বঙ্গ দেশের ইতিকথা

১৯৪৭ থেকেই বাংলা দুই ভাগে বিভক্ত। বাংলাকে এইভাবে ভাগ করে সুনিশ্চিত ভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল এবং আজ সেই ভাগ এত গভিরে গ্রথিত যে বেশিরভাগ বাঙ্গালী জনগন এখন অপর দেশের বাঙ্গালীদের তাদের শত্রু মনে করেন! এটি হয়ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সফলতম অর্জনগুলির মধ্যে একটি। বাংলা ভারতের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রের একটি ছিল কিন্তু বর্তমানে এটি একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি এবং পাশ্চাত্য দেশগুলির কাছে আর কোনও সম্ভাব্য ভয়ের কারণ নয়। এর দীর্ঘ, সুপ্রাচীন এবং মহান ইতিহাস গোটা বিশ্বই শুধু নয় বাঙালী জাতি নিজেও ভুলে যেতে বসেছে।

যদিও বাংলা একটি আধুনিক ভাষা ও রাষ্ট্র, তবে তার ইতিহাস প্রায় ১০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পুরনো। এই বঙ্গদেশের নাম 'বঙ্গ' অথবা 'বাংলা' সম্বন্ধে অনেক তত্ত্ব আছে। সহস্র নদীর দ্বারা বেষ্টিত এই ভূমি একদিকে মৌসুমী বায়ুর বর্ষা আরেক দিকে হিমালয় থেকে আগত বন্যা দ্বারা বছরভর প্লাবিত থাকত। এই তত্ত্বটি বেশ সম্ভাবনীয়। অন্য আরেকটি ধারণা অনুসারে রাজপুত্র বঙ্গের নাম থেকে এই বঙ্গদেশের নামের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্রাচীন শ্রুতিকথা মতে চন্দ্রবংশের রাজা বালী ও রানী সুদেষ্ণার পুত্র 'রাজপুত্র বঙ্গ' প্রথমবার এই বাংলায় রাজ্য স্থাপন করেন ও সেই থেকেই এই অঞ্চলের এরূপ নাম।

আরেকটি দাবী অনুসারে সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর সেখানকার একটি উপজাতি এই অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করে। আমরা তাদেরকে 'বং' উপজাতি নামে জানি এবং তারা দ্রাবিড়ীয় ভাষায় কথপোকথন চালাত বলে ধারণা করা হয়। বহু আর্য সাহিত্য থেকেই এই অঞ্চলে বসবাসকারী 'বং' উপজাতির কথা আমরা জানতে পারি।

ভূতত্ত্ব এবং পূরাতত্ত্ব মতে এই বাংলা ১ থেকে ৬.৫ মিলিয়ন বছর আগে সংগঠিত হয়েছিল এবং প্রথম পরিচিত মানববসতি প্রায় ১০০, ০০০ বছর আগে গড়ে উঠেছিল। প্রায় এক লক্ষ বছরের পুরনো আদি প্রস্তর যুগের যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম খুঁজে পাওয়া গেছে এই পশ্চিমবঙ্গেরই দেওলপোতা গ্রামে। প্রায় ১৫ হাজার বছরের পুরনো প্রস্তর নিদর্শনের খোঁজ পাওয়া গেছে পূর্ববঙ্গের দক্ষিনভাগে। যদিও বাংলায় প্যালিওলিথিক যুগের প্রমাণ খুবই সীমিত তবুও নিদর্শন স্বরূপ বলা যেতেই পারে রাঙ্গামাটি জেলায় শিলাখন্ড এবং ফেনী জেলায় শিলার তৈরী কুরাল। ধারণা করা হয় যে উভয়ই ১০-১৫ হাজার বছর পূর্বের। এই বাংলায় ১৫০০-৩০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত পুরনো নব্য প্রস্তর যুগের সভ্যতা গড়ে উঠেছিল যার সাথে বিহার, ওড়িষ্যা ও আসামের যোগসূত্র পাওয়া যায়।



এরপর হঠাৎ করেই বাংলার ইতিহাসে আধুনিক ধাতু প্রসেসিং সভ্যতা এসে পড়ে। পূরাতত্ত্ববিদরাও এই দুই সভ্যতার মধ্যেকার হারিয়ে যাওয়া যোগসূত্র খুঁজে বের করতে সক্ষম হননি। হয়তবা এখানেই লুকিয়ে রয়েছে এই অঞ্চলে হঠাৎ করে এসে পড়া কোন উপজাতির গোপনকথা আর এখানেই আমাদের পুরনো শ্রুতিকথা ও পৌরানিক গল্পের ওপর নির্ভর করে থাকতে হয়। সিন্ধু সভ্যতা আনুমানিক ১৮০০ খ্রীষ্টপূর্বের ধারেকাছে এসে বিলুপ্তি পায় আর এই সময় নাগাতই বাংলার প্রেক্ষাপটে এক আমুল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

'বং' এবং 'আল' উপজাতির গল্প এখানে এসেই মিলে যায়। সাম্প্রতিক কালে উত্তর ২৪ পরগনার বেড়াচাঁপা গ্রামের কাছে চন্দ্রকেতুগড়ে এক অতি প্রাচীন নগর আবিস্কৃত হয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে শহরটি গুপ্ত যুগের(৪র্থ থেকে ৬ষ্ট শতাব্দী) রাজা চন্দ্রকেতুর নির্মিত কিন্তু এখনও এটির কার্বন-১৪ টেষ্ট করা বাকি আছে। সহস্র বছরেরও অধিক পূরনো যক্ষী দেবীর মূর্তি এখানেই খনন করে পাওয়া গেছে। বেড়াচাঁপা জায়গাটি অন্য আরেকটি বিষয়ের জন্যও বিখ্যাত। এই বেড়াচাঁপাতেই রয়েছে প্রাচীন গুপ্তযুগের মন্দিরের জন্য বিখ্যাত স্থান 'খনা-মিহিরের' ঢিবি। বর্তমান বাংলাদেশের কাশিমবাজার উপজেলা ও যশোর জেলার অন্তর্গত 'ভারত-ভানী' জায়গাটিও গুপ্তযুগের মন্দিরের সম্ভাব্য স্থান হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে । এখানে আর্য আক্রমনের বেশ কিছু প্রমান পাওয়া গেছে।

যদিও প্রথম সহস্রাব্দের আগেকার খুব বেশী ধ্বংসাবশেষ এখনও অব্দি আবিস্কৃত হয়নি তবুও বিভিন্ন সুত্র থেকে পাওয়া অভিমত অনুসারে এটা নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে প্রাচীন বঙ্গদেশে বহু নগর নগরীর অবস্থান ছিল। আর্যদের সাথে বাঙালী জাতির যোগাযোগ হওয়ার অনেক আগেই আর্যদের বিভিন্ন লেখায় পুন্ড্র নগরীর কথার উল্লেখ পাওয়া যায়। এখান থেকেই একটি ধারণা মনে আসে যে তবে কি চন্দ্রকেতুগড় বাংলার কোন প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষের ওপর তৈরী হয়েছিল?

প্রাচীন আর্য সাহিত্য অনুযায়ী 'পুর' কথার অর্থ দ্রাবিড়ীয় দূর্গ বা নগরী। যেমন আমরা সিন্ধু সভ্যতায় 'পুরন্দর' দেবতার উল্লেখ পাই যার অর্থ দূর্গ-ধ্বংসকারী। লক্ষ্য করার মত জিনিস হল প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার নগরী গুলোর মতই এই বঙ্গদেশের বহু নগরী ও প্রাচীন বিখ্যাত স্থানের নামের শেষে 'পুর' কথাটির বহুল উল্লেখ দেখা যায়। তবে কি এটা আর্যদের বঙ্গদেশ আক্রমন, অধিগ্রহন ও আধিপত্যের দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে না?
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url