মরনোত্তর চক্ষু দান

মরনোত্তর চক্ষু দান ধর্মীয় বিধান, দেশের প্রচলিত আইন এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি ধারনা হলেও এক্ষেত্রে এখনও পিছিয়ে রয়েছে দেশ। এমনকি সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির তিন দশকের আন্দোলনেও মরনোত্তর চক্ষু দান কর্মসূচিতে সারা মিলছে না মানুষের। ফলে কর্নিয়ার অভাবে অন্ধত্ব গুচছে না পাঁচ লাখেরও অধিক মানুষের। আন্দোলনে সারা না পাওয়ার কারণ হিসেবে ধর্মীয় গোড়ামী, আলেম সমাজের ভুল ব্যাখ্যা এবং সামাজিক অসচেতনতাই দায়ী করছেন আন্দোলন সংশ্লিষ্টরা।

দেশ থেকে কর্ণিয়াজনিত অন্ধত্ব দূর করার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সেচ্ছাসেবি প্রতিষ্ঠান সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি। এর পরে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত সিনিয়র চিকিৎসক ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ব্যাক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত সমিতির দীর্ঘ ৩০ বছরের এ আন্দোলনে এ পর্যন্ত ৩৬২১১ জন মরনোত্তর চক্ষুদানে অঙ্গীকার করেছেন। ইতিমধ্যে এদের মধ্য থেকে অনেকে মারাও গেছেন। কিন্তু সমিতি এ সময়ে কর্নিয়া পেয়েছে মাত্র ১০২ জনের। অঙ্গীকারের তুলনায় কর্নিয়া সংগ্রহের হার কম হওয়ার কারণ হিসেবে অঙ্গীকারকারী মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের অসহযোগীতাকেই দায়ী।

নিয়মানুযায়ী মানুষের স্বাভাবিক বায়োলজিক্যাল ডেথ হওয়ার ৬ ঘন্টার মধ্যে তার চোখের কর্ণিয়া সংগ্রহ করতে হয়। তাই সবার আগে পরিবারের সদস্যদের দায়িত্ব অঙ্গীকারদাতার মৃত্যুর খবরটি নিকটবর্তী সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতিকে জানানো। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবারের সদস্যরা এই দায়িত্বটুকু পালন করছেন না। তিনি মারা যাওয়ার পর তার পারিবার থেকে সঠিক সময়ে সন্ধানীকে বিষয়টি জানানো হয়নি। ফলে তার কর্নিয়া দুটি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

দেশে মোট অন্ধ ব্যক্তির সংখ্যা ১৪ লাখেরও অধিক। এছাড়া প্রতিবছর ৪০ হাজার করে অন্ধলোক নতুন করে যোগ হচ্ছে এ তালিকার সঙ্গে। দেশের এসব অন্ধ লোকের মধ্যে ০.৩৩ শতাংশ কর্ণিয়াজনিত অন্ধ। সে হিসাবে বাংলাদেশে কর্ণিয়াজনিত অন্ধের সংখ্যা ৫ লাখেরও বেশি। অপরদিকে সরকারের হিসাব মতে দেশে মৃত্যুহার (ক্রড ডেথ রেট) ৭.৮ শতাংশ।

এ হিসাবেও দেশে প্রতিবছর ১১ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। প্রতিবছর মারা যাওয়া এসব মানুষের মাত্র ১.৫ শতাংশের কর্নিয়া পেলেও দেশ থেকে কর্ণিয়াজনিত অন্ধত্ব দূর করা সম্ভব। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে ইতিমধ্যে মানব দেহের অনেক অর্গান কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু চোখ এবং কর্নিয়া এমনই এক অর্গান এখন পর্যন্ত যার কোন বিকল্প তৈরি করা সম্ভব হয়নি। ফলে এখনও মরনোত্তর চক্ষুদানই কর্নিয়ার একমাত্র সোর্স।



তাই কর্নিয়া জনিত অন্ধত্ব দূর করতে মরনোত্তর চক্ষু দানের বিকল্প নেই। মানুষের মৃত্যুর ৮ঘন্টার মধ্যে তার চোখের কর্নিয়া নষ্ট হয়ে যায়। অথচ, মৃত ওই ব্যক্তির একটি কর্ণিয়া একজন অন্ধ মানুষের চোখে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে পারে। আর এর জন্যেই দরকার যৌক্তিক আবেগ, একজন অন্ধ মানুষের জন্যে ভালোবাসা এবং সামাজিক সচেতনতা। এদিকে মরনোত্তর চক্ষুদান কর্মসূচিতে আশাব্যঞ্জক সারা না পাওয়ায় বেওয়ারিশ মৃত মানুষের চোখের কর্নিয়াই হয়ে উঠেছিল সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির অন্যতম উৎস। মোবাইল প্রযুক্তিসহ নানা কারনে সাম্প্রতিক সময়ে সেই বেওয়ারিশ মৃত মানুষের সংখ্যাও কমে এসেছে।

ফলে বছরে সব মিলিয়ে সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির কর্নিয়া প্রাপ্তির সংখ্যা এসে ঠেকেছে ৫০টি থেকে ৬০টিতে। অন্য দিকে সমিতির কাছে কর্নিয়ার জন্যে আবেদন করে অপেক্ষা করছেন এমন অন্ধের সংখ্যাও এক হাজারেরও অধিক। বর্তমানে বছরে যে হারে কর্নিয়া পাওয়া যাচ্ছে তা দিয়ে অপেক্ষমান রোগীদের অন্ধত্ব দূর করতে দুই দশকেরও অধিক সময় লাগবে। এপর্যন্ত সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি বিভিন্ন উৎস থেকে মোট ৩৩৮২টি কর্নিয়া সংগ্রহ করেছে এবং প্রতিস্থাপন হয়েছে ৩২৯১টি। প্রসঙ্গত, ১৯৭৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘সন্ধানী’। স্বেচ্ছায় রক্তদানকে উদ্ধুদ্ধ করাই ছিল সংগঠনটির শুরুর দিকের কাজ।

এর পরে কর্ণিয়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণের মত টেকনিক্যাল কাজ এবং মরনোত্তর চক্ষুদানে মানুষকে উদ্ধদ্ধ করা শুধু মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী দিয়ে সম্ভব নয় বলে ১৯৮৪ সালে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত সিনিয়র চিকিৎসক ও প্রতিষ্ঠিত ব্যাক্তিদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি। বর্তমানে সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির সারা দেশে ৯টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং রাজধানীর নীলক্ষেত এলাকার কেন্দ্রীয় অফিসসহ মোট ১০টি চক্ষুব্যাংক রয়েছে।

দেশের প্রচলিত আইন ও ধর্মী দৃষ্টিতে মরনোত্তর চক্ষুদান: স্বাধীনতার পরপরই মরনোত্তর চক্ষুদানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং এ প্রক্রিয়াকে আইনগতভাবে উৎসাহিত করতে ১৯৭৫ সালে ‘মরনোত্তর চক্ষুদান অর্ডিন্যান্স জারি করে বাংলাদেশ সরকার। কোন ধরনের বিনিময় মূল্য ছাড়া মরোনত্তর চক্ষুদানকে স্বীকৃতি দেয়া হয় ওই অর্ডিন্যান্সে। একই ভাবে ধর্মীয় বিধানেও মরনোত্তর চক্ষুদানকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ১৯৮৫ সালে সৌদি আরবের জেদ্দায় অনুষ্ঠিত মক্কাস্থ ফিকাহ একাডেমীর চতুর্থ সম্মেলনে মরনোত্তর চক্ষুদানকে সমর্থন ও উৎসাহ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশের শরীয়াহ বোর্ডও এ প্রক্রিয়াকে অনুমোদন দিয়েছে। তারপরও বিষয়টিতে দেশের কিছু কিছু আলেম ভুল ব্যখ্যা দিয়ে জনমানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন।

হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, জৈনসহ প্রতিটি ধর্মেই মরণোত্তর চক্ষুদানকে অনুমোদন ও উৎসাহ প্রদান করেছে। তাই মহৎ ও ধর্মীয় এই কার্যক্রমে অংশ নিতে সবারই মরণোত্তর চক্ষুদান করা উচিত। অপরদিকে সাইফুল ইসলাম চৌধুরী জানান, বর্তমানে প্রতিটি কর্নিয়া সংগ্রহ, সংরক্ষন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। সেখানে কর্নিয়া গ্রহিতার কাছ থেকে সন্ধানী সার্ভিস চার্জ হিসেবে গ্রহন করছে মাত্র ১২০০ টাকা। যারা কর্ণিয়া দান করতে পারবেন: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল ব্যক্তিই কর্নিয়া দান করতে পারবেন। এমনকি চোখে যে কোন ত্রুটিযুক্ত ব্যক্তিও বিনা দ্বিধায় কর্ণিয়া দান করতে পারবেন।

তবে যারা এইডস, ভাইরাল হেপাটাইটিস, জলাতঙ্ক, সিফিসিল, ধনুষ্টংকারসহ নানা সংক্রামক রোগের কারনে মৃত্যুবরণ করেন তাদের মরনোত্তর চক্ষু দানের অনুপযুক্ত বলে উল্লেখ করছেন তারা। জানা গেছে, সন্ধানীর আইব্যাংক টেকনিশিয়ানরা মৃত ব্যক্তির সম্পুর্ন চোখ তোলার পরিবর্তে শুধু কর্নিয়া সংগ্রহ করেন। এরপরে চক্ষুদাতার সৌন্দর্যহানী যাতে না ঘটে সেজন্যে কৃত্রিম একটি কর্নিয়া স্থাপন করে দেয়া হয়।
Next Post Previous Post
1 Comments
  • Leif Hagen
    Leif Hagen ১১ জুন, ২০১১ এ ৭:৫১ AM

    As a Rotarian, I can't help but wonder if Rotary has a hand in this cause?

Add Comment
comment url