কলেজ স্ট্রিট

কলকাতা শহরের কলেজ স্ট্রীট নামক রাস্তাটি যথার্থই সার্থকনামা। মধ্য কলকাতার বৌবাজার এলাকা থেকে শুরু হয়ে উত্তর দিকে মহাত্মা গান্ধী রোড পর্যন্ত বিস্তৃত এই রাস্তাটির উপরেই রয়েছে বিখ্যাত ও ঐতিহ্যশালী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটা, যেমন ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সী কলেজ (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃত কলেজ, ডেভিড হেয়ারের নামধন্য হেয়ার স্কুল, হিন্দু স্কুল এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অভ্‌ সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড বিজ্‌নেস্‌ ম্যানেজমেন্ট।

এগুলি ছাড়াও সুরেন্দ্রনাথ কলেজ, বিদ্যাসাগর কলেজ, শিক্ষাবিদ্‌ জন এলিয়ট ড্রিংকওয়াটার বেথুনের স্মৃতিবহনকারী ভারতের প্রথম মেয়েদের মহাবিদ্যালয় বেথুন কলেজ, স্কটিশ ধর্মযাজক অ্যালেক্‌জান্ডার ডাফ্‌-এর উদ্যোগে স্থাপিত স্কটিশ চার্চ কলেজ ইত্যাদিও অবস্থিত আশেপাশে হাঁটাপথের দূরত্বেই। কলেজ স্ট্রীটের খ্যাতির আরেকটা কারণ হলো যে এই এলাকাটিই সারা ভারতের সবচেয়ে বড় বইবাজার। বাংলা বই তো বটেই, হিন্দি, ইংরেজি এবং দেশের অন্যান্য প্রায় প্রত্যেকটি ভাষায় কোন না কোন বিষয়ে লেখা বই বা পত্রপত্রিকা ছাপা, প্রকাশিত ও বিক্রী হয় এই এলাকায়।

এছাড়াও মেডিক্যাল কলেজের পরে, কলেজ স্কোয়্যার বা বিদ্যাসাগর সরোবর নামে পুষ্করিণীটির বাইরের ফুটপাথ বরাবর, প্রেসিডেন্সী কলেজের রেলিং এর গায়ে এবং আশপাশের সংকীর্ণ গলিগুলিতে অগুন্তি খুপরির মতো দোকানে কেনাবেচা হয় সেকেন্ড হ্যান্ড বা হাতফেরতা পুরনো বই। বিভিন্ন ভাষার ধ্রুপদী সাহিত্য, সমকালীন বইপত্র, যাবতীয় বিষয়ের পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও, ছাপা নেই বলে সহজলভ্য নয় এমন দুষ্প্রাপ্য বই, এমনকি পাণ্ডুলিপিরও খোঁজ পাওয়া যায় এইসব দোকানে, অনেক সময়েই অত্যন্ত কম দামে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পুরনো বইএর বাজার কলেজ স্ট্রীটেই। প্রথম বৃহত্তম পুরনো বইএর বাজার যুক্তরাজ্যের ইংল্যান্ড-ওয়েলস্‌ সীমান্তবর্তী আধা-গ্রাম আধা-শহর হে-অন-ওয়াই (ঐধু-ড়হ-ডুব) বা ওয়াই নদীর তীরে অবস্থিত হে।

স্কুল-কলেজ এবং বইপাড়া ও বইবাজারের পাশপাশি কলেজ স্ট্রীটের আরেকটি প্রধান ‘ল্যান্ডমার্ক’ হলো ইন্ডিয়ান কফী হাউজ, ছাত্রছাত্রী-বুদ্ধিজীবি-উদীয়মান ও প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-বিপ্লবী নির্বিশেষে সকলের কাছেই যা কেবল ‘কফী হাউজ’ নামেই প্রিয়। প্রেসিডেন্সী কলেজের বিপরীতে বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীটের মুখে এই কফী হাউজের ঠিকানা যে বাড়িতে তার বয়স হবে প্রায় তিনশো বছর। এক সময়ে এটি ছিল বিখ্যাত দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক, ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা কেশব চন্দ্র সেনের পারিবারিক বসতবাড়ি।

১৮৭৬ সালে বাড়িটি ভারতেশ্বরী রাণী ভিক্টোরিয়ার নাতি প্রিন্স অ্যালবার্ট ভিক্টর-এর নামে উৎসর্গ করা হয়, সেই থেকে এটি অ্যালবার্ট হল নামেই পরিচিত। কফীকে জনপ্রিয় করে তোলার এবং তার বাজার বাড়ানোর উদ্দেশ্যে তৎকালীন কফী বোর্ডের উদ্যোগে ১৯৪২ সালে এই বাড়ির দোতলা আর তিনতলা মিলিয়ে একটা দোকান খোলা হয়, যেখানে বসে লোকজন কফী পান করতে ও হালকা খাবার খেতে পারবে। তারপর ১৯৪৭ সালে স্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এই দোকানের নাম দেয় ইন্ডিয়ান কফী হাউজ।

বছর দশেক পরে, কফী হাউজের পরিচালক গোষ্ঠী একবার ব্যবসা গোটানোর পরিকল্পনা করেছিল যথেষ্ট আয় না হওয়ার কারণ দেখিয়ে, কিন্তু ততদিনে শহরের প্রায় সর্বস্তরের মানুষের কাছে কফী হাউজের ‘আড্ডা’ এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রবল গণআন্দোলন শুরু হয়। যেসব কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবির নিয়মিত আড্ডার জায়গা ছিল কফী হাউজ, তাঁরা মোমবাতি জ্বালিয়ে কফী হাউজের প্রতীকি শেষকৃত্যের আয়োজন করে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। প্রেসিডেন্সী কলেজ আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী অধ্যাপকরা কফী হাউজ খোলা রাখার দাবি জানিয়ে সরকারের কাছে স্মারকলিপি পেশ করেন।



ছাত্রছাত্রীদের সোচ্চার প্রতিবাদ তো ছিলই। শেষ পর্যন্ত চাপের মুখে কফী হাউজ বন্ধ করার পরিকল্পনা প্রত্যাহার করা হয় এবং ‘ইন্ডিয়া কফী বোর্ড ওয়ার্কারস্‌ কো-অপারেটিভ সোসাইটী’ নামক সংগঠনটির তত্বাবধানে এটা চালু রাখার ব্যবস্থা হয়। ঐ ব্যবস্থাই এখনও চালু রয়েছে এবং কফী হাউজ ভালোই ব্যবসা করে চলেছে। ১৯৯৪ সালে ভারতের সুপ্রীম কোর্ট বা সর্বোচ্চ আদালত কলকাতার এই কফী হাউজকে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং অ্যালবার্ট হলকে ‘হেরিটেজ বিল্ডিং’ বা অবশ্য সংরক্ষণযোগ্য ঐতিহাসিক ভবনের মর্যাদা প্রদান করেছে।

কফী হাউজের আড্ডার বিষয়ের মধ্যে কী আছে আর কী নেই তার হিসাব করাই মুস্কিল – রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, খেলাধুলা, নাটক, সিনেমা, গানবাজনা, ভবিষ্যতের কত পরিকল্পনা আর কত স্বপ্ন – এক কথায় জীবনের প্রতিটি উপাদান। মান্না দে’র অতীব জনপ্রিয় ‘নস্ট্যালজিক’ গান “কফী হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, কোথায় হারিয়ে গেল পুরনো বিকেলগুলো সেই” শুনে মুগ্ধ হয়নি এমন বাঙালি কি কেউ আছে?

মান্না দে নিজেও ছিলেন কফী হাউজের আড্ডাধারীদের একজন, যেমন ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস থেকে শুরু করে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, অথবা আজও যেমন আছেন অমর্ত্য সেন, মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়সহ আরো অনেকেই। শারীরিক বা অন্য কারণে সবাই হয়তো এখন আর নিয়মিত এখানে আড্ডায় বসতে পারেন না, কিন্তু তাঁরা আছেন।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-যুবক পড়ুয়াদের ভীড়ে প্রবীণদেরও কখনোই বেমানান মনে হয়না। প্রায় তার জন্মলগ্ন থেকেই কফী হাউজ কলকাতার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে, সেই সাথে রাজনৈতিক ইতিহাসেও। ষাটের ও সত্তরের দশকের নক্‌শাল আন্দোলনের সময় এই মতাদর্শে অনুপ্রাণিত ছাত্রদের অনেকেই সলাপরামর্শ করার ঘাঁটি হিসাবে কফী হাউজকেই বেছে নিতো, কারণ সেখানে ছাত্রদের উপস্থিতি এতটাই স্বাভাবিক ছিল যে চট্‌ করে কেউ কোন সন্দেহ করতো না।

তা সত্ত্বেও অবশ্য কফী হাউজের দিকে পুলিশের নজর পড়েছিল, বেশ কিছু নক্‌শালপন্থী ছাত্র ও নেতাকে গ্রেফ্‌তার, এমনকি তথাকথিত ‘এনকাউন্টার’-এ খতম করা হয়েছিল কফী হাউজে কিংবা তার আশেপাশের গলিঘুঁজির মধ্যে। বছর কয়েক আগে কফী হাউজের ভিতর দিকটা নতুন করে সাজানো হয়েছে। কালের প্রকোপে বিবর্ণ মলিন হয়ে আসা দেওয়ালে নতুন রঙের প্রলেপ পড়েছে, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নেতাজী প্রমুখ মনিষীদের ছবি টাঙানো হয়েছে, সাবেক মার্বেল-টপ্‌ টেবিলগুলি এখনও রয়েছে তবে পালিশ চটে যাওয়া নড়বড়ে কাঠের চেয়ারগুলির জায়গা নিয়েছে রঙচঙে প্ল্যাস্টিকের চেয়ার।

বহিরঙ্গে এই জাতীয় কিছু পরিবর্তন সত্ত্বেও কফী হাউজের নিজস্ব বাতাবরণ, মেজাজ অক্ষুন্নই রয়ে গেছে। শহরের প্রায় প্রতিটা রাস্তাতেই আজকাল ব্যারিস্টা বা ক্যাফে কফী ডে’র মতো ঝক্‌ঝকে অত্যাধুনিক কফী শপ্‌ গজিয়ে ওঠার পরেও ইন্ডিয়ান কফী হাউজের চিরকালীন আকর্ষণ এখনও কমেনি।
Next Post Previous Post
1 Comments
  • Leeds daily photo
    Leeds daily photo ২৪ মে, ২০১১ এ ১:৫৪ PM

    Of all the books, in all the world, there is I notice a book Mr Nice by Howard Marks. I have this book, 3 ft from me as I type this, he lives here in Leeds and is part owner of a local bar, a film was made about his life recently.
    But on a different note books are more than mere paper and pages. Give a child an appreciation of the written word and you give them the world.

Add Comment
comment url