কলকাতার কুমোরটুলির অজানা তথ্য

উমার সাজ প্রায় সম্পূর্ণ। শেষবেলার রং-তুলির আঁচড় দিতে ব্যস্ত মৃৎশিল্পীরা। উমার সাজঘরের কুশীলবেরা এখন দিন-রাত এক করে মৃণ্ময়ীকে সাজাতে ব্যস্ত। কুমোরটুলি সারাটা বছর থাকে প্রচারের আড়ালে। কিন্তু, এই দুর্গাপুজোর সময়টায় সেই বিশ্বকর্মা'রা আসেন যেন অন্য রূপে! জীবন আর মাটির স্বর্গ যেন একাকার হয়ে যায় প্রতিমা বেরিয়ে পড়ছে সাজঘর ছেড়ে যাচ্ছে মণ্ডপ আলো করে মানুষের মনের আলো জ্বালাতে উৎসবের কাল এল।কুমোরপাড়ার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেল সেই কাল, গভীর রাতে শিল্পী আর কারিগরদের আড্ডা, সাত-সকালের ঘুমভাঙা জীবন, মাটির টান আর সে জীবনের পরতে পরতে ভেসে আসে বন্দনার সুর। মা আসছেন।

kumartuli durga puja

উত্তর কলকাতার গঙ্গার ধারে কুমোরটুলি। বছরের এই সময়টা পুজোর গন্ধ গায়ে মাখতে হাজির হন অনেকেই। উৎসাহী চোখ, কিংবা ক্যামেরার ক্লিক কিংবা শিল্পীর ব্যস্ত হাতের নিঁখুত টান এই সবের কোলাজে মন্দ লাগে না। যদিও শুধু এই সময়টা নয়, সারা বছর ধরে খড়ের গায়ে মাটি লাগিয়ে চলে দেব দেবীদের মূর্তি গড়ার কাজ। এ পাড়ায় অনেক বছর আগে থেকেই বহু লোকের বাস। উৎসাহী ছেলে ছোকরার দল আজ থেকে অনেক বছর আগেই ভেবেছিলো পাড়ার মাঝখানে একটা দুর্গাপুজো করবে। সেই পুজোর নাম কুমোরটুলি সার্বজনীন দুর্গাপুজো।

এ পাড়ারই বিশিষ্ট জনদের অন্যতম ছিলেন দুর্গাদাস মুখোপাধ্যায় । সেই বাড়িতে একসময় মাঝে মাঝে আসতেন সুভাষ বোস। দেশের হাল হকিকত নিয়ে জব্বর আড্ডা হত। তেমনই এক সময় পাড়ার তরুণ তুর্কিরা সুভাষবাবুর কাছে এক নতুন আবদার নিয়ে হাজির। তাদের পুজোর সভাপতি হতে হবে সুভাষবাবুকে। সাল ১৯৩৮।শোনা যায় সুভাষ বোস প্রথমটায় রাজি হতে চাননি। তার বক্তব্য ছিল স্পষ্ট - পুজোয় ব্রিটিশ এর তাবেদার আছে।

ওদিকে তরুণবাহিনীও নাছোরবান্দা। দেশনায়ককেই তারা নিজেদের পুজোর সভাপতি দেখতে চায়। ওদিকে আবার বেঁকে বসলেন পাড়ার অনেক মান্যগণ্যেরা। বিতর্কিত সুভাষ বোসকে সভাপতি করলে ব্রিটিশ রেগে যেতে পারে। সেটাও কি ঠিক হবে! শেষমেশ এ বিতর্ক জিইয়ে রেখেই কুমোরটুলিতে সে বছর দু দুটি পুজো হয়েছিল।একটি পুজোর দায়িত্বে তীব্র দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ তরুণদল। আর সে পুজোর সভাপতি নেতাজী সুভাষ বোস।

দেখতে দেখতে পুজোর দিন হাজির। কিন্তু শেষ বেলাতে ঘটল এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। পঞ্চমীতে আগুন লেগে নষ্ট হলো প্রতিমা।এবার কি হবে? মাথায় হাত সবার! কিন্তু দমবার পাত্র নয় তারা।বুকের মধ্যে গুমরে মরছে দেশাত্মবোধের আগুন।হয়তো সেই সন্ধ্যায় এসেছিলেন সুভাষবাবু স্বয়ং।

সামান্য দূরে গঙ্গা।গঙ্গাপারের হাওয়ায় হয়তো সে রাতে শপথ নিয়েছিলো ওরা কজন। পুড়ে যাওয়া মাতৃপ্রতিমা যেন প্রতীকি।দেশমায়ের ও তো একই দশা। কিন্তু কি হবে। পুজো কি তবে বন্ধ? তবে সে যুগের বাঙালি আজকের মতো ছিল না। মেরুদন্ড ছিল শক্ত। আসলে সময়টাই তো অন্যরকম। পাড়াতেই থাকতেন শিল্পী গোপেশ্বর পাল। বিদেশে গিয়ে পরখ করেছিলেন সে দেশের শিল্পভাবনা, শিল্প কৌশল। মন তা কিন্তু ভীষণ ভাবে স্বদেশী। নিজের হাতে তুলে নিলেন দায়িত্ব। তখন আজকের মতো মাটি শুকোবার যন্ত্র আসেনি। তাছাড়া এক রাতে মাতৃপ্রতিমা বানানো - সেও কি সম্ভব? সে রাতে ঘুম আসেনি অনেকেরই।

সকাল হল। মায়ের বোধন হয় সে সকালে। দেবীপক্ষ। অপরূপ মাতৃপ্রতিমা প্রস্তুত। কিন্তু সময়াভাবে একচালা নয়। পাঁচ দেব - দেবী ছিলেন পৃথক ভাবেই। প্রথমে বেঁকে বসলেন পুরোহিতরা। বলেছিলেন এ প্রতিমা শাস্ত্রসম্মত নয়। শেষমেশ সবাই রাজি হলেন।কলকাতা শহর একদিকে দেখলো - নতুন আদলে দূর্গা ঠাকুর, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠিত হল বাঙালির আত্মসম্মান। এক রাতে তৈরী হলো নয়া ইতিহাস। যদিও এই ঘটনা ইতিহাসে ঠাঁই পায়নি। মুখে মুখে ফেরে কুমোরটুলি তে। এমনটাই জানালেন সেই পুজোর বর্তমান আহ্বায়ক দেবাশিস ভট্টাচার্য। যদিও সবচেয়ে খারাপ লাগার কারণ বোধ হয় এটাই যে আমরা ভুলে গেছি সেই অসামান্য বাঙালি শিল্পী কে। যার নাম গোপেশ্বর পাল।

জি পালের ষ্টুডিও আজও আছে সেই কুমোরটুলিতে। রক্ষনাবেক্ষন করেন সেই পরিবার এর সদস্য ব্যোমকেশ পাল। ষ্টুডিও জুড়ে আজও ইতিহাসের ধূসর চ্যাপ্টার। কথা শরৎচন্দ্র থেকে শুরু করে বহু মনীষীর মূর্তি নিজের হাতে গড়েছিলেন গোপেশ্বর। স্টুডিওর গড়নও কিছুটা বিদেশী ঢং-এ। এমনটা কলকাতা শহরে কমই আছে। এ ষ্টুডিওটা একটা দারুন মিউসিয়াম হতে পারত। হতে পারতো হেরিটেজ ও। কিন্তু বাঙালি ঐতিহ্যে উদাসীন। তাই বছরের এই সময়টা যখন কুমোরটুলির আকাশ বাতাস মানুষের কলকাকলিতে ভোরে যায়, একদম পাশেই নীরবে থাকে পরাধীন ভারতের এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পীর বানানো মূর্তিরা। আর তার পাশে বড্ড চুপ ইতিহাস।
Next Post Previous Post
1 Comments
  • Bani
    Bani ১৭ ডিসেম্বর, ২০১১ এ ৪:২৮ PM

    beautiful idol! :O and revelation! never really heard about this place.. (from anyone) thanks for sharinG! =)

Add Comment
comment url