কৃষ্ণের জন্মদিন ও জন্মাষ্টমী

জন্মাষ্টমী শ্রীকৃষ্ণের জম্মতিথি। হিন্দু ধর্মবালম্বীদের মতে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে দুষ্টের দমনে শিষ্টের পালন এবং ধর্ম রক্ষার লক্ষ্যে মহাবতার ভগবান রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের মানবরূপের পৃথিবীর আবির্ভাবের কারণ সম্পর্কে গীতায় তিনি বলেছেন, ‘যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লানি ভবতি ভারত। অভ্যূত্থানম ধর্মস্য তদাতœানং সৃজাম্যহম। পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশয় চ দু®কৃতাম। ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভাবামি যুগে যুগে। জ্ঞানযোগ ৭/৮। হে ভবত, যখনি পৃথিবীতে অধর্ম বেড়ে যায় তখন আমি অবর্তীণ হই, অবতীর্ণ হয়ে সাধুদের রক্ষা দুষ্টের বিনাশ ও ধর্ম সংস্থাপন করি। আধ্যাত্মিক বিবেচনায় দ্বাপর যুগের শেষদিকে ঐতিহাসিকদের ধারণা মতে খ্রিষ্টপূর্বে ১৫০৬ অব্দে সনাতন ধর্মের এই প্রাণপুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ আবির্ভাব ঘটেছিল।

মথুরা নগরীতে রাজা কংসের কারাগারে। সমগ্র ভারতবর্ষে যখন হানাহানি, রক্তপাত, সংঘর্ষ, রাজ্যলোভে রাজন্যবর্গের মধ্যে যুদ্ধবগ্রহ তথা পৃথিবী যখন মর্মাহত, পাশে অবনত, ঠিক সেই সৃষ্টি স্থিতি-পলয়ের যুগ সন্ধিক্ষণে তার আবির্ভাব অনিবার্য হয়ে পড়ে। মানবতাবাদী চরিত্রে চিত্রত পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ জন্ম নেন মথুরার এই অত্যাচারী রাজা কংশের কারাগারে। ঘোর অমানিশার অন্ধকারে তার জন্মগ্রহণ করায় কৃষ্ণের গায়ের রং শ্যামল, অন্য অর্থে ধূসর, পীত, কিংবা কালো। শ্রীকৃষ্ণের জন্মবৃত্তান্তের পটভূমি একটু ভিন্ন ধরনের। এর জন্মের রয়েছে ঐতিহাসিক অনেক কারণ।

ইতিহাসের আলোকে জানা যায়, আজ থেকে ৫ হাজার বছর পূর্বের ঘটনা। মগধের অধিপতি জরাসন্ধ ছিলেন এক রাজ্যলোভী রাজা। তিনি ১৮ বার মথুরা আক্রমণ করেও ব্যর্থ হন। আর সেই ব্যর্থ রাজা গ্লানিতে জরাসন্ধ অস্থির উন্মাদ হয়ে শেষে আশ্রয় নেন এক কুটকৌশলের, মথুবার রাজা উগ্রসেনের পুত্র কংসকে নিজ দলে ভীড়িয়ে তার নিজ দুই মেয়েকে কংসের সাথে বিবাহ দিলেন হীনস্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার স্বরুপ। কংসের সিংহাসন লাভের দুর্বিনীতি আকাক্সক্ষার ফলে জরাসন্ধের সাথে এই আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন হলে জরাসন্ধ ও কংসে দুজনেই অনেকাংশে বলশালী হয়ে উঠেন।

তাদের এই উত্থানে মথুরাবাসী উৎকন্ঠিত হয়ে পড়েন। কারণ মথুরাবাসী ছিল অত্যন্ত দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ। বিশেষ করে যাদবরা তাদের চিরশত্রু জরাসন্ধের সঙ্গে কংসের আত্মীয়তার বন্ধনকে মনে মনে ধিক্কার জানায়। মনেপ্রাণে তারা হয়ে ওঠে আরো বিদ্রোহী। এদিকে ক্ষমতালোভী কংস পিতা উগ্রসেনকে বন্দী করে মথুরার সিংহাসন দখল করে। তখন আত্মীয়-স্বজন ও বিশেষ করে যাদবকূল বিদ্রোহী হয়ে উঠলে তাদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ প্রশমনে কৌশল হিসেবে কংস যাদবকূলের শুর সেনের পুত্র তার বিশ্বস্ত বন্ধু বাসুদেবের সাথে তার বোন দেবকীর বিবাহ দেন।

Janmashtami ISKCON wallpaper images

কংসের আশা দুরাশায় পরিণত হল। সদ্য পরিণীতা বোন দেবকীকে বাসুদেবসহ রথে করে নিয়ে যাবার সময় কংস এই দৈববাণী শুনতে পান; ‘তোমার এই বোনের অষ্টম সন্তানই হবে মৃত্যুর কারণ’ মৃত্যুর আশংকায় উত্তেজিত কংস দেবকীকে হত্যা করতে উদ্যত হলে বসুদের কংসকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, দেবকীর উদরে যে সন্তান জন্ম নেবে তাকে কংসের হাতে তুলে দেবেন। কংস বোন দেবকীকে তখন হত্যা থেকে বিরত থাকলেও বোন ও ভগ্নীপতিকে কারাগারে নিক্ষেপ করতে দ্বিধা করেন নি। এই অবস্থায় বাসুদেব ও দেবকীর বিবাহ বাসর হল কংসের কারাগারে। দশ মাস দশদিন পর দেবকী এক পুত্রসন্তান জন্ম দেন। সঙ্গে সঙ্গে কংসের হাতে তুলে দেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বসুদের সদ্যজাত সন্তান। তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন কংস।

এভাবে একে একে কংসের নির্মমতার শিকার হন বসুদেব-দেবকী দম্পতির আরও ছয়টি সন্তান। এদিকে গোকুলে বাস করতেন বাসুদেবের প্রথমা স্ত্রী রোহিনী, তার উদরে জন্ম নেয় পুত্রসন্তান, নাম তার বলরাম। একে একে দেবকীর সাতটি সন্তানকে হত্যার পর মৃত্যুর চিন্তায় উৎকন্ঠিত কংস হয়ে ওঠে দিশেহারা। এরপর দেবকী অষ্টম বারের মত সন্তান সম্ভবা হলে কারাগারে বসানো কয় কঠোর নিরাপত্তা। চারদিকে আলোয় উদ্ভাসিত করে অষ্টমী তিথিতে অরাজকতার দিন অবসান দিন করতে গভীর অন্ধকার রাতে জন্মগ্রহণ করেন পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ যুগ অবতার। শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের সাথে সাথে বসুদেব দেখলেন শিশুটির চার হাতের শংখ, চক্র, গদা এবং পদ্ম ধারণ করে আছেন। নানা রকম মাহমূল্য মনি রতœ খচিত সব অলংকার তার দেহে শোভা পাচ্ছে।

তিনি বুঝতে পারলেন জগতের মঙ্গলার্থে পূর্ণব্রক্ষ নারায়ণই জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের ঘরে। বসুদেব কড় জোড়া প্রণাম করে তার বন্দনা শুরু করলেন। বসুদেবের বন্দনার পর দেবকী প্রার্থনা শেষে একজন সাধারণ শিশুর রুপ ধারণ করতে বললেন শ্রীকৃষ্ণকে। নিপীড়িত মানুষ মুক্তির আশায় কানুর তথা কৃষ্ণের অনুসারী হয়ে উঠে এবং ক্রমান্বয়ে কংসবধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে কংস অবশেষে কৃষ্ণ বধের জন্য মথুরায় মল্লক্রীড়ার আয়োজন করে। আমন্ত্রণ জানানো হয় কৃষ্ণ ও বলরাশ-কে। মল্লব্রীড়ায় উপস্থিত হন চার পার্শ্বের রাজন্যবর্গ। কৃষ্ণবধের অলীক আশায় কংস তখন আত্মহারা।

ক্রীড়া প্রাঙ্গণের সামনে পাগলা হাতি রাখা হয় কৃষ্ণকে পিষে মারার জন্য। বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে কংস চানুর ও মুষ্টির নামে দুই খ্যাতিমান অত্যন্ত বলবান মল্লবীরকে কৃষ্ণকে হত্যার জন্য স্থলে উপস্থিত রাখেন। কিন্তু অন্তর্যামী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংসের সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেন। তার মুষ্ঠির আঘাতে মারা যায় হাতি, মুষ্ঠিক ও চানুর। হতভস্ব কংস রাজন্যবর্গ সেনদল সহচর সবাইকে তার পক্ষে অস্ত্রধারণ করতে বলেন, কিন্তু কেউ সাড়া দেয়নি।

তখন নিরুপায় কংস যুদ্ধনীতি লংঘন করে অস্ত্রধারণ করা মাত্র কৃষ্ণ রক্তপিপাসু হিংস্র সিংহের মতো প্রবল বিক্রমে কংসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। অশেষে কৃষ্ণের লৌহ মুষ্ঠির আঘাতে কংসকে ভূমিতলে শয্যা নিতে হল। শ্রী কৃষ্ণের জীবনী পাঠ ও কর্মকান্ড মানব সমাজকে শিক্ষা দেয় যে, সৌভ্রাতৃত্ব ও স¯প্রীতির বন্ধনে বিশ্ব সমাজকে আবদ্ধ করার ক্ষেত্রে তার দর্শন ও প্রেমের বাণী রাখতে পারে কার্যকরী ভূমিকা।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url