শুভক্ষণটার জন্য সারাবছর অপেক্ষা করে থাকেন। পুজোর তিনদিনই পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া গেলেও, দিনটির মাহাত্ম্যের কথা বিচার করে সবাই অষ্টমী তিথিতেই অঞ্জলি দিতে চান। এক সময় অপেক্ষার প্রহর সাঙ্গ হয়। পুরোহিত মশাই ভক্তদের মাথায় মন্ত্রপূত গঙ্গাজল ছিটিয়ে দেন। ভক্তদের হাতে ফুল ও বেলপাতা তুলে দেওয়ার পর, পুরোহিত যখন পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকেন তখন চরম নাস্তিক মানুষও ভাবাবেগে বিহ্বল হয়ে পড়েন। সনাতন ধর্ম বলে, অষ্টমীতে অঞ্জলি দিলে সর্বকর্মে সিদ্ধি লাভ হয়। সর্বপ্রকার বাধাবিঘ্ন দূর হয়। সন্তান ও অর্থ লাভ হয়। দুঃখ, শোক, রোগ দূরীভূত হয়। দারিদ্র নাশ ও শত্রু-ক্ষয় হয়। ভক্তরা গ্রহ-শান্তি লাভ করেন। অন্তরের পাশবিক কামনা বাসনা দূরীভূত হয়। এ বছর সকাল ১০টা ৫৮ মিনিট ৪১ সেকেন্ডের আগে অঞ্জলি সেরে ফেলতে হবে। কারণ এর পর সন্ধিপুজো শুরু হবে। অষ্টমীতে সন্ধিপূজার শুরু অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট এবং নবমী তিথি শুরুর প্রথম ২৪ মিনিটকে বলা হয় সন্ধিক্ষণ। এই সন্ধিক্ষণে বা ৪৮ মিনিটের মধ্যে তন্ত্রমতে করা হয় ‘সন্ধিপূজা’। তন্ত্রমতে সন্ধিপূজা করা হয় বলে স্মার্ত রঘুনন্দন তাঁর ‘দুর্গোৎসব তত্ত্ব’ গ্রন্থে সন্ধিপুজোর জন্য পৃথক সঙ্কল্পের কথা বলেছেন। তবে চান্দ্রমাস ক্যালেন্ডার অনুসারে মাহেন্দ্রক্ষণটি নির্ধারিত হয় বলে প্রতিবছরই সন্ধিক্ষণটি পরিবর্তিত হয়। সন্ধিপুজো আসলে অসুরনাশিনী দেবী দুর্গার আর এক অসুরদলনী রূপের পূজা। সেই দেবীর নাম ‘চামুণ্ডা’। পুরাণে বলে, মহাষ্টমীর দিনে দেবী চামুণ্ডা এই দিনে মা দুর্গার ললাট থেকে আবির্ভুতা হয়েছিলেন। অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে চণ্ড ও মুণ্ড নামে দুই অসুরকে নিধন করেছিলেন দেবী চামুণ্ডা। তাই অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে দেবী চামুণ্ডার পূজা করা হয়। এবছর সকাল ১০ টা ৫৮ মিনিট ৪১ সেকেন্ডে সন্ধিপুজো শুরু হবে। শেষ হবে সকাল ১১টা ৪৬ মিনিট ৪১ সেকেন্ডে। অষ্টমীতে ‘দুর্গাষ্টমী ব্রত’ পালন শাস্ত্র মতে প্রতি মাসের শুক্লাষ্টমী তিথিকে দুর্গাষ্টমী হিসাবে পালন করা হলেও, নবরাত্রির দুর্গাষ্টমীতে বিশেষ ভাবে এই ব্রত পালন করার প্রথা আছে ভারতের বিভিন্ন স্থানে। ‘দুর্গাষ্টমী ব্রত’ পালন করলে সর্বসংকট দূর হয়। ব্রতীরা খুব ভোরে উঠে স্নান সেরে নতুন পোশাক পরে ঠাকুরের আসন পরিষ্কার করে নেন। তারপর উপবাসরত অবস্থায় নৈবিদ্য সাজিয়ে এবং ধূপ ও প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবী দুর্গার উপাসনা করেন। উপরোক্ত কারণের জন্যেই দুর্গাপূজায় অষ্টমীর গুরুত্ব অসীম। তাই অষ্টমীর দিনটির আনুসঙ্গিক আচারগুলি নিষ্ঠাভরে পালন করেন বাঙালিরা। অনেক সাত্ত্বিক ভক্ত দিনটা নির্জলা উপবাসে কাটান। আবার বাংলার ঘরে ঘরে সেদিন নিরামিষ আহার বা ফলাহারের আয়োজন করা হয়। মধ্যাহ্নে ঘিয়ে ভাজা লুচি, ছোলার ডাল, বেগুনভাজা আর মিষ্টি ছাড়া অষ্টমী যেন কল্পনাতেই আনতে পারে না বাঙালি।