ক্রিসমাসের আদি অন্ত

বর্তমান কালে পৃথিবীতে সবচেয়ে জাঁকজমকভাবে যে ধর্মীয় উৎসব পালিত হয় নিঃসন্দেহে সেটা ক্রিসমাস। বড়দিন। ক্রিসমাস শব্দটা আক্ষরিক অর্থ খ্রিস্টের সার্ভিস। মেরি ক্রিসমাস অর্থ তাই শুভ হোক খ্রিস্টের সার্ভিস। ক্রিসমাস উদযাপন মূলত যীশুর জন্মদিন পালন। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে এ দিন যীশু জন্ম নেন এ পৃথিবীতে মা মেরীর গর্ভ থেকে। বিশ্বব্যাপী পালিত এ জন্মদিন কি আসলেই জন্মদিন? জন্মতারিখটা ইতিহাস নাকি মিথ সে আলোচনায় যাওয়ার আগে কিছু বিষয় জেনে নেয়া যাক। বেশিরভাগ দেশেই এ দিনটি ছুটির দিন।

এ দিনটার একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হল সান্তা ক্লজ এর লিজেন্ড। সান্তা ক্লজ ফাদার ক্রিসমাস বা শুধু সান্তা নামেও ডাকা হয়। শিশুদের বিশ্বাস করানো হয়, সান্তা ক্রিসমাস এর আগের রাতে সবাইকে গিফট দিয়ে যান মোজা য় ভরে। সাদা দাঁড়ির মোটাসোটা লাল পোশাকের এ লোক থাকেন উত্তর মেরুতে। তাঁর সাথে আছে অসংখ্য জাদুকরি এলফ আর নয়টা (বা ৮টা) উড়ন্ত বল্গা হরিণ। এলফ-রা গিফট প্রস্তুত করে। তিনি সেটা তাঁর স্লেজ এ করে উড়ে উড়ে দিয়ে আসেন।

ক্রিসমাসের আদি অন্ত

আসলে জার্মান মিথলজির সাথে মিল আছে সান্তা ক্লজের। ৩৫৪ সালে রোমে প্রথম এ উদযাপনের ইতিহাস পাওয়া যায়। ঠিক কোন যুক্তিতে চার্চ যে ২৫ ডিসেম্বরকে যীশুর জন্মদিন হিসেবে ঠিক করেছে আর পালন করে সেটা বোধগম্য নয়। তারা বলে, মেরীর গর্ভে আসার সাথে নাকি ৯ মাস যোগ করে এ ডেট ঠিক করা হয়েছে।

৩২৫ সালে কুখ্যাত কাউন্সিল অফ নাইসিয়াতে বাইবেল এর লিখা চুজ করা হয়। আর নিষিদ্ধ করা হয় অনেক গস্পেল। যীশুকে অফিসিয়ালি ঈশ্বর আর ঈশ্বরপুত্র খেতাব দেয়া হয়। তবে তাঁর আগেই ৩১৪ সালে ২৫ ডিসেম্বরকে যীশুর জন্মদিন ঘোষণা দেয়া হয়। একটা ব্যাপার না বললেই নয়, হিব্রুতে ঈশ্বরকে পিতা বলা একটা অলংকার, ভাষাগত অলংকার। মোটেও আক্ষরিক নয়।

তেমনই, ঈশ্বরপুত্র শব্দটাও ছিল রূপক। অধিক ধার্মিক ব্যক্তিদের বলা হত ঈশ্বরের পুত্র। বেনে এলিম। এমনকি, কখনও কখনও সমগ্র মানবজাতিকেই ঈশ্বরের আদরের সন্তান বলা হত। ফেরেশতাদেরকেও বাইবেলের বুক অফ জেনেসিসে বেনে এলিম বলা হয়েছে। তাই এটা যীশুর একার খেতাব, এবং আক্ষরিক খেতাব- এমনটা ভাবার কোনই কারণ নেই।

আগে ২৫ ডিসেম্বরের বদলে ৬ জানুয়ারি ক্রিসমাস পালন করা হত। আরমেনিয়াতে এখনও ৬ জানুয়ারি ক্রিসমাস। ক্রিসমাসের আগের দিন হল ক্রিসমাস ইভ। আর ক্রিসমাস এর পরের দিন হল বক্সিং ডে।

ক্রিসমাসের সময়ই সঙ্ঘটিত হয়, নাম তার হানুকা। হানুকা ইহুদীদের একটি পবিত্র উৎসব। সময়টা ছিল খ্রিস্টের জন্মেরও ১৬০ বছর আগে। সুতরাং, খ্রিস্টধর্মের সাথে কোনই সম্পর্ক নেই। আলেক্সান্ডার দা গ্রেট যে বিশাল মেসিডোনিয় সাম্রাজ্য করে গিয়েছিলেন, সেটা বিভক্ত হয়ে যায় এবং গ্রিক সেলুসিদ সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। রোমানদের বিজয়গাথা শুরু হবার আগ পর্যন্ত গ্রিকরাই ছিল তুঙ্গে, সব জায়গায় গ্রিকদের ধর্ম আর সংস্কৃতির প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে, এটাকে হেলেনিস্টিক (প্রাচ্যীয় গ্রিক) প্রভাব বলে।

এসময় ইজরায়েল বলতে যে অঞ্চল আমরা বুঝি তা ছিল এই সেলুসিদ সাম্রাজ্যের অধীনে। তারও কয়েক শতক আগে ইহুদীদের পবিত্র মন্দির বাইতুল মুকাদ্দাস ধ্বংস হয়ে যায় এবং ইহুদীদের নির্বাসন হয় ব্যবিলনে। সেটা বিশাল কাহিনী, যেটা ইহুদী জাতির ইতিহাস নোটে আলোচনা করব। পরে তাদের ফেরবার পর মন্দির পুনর্নিমাণ হয়, এবং শুরু হয় সেকেন্ড টেম্পল অফ সলোমন পিরিয়ড। কিন্তু, সময় ভালো যায়নি। গ্রিক শাসক অ্যান্টিওকাস জারি করেন যে, ইহুদীরা তাদের ধর্মীয় আচার পালন করতে পারবে না আগের মত। তাদের গ্রিক ধর্ম আর সংস্কৃতি বরণ করে নিতে হবে।

হেলেনিস্টিক জুদাইজম (প্রাচ্যীয় গ্রিক প্রভাবিত ইহুদি ধর্ম) এর সূচনা তখনই। একক ঈশ্বর ইয়াহওয়েহ এর পাশাপাশি এই নতুন ধারার ইহুদী রা উপাসনা করতে লাগল গ্রিক দেবদেবীদেরও। উৎসর্গ করত তাদের কাছে। কিন্তু মূলধারার একেশ্বরবাদী ইহুদীরা সেটা মেনে নিতে পারে নি।

মাত্তাথিয়াস নামের একজন একেশ্বরবাদী ইহুদীর বাড়িতে একজন হেলেনিস্টিক ইহুদী এসে গ্রিক দেবতার কাছে উৎসর্গ করতে এলো, সেটা থামাতে গিয়ে মাত্তাথিয়াসের হাতে সেই হেলেনিস্টিক ইহুদী মারা পড়ে। ফলে, মাত্তাথিয়াস তার পরিবার সহ পালিয়ে যায়। এক বছর পর তার ছেলে জুদাহ মাকাবি ও তার অনুসারীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে সেলুসিদ গ্রিক সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে, ইহুদীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। তারা গেরিলা বিদ্রোহ চালিয়া যায়। এই বিদ্রোহ বিখ্যাত মাকাবিয়ান বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

বিস্ময়করভাবে তারা জিতেও যায়, এবং হোলি টেম্পল পুনরুদ্ধার করে। ততদিনে মন্দিরের অবস্থা খারাপ। ইহুদী প্রথা অনুযায়ী, মন্দিরে একটি মোমবাতি আজীবন জ্বালিয়ে রাখতে হয়। নেভাতে দেয়া যাবে না। অথচ কোন বাতিই জ্বলছিল না মন্দিরে। মাত্র এক বাটি জলপাই তেল খুঁজে পেল তারা। বেশিক্ষণ জ্বলবেও না সেটা দিয়ে, কিন্তু তাও জ্বালিয়ে দিল। অলৌকিকভাবে মোমবাতি টানা আটদিন জ্বলে থাকে সেই তেল এর সাহায্যে।

সেই থেকে পবিত্র মন্দির বা বাইতুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধার স্মরণ করে ইহুদীরা। তারা "মেনোরাহ" নামের একটি বিশেষ মোমবাতির ডালা ব্যবহার করে, যেখানে আটটি মোমবাতি পাশাপাশি রাখা যায়, আর উপরে আরেকটি মোমবাতি। সেই আট দিনের স্মরণে জ্বলতে থাকে আটটি মোমবাতি। আর নবম মোমবাতিকে বলা হয় সাহায্যকারী মোমবাতি। হানুকা শব্দটা আটটা মোমবাতিকে নির্দেশ করে।

হিব্রু পঞ্জিকার ২৫ কিস্লেভ থেকে ২ তেভেত পর্যন্ত আটদিন ধরে চলে এই অনুষ্ঠান। কাকতালীয়ভাবে, এ সময়তা ক্রিসমাসের সাথে মিলে যায়, আর পরবর্তীতে ইহুদীরা হানুকা-কে ক্রিসমাসের বিকল্প হিসেবে নিয়ে নেয়, এবং ক্রিসমাসের মতন গিফট প্রদানের প্রথা শুরু করে। যেমন 2016 খ্রিস্টাব্দে, হিব্রু ৫৭৭৭ সালের হানুকা শুরু হয়েছে ডিসেম্বরের ২৪ তারিখ, আর শেষ আট দিন পর।
Next Post Previous Post
1 Comments
  • Randy
    Randy ২৪ ডিসেম্বর, ২০১১ এ ৯:৫৪ AM

    Beautiful Christmas scene.

Add Comment
comment url